আপনি দেশ প্রেমিক? আশা করি আপনার উত্তর হবে হ্যাঁ। শুধু আপনি কেন এই প্রশ্ন যাকেই করবেন আশা করি এক কথায় উত্তর দিবে হ্যাঁ বলে। কিন্তু আমি এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দিতে পারি না। কারন আমি হয়ত পুরো দেশপ্রেমিক নই। প্রেমের সংজ্ঞাতে বলা হয়েছে, প্রেম সব রকম স্বার্থ এবং শর্ত বিহীন। কিন্তু আমার প্রেমে এ স্বার্থ এবং শর্ত দুইটাই আছে। তাই দেশের সাথে প্রেম বা দেশপ্রেম বা নিজেকে দেশপ্রেমিক কিভাবে বলি!
কেন আমি দেশপ্রেমিক নই, নিশ্চয়ই তা জানতে চান? আমিও বলতে চাই। কিন্তু সমস্যা হল এত এত কারন কোনটা বাদ দিয়ে যে কোনটা বলি। এই যেমন ধরুন, আমি সেদিন গিয়েছিলাম ট্রেড লাইসেন্স করাবো বলে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন রকম চার্জ। আমি যে যে ক্যাটাগরি চাই তার সবগুলো পেতে হলে আমাকে বেশ ভালো সরকারী ফী জমা দিতে হবে। এক কোনায় দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করা যায়, এমন সময় এক মামা এগিয়ে এলেন। প্রাথমিক কথাবার্তাতে যা বুঝলাম, তাতে উনাকে হাজার পাঁচেক টাকা দিলেই আমার প্রায় অর্ধেক টাকা বেঁচে যায়। ব্যাস রাজি হয়ে গেলাম। করে ফেললাম লাইসেন্স। ২টার টাকায় ৬টার অনুমূতি পেলাম। সরকারী টাকা মেরে দিলাম। নগর ভবন থেকে বেরিয়ে দেখি একলোক দূর্নীতি নিয়ে বেশ উত্তেজিত ভাবে চিৎকার করছেন। বৃ্দ্ধলোক দেখে মায়া হলো। সান্তনা দিতে গেলাম। তারপর দু'জন মিলে সম্মিলিত ভাবে কিছুক্ষন সরকার, নগর ভবনের লোকজন, দেশ সবাইকে গালাগালি করলাম। শালার দুর্নীতি দেশটাকে শেষ করে ফেলছে। অতঃপর ক্লান্ত হয়ে যে যার পথে গেলাম।
নিজের সার্থের জন্য সরকারী টাকা চুরি করাতে সাহায্য করলাম আমি। আমারই সাহায্যে হলো এমন একটা চুরি। আর আমি কি না নিজেকে দেশপ্রেমিক ভাবি? আপনি দেশপ্রেমিক। আমার অবস্থা দেখে আপনার হাসি পেতেই পারে।
আবার দেখেন, রোজা আসছে। আমাদের আবার আমদানি রপ্তানী ব্যবসা। বাইরে থেকে মাল আনলাম ভরপুর। ছোলা, খেজুর, চিনি ইত্যাদি। মাল পোর্ট থেকে চুপচাপ গোডাউনে এনে ফেলে রাখলাম। দোকানে যখন পাইকারী ক্রেতারা আসে, তখন মুখ বেজার করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ভাই আমদানি বড়ই খারাপ। সরকারের কারনে কোন কিছুই গোডাউনে জমা রাখতে পারি না। চান্দাবাজ, পুলিশ বড়ই ত্যাক্ত করে, তবে আপনি আমার পূরানো কাস্টমার। আপনারে আমি খালি হাতে ফেরাতে পারি না। যদি কেজিতে ১০ টাকা বেশি দিতে পারেন তাহলে কিছু মাল আমি আপনাকে জোগাড় করে দিতে পারি। এইখানে আমার কোন লাভ নাই।
পাইকারী ক্রেতা সাথে সাথে হিসাব করে ফেলে। কেজিতে ১০ টাকা বাড়তি দিয়া যেহেতু কিনতে হলো, সেহেতু নুন্যতম ২০ টাকা বেশিতে না বিক্রি করলে পোষবে না। খুচরা বাজারে এই বৃ্দ্ধি শেষ পর্যন্ত ৩০ - ৪০ টাকা পর্যন্ত বৃ্দ্ধি পায়।
আমার কি বলেন? ব্যবসা করতে হবে না? কত খরচ আছে? সরকারী চান্দাবাজ আছে, বেসরকারী চান্দাবাজ আছে। এত টাকা খরচ করে ব্যবসা করছি, একটু লাভ করবো না? আর দেশে মানুষের কি টাকার অভাব আছে? দামি দামি গাড়ি, বাড়ি সবই কেনা হচ্ছে। খালি খাইতে গেলে টাকা নাই। যত্তসব ফালতু কথা। এই যে সবাই বলে এত দাম বাড়ে, কাউকে না খাইয়া মরতে দেখছেন। দুইটা টাকা লাভ করছি, এতে সবার গায়ে জ্বালা ধরে গেল তাই না?
আমার মাসে ট্যাক্স আসে ২০,০০০/ টাকা। আল্লাহর রহমতে ট্যাক্স অফিসে আমার এক পরিচিত দেশীভাই আছে। উনার মারফত আমি, বেচা কম দেখাইয়া ৫০০০ টাকা ট্যাক্স দিই। আর উনারে দিই ২০০০ টাকা। পুরা ২০,০০০/- টাকা ট্যাক্স দিলে আর ব্যবসা করা লাগবে না।
আমার দোকানের সামনের রাস্তা ভাঙ্গাচোরা। ২ বছর ধরে এই রকমই আছে। প্রায় সময় দোকানে যারা আসে, তারা মহা বিরক্ত হয়। তাদের জন্য ঠান্ডার অর্ডার দিতে দিতে সরকারের গুষ্টি উদ্ধার শুরু করি। বলি শালারা আমাদের ট্যাক্সের টাকাও মেরে খায়। আগামীবার এই দলকে আর ভোট না ইত্যাদি ইত্যাদি।
কি আমার দেশপ্রেম দেখেছেন? আপনি না হয় নিয়মিত ট্যাক্স দিতেন, সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াতেন না। আপনার মত না হই। কাছাকাছি তো কিছুটা হলেও আছে তাই না? আরো কত বড় বড় চুরি হচ্চে শুধু আমি এইটুক করেছি বলেই আমার দেশপ্রেম কমে যাবে? শুনেন আমি বলি কি
দেশপ্রেম বাজে কথা। নিজে খাইতে পারলে তারপর প্রেম।
সেদিন একটা লেগুনা গাড়ী এক রিক্সারে ধাক্কা দিয়া রিক্সাওয়ালার মাথা ফাটাইয়া ফেলল। সবাই হইচই করে লেগুনারে ধরতে গেল। কিন্তু কিছুই করতে পারল না। রিকশাওয়ালা মাটিতে পড়ে রইল, খুব বেশি কেউ এগিয়ে আসল না। গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। কেউ বা চলন্ত গাড়ি থেকে মাথা বের করে দেখতে লাগল। কিন্তু হসপিটালে নেয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসল না। আমার নিতে চাইলাম না। কি দরকার খামোকা এই উটকো ঝামেলা নিজের কাঁধে নেয়া। আমি চলে আসলাম।
আমি নিশ্চিত আপনি, যিনি কিনা দেশপ্রেমিক, আপনি সেখানে থাকলে অবশ্যই সেই রিকশাওয়ালকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন। আপনি কেন বুঝেন না, আপনার মত দেশপ্রেমিক-ই আমাদের দেশের সাথে প্রেম বা দেশপ্রেমের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরনা।
হাজীর বিরিয়ানী বড়ই পছন্দ আমার। তাই পুরানো ঢাকাতে গেলে প্রায়ই আমি 'হাজী' মেরে আসি। একদিন খাচ্ছি হঠাৎ দেখলাম হইচই। একজন আনুমানিক ৬৫/৬০ বছরের বৃ্দ্ধ লোককে সবাই বেশ সুনিপুন ভাবে মারছে। ঘটনা কি? ঘটনা হলো এই বৃ্দ্ধ লোকটি নাকি হোটেলের ফেলে দেয়া খাবার প্রায়ই না বলে নিয়ে যায়। এইটা নাকি চুরি। ঢাকা শহরের লোকজন অনেক নীতিবান। চোখে সামনে কেউ চুরি করবে আর সবাই সেটা সহ্য করবে এটা অসম্ভব। তাই তো সদ্য মুক্তি পাওয়া নতুন কোন হিন্দি অ্যাকশন ছবির অ্যাকশনের মতন অ্যাকশন সেই বৃ্দ্ধ লোকটির কপালে জুটে। আমার আবার বিরিয়ানী ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। তাই তাড়াতাড়ি বিরিয়ানী খাওয়ায় মন দিলাম।
আপনি দেশপ্রেমিক, আপনি থাকলে প্রতিবাদ করতেন। আমিও দেশপ্রেমিক। তবে আপনার মত না।
ভারত পাকিস্থানকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। বন্ধুমহলে আমাকে সবাই ভারত-পাকিস্থানী বিদ্বেষী বলেই জানে। দেশপ্রেমের অংশ হিসেবে আমি প্রতিনিয়ত ভারত পাকিস্থানকে গালাগালি করি। এইরকম গালাগালি করে আমার যখন মাথা গরম হয়ে যায় আমি তখন বাসায় এসে গোসল করে হিন্দি গান ছেড়ে দিই। আহ! কি মিউজিক! পাকিস্থানী গজলগুলো তো সেই মাপের। অন্তর ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রেম বেড়ে যায়। প্রেম বেড়ে যাওয়ায়
পারটাইম প্রেমিকার কথা মনে পড়ে। সাথে সাথে ফোন করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এয়ারটেলে এ কানেকশন পেতে সমস্যা হয়। তাই ল্যান্ডফোন থেকে ফোন করতে যাই। ফোন আবার আমার লিভিং রুমে। গিয়ে দেখি, আম্মা আর বোনরা বসে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। আমার আবার এক হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকাকে অনেক পছন্দ। বাসায় ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছি এই নায়িকার মত মেয়ে না পেলে আমি বিয়েই করব না। যাইহোক দিলাম ফোন, গার্লফ্রেন্ডকে। ফোন দিয়ে দেখি ও তো মহা খেপা। ২ দিন ধরে তেমন খোঁজখবর নিতে পারি নাই। নতুন কাউকে হাতে না পাওয়া পর্যন্ত এইটাই ভরসা। তাই অভিমান ভাঙ্গাতে গিয়ে বললাম , রাগ কইরো না বন্ধু আমার, রাগ কইরো না তুমি, তোমার জন্য আনব কিনে 'আনারকলি' আমি, ও বন্ধু আমি তোমার পাগাল হুয়া দিওয়ান্যা। এমন ঘোষনায় প্রেমিকা আমার গলে যায়। আমিও গুটিয়ে নয়, চুটিয়ে প্রেম করতে থাকি।
দেশপ্রেমিক কেউ নিশ্চয় এমনটা করেন না। আমি তো সাধারন দেশপ্রেমিক। তাই আমার প্রেমে কিছুটা ভনিতা আছে। আপনার আশা করি এমন ভনিতা নেই।
যাইহোক এমন অনেক উদহারন আছে। সব দিতে গেলে সমস্যা। লিখতেও যেমন কষ্ট। পড়তেও কষ্ট। তবে আশার কথা আমার মত দেশপ্রেমিক মনে হয় খুব বেশি একটা নাই। যারা সব কিছুর দায়ভার রাষ্ট্রের কাঁধে চাপিয়ে দেন, যারা নিজেরা দুর্নীতি করে রাষ্ট্রের দুর্নীতির সমালোচনা করেন, যারা মানুষের প্রতি মিথ্যে মানবতার দোহাই তুলে রাষ্ট্রকে দোষ দেন না। যারা সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা তৈরি করেন না, যারা মিথ্যে সভ্যতার দাবি করেন এমন লোক নিশ্চয় হাতে গোনা।
আপনার মত যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক যারা আছেন তারা নিশ্চয় ভাবেন, আপনি দেশকে কি দিয়েছেন। আপনারা নিশ্চয় বলেন না, অন্যরা বড় বড় দূর্নীতি করছে, আমরা সাধারন মানুষ ছোট খাট একটা কিছু করলে কি সমস্যা? প্রিয় দেশপ্রেমিক বন্ধুগন এইবার দয়া করে এই সাধারন মানুষের লেবাস ছাড়ুন। সাধারন মানুষকে আর কত বেচব আমরা।
হাজার মানুষ করুন না দুর্নীতি। আপনি করবেন না। কুকুর তো মানুষকে কামড়ায়। কই কোন মানুষ কি কুকুরকে কামড়ায়?
আমাদের দেশের অনেক খারাপ কিছু যেমন আছে। তেমনি অনেক ভালো দিকও আছে। আমারা নিজেদের দূর্বলতার কারনে আমাদের দেশটাকে নিজেরাই নষ্ট করছি। কোন সরকার জীবনে পারবে না কোন দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে যদি না ঐ দেশের জনগন চায়। আর আমাদের দরকার একজন ভালো নেতা। আফসোফ যেটা আমাদের নেই। আমরাই আমাদের নেতাদের নষ্ট করি। কারন নেতাকে চাটুকারিতা করলে আমি আর্থিক ও সামাজিক ভাবে লাভবান হব। ক্ষমতার অপব্যবহারে আমি সিদ্ধহস্ত হবো। দেশের কি হবে না হবে তা ভাবার সময় কই? তাই তো বিগত বছর গুলোতে নতুন কোন নেতা আমরা পাইনি। যা পেয়েছি তা একটা পুরানো এক টাকার কয়েনের এই পিঠ আর ঐ পিঠ।
আমি তো দেশপ্রেমিকের লেবাসে ভন্ড প্রেমিক । আমার মত ভণ্ডদেরকে চিহ্নিত করুন। আমার ফাঁসি দিন। আমার মত কুলাঙ্গারই দেশকে প্রেমের কথা বলে দেশ বেঁচে খেতে দ্বিধা করে না। আমার দেশকে 'আমি' মুক্ত করুন। দেখবেন আমাদের দেশে আপনাদের মত সত্যিকারের কিছু ভালো দেশপ্রেমিক মানুষ তৈরি হবে। যারা আমাদের দেশটাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন। যারা আগামি প্রজন্মকে উপহার দিবে সত্যিকারের দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন মানুষ।
ফাঁসির সময় জয় বাংলা কিংবা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ কোনটাই বলতে চাই না আমি। নতুন কিছু বলতে চাই আমি।
'বাংলাদেশ! তোমাকে ভালোবাসি আমি।'
দুঃখিত, পোষ্টটা কিঞ্চিত বড়ই হয়েছে, নিজগুনে ক্ষমা করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪০