
আকতার স্যার । ডিপামেন্টের অন্যান্য ম্যাম , স্যারদের মাঝে সবচেয়ে কঠিন মানুষ আবার সবচেয়ে ভালো মানুষ। কলেজে বা ডিপার্টমেন্টে তাকে সক্রেটিস হিসেবে জানে। অনেক জ্ঞানের অধিকারী কিন্তু তার কাছ থেকে বকা খায়নি এমন কোন ছাত্র ছাত্রী আছে কিনা সন্দেহ। কেউবা তার আতঙ্কে তাকে ষ্টীম রোলার হিসেবেও ডাকে।
কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিন থেকে স্যারের ষ্টীম রোলারের মহত্ত্ব বুঝা গেলো। তখনো ক্লাস শুরু হয়নি পাশে বসা বান্ধবীদের সাথে পরিচয় আর খোশ গল্প চলছিলো , হঠাৎ হুংকার .... এই মেয়েরা কি হচ্ছে? দাঁড়াও। অরিয়েন্টেশন ক্লাসে এসেই দাঁড়াতে হলো ? লজ্জায় লাল গেলো মৌ সহ ভবিষ্যতর ৭ বান্ধবীর ৪ জন। সেদিন কোন মতো ছাড় পেয়েছিল কিন্তু স্যার ওদের চিনে ফেলেছিলো ঠিকই।

ফাষ্ট ইয়ারের ক্লাস মাস ঘুরতে না ঘুরতেই সাত বান্ধবী জুটে যায়। জান্নাতি, মিলি , আমেনা, ফারিহা, লিজা, তানজিয়া আর মৌ হয়ে গেলো ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের সবচেয়ে বড় বান্ধবীদের দল। প্রাইভেট , ক্লাস , আড্ডা , মার্কেটিং, মেলা ইত্যাদি সবখানেই নূনতম ৪/৫ জনকে পাওয়া যাবেই। বসন্ত উৎসব , ঈদ , জন্মদিন , বিবাহ , ফাল্গুন বরণ কোথায় নেই ওরা? সব খানেই পাওয়া যায় ওদের। এ নিয়ে অন্য মেয়েদের ঈর্ষার সম্মুখীন কম হতে হয়নি।
ক্লাসে মেয়েদের সারির মাঝামাঝিতে পরপর দুই বেঞ্চে সাত জন পাশাপাশি পাশাপাশি বসাটা যেন নিয়ম হয়ে গেছে। নিয়মিত সবার কারণে অন্য কোন ক্লাসমটেরা এই বেঞ্চে বসতো না। ১ম বর্ষে আকতার স্যারের ক্লাস না থাকায় রক্ষা।
সময় বদলালো , দিন বদলালো , ক্লাস বদলালো , বছর ঘুরলো ওদের মাঝে ৩ জনের বিয়েও হয়ে গেল ইতিমধ্যে। সবসময়ে না আসতে পারলেও সুযোগ পেলেই ৭ জনের বিশাল গ্রুপের হয়ে যায় খুনসুটি আর পেটে জমানো হাজারো কথার আড্ডা।
থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু মানে ওদের বিপদের শুরু। বিপদ মানে আকতার স্যারের বিপদ। যেখানেই বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায় অবস্থা। ওদের কাছে ভীতিকর নাম আকতার স্যার, শুধু ওদের কাছে নয় বলা চলে সকলের কাছে। আকতার স্যারের সাক্ষাত মানেই কিছু বকা সৌজন্য হিসেবে উপহার লাভ।

চিরাচরিত নিয়ম হিসেবেই ৭ বান্ধবীর শুধু মিলি ছাড়া ৬ জনই নির্দিষ্ট স্থানে বসে চরম হাসাহাসিতে মত্ত ছিলো ওরা । এ মূহুর্তেই ক্লাসে প্রবেশ করলেন কিন্তু ওরা তার উপস্থিতি খেয়াল করেনি কিন্তু যখন খেয়াল করলো ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে, স্যারের হুংকার ধ্বনি উচ্চারিত হয়ে গেলো।
এ মেয়েরা , কি কথা হচ্ছে? দাড়াও। তোমরা যে গল্পবাজ তা প্রথম ক্লাসেই চিনেছি।
প্রথমে দাড়ালো তানজু তারপর মৌ এরপর স্যার একে একে সবাইকে দাড় করাচ্ছিলেন আর পড়া ধরছিলেন কিন্তু ভালো উত্তর কেউ পারছিলো না। অবশেষে জান্নাতি কারনে সেদিন রক্ষা পেয়েছে ঠিকই কিন্তু আকতার স্যারের নজরে আরো ভালো করে পড়লো ওরা। এরপর থেকে প্রতিদিনই ওদের কাউকে না কাউকে পড়া ধরবেনই, কোন মাফ নাই। পড়া না পড়ালেই কিছুক্ষণ দাড়া করিয়ে রাখবেন আর এ অবস্থা শুধু ওদের বেলাতেই নয় স্যারের ক্লাস শুরু হলেই যেন স্কুলের ক্লাস শুরু হয়ে যায় , প্রতিদিনই কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ জন দাড়িয়ে থাকতেই হবে। এটাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে।

সেপ্টেম্বরের কোন এক বুধবার সমাজবিজ্ঞান ভবনের মাঠের পূর্ব কোণায় গোল হয়ে বসে মৌ , মিলি , তানজুরা আড্ডা দিচ্ছিল । টানা ক্লাসের ফাঁকে কিছুক্ষণ দম নেয়ার চেষ্টা। কিন্তু কপালে যে আকতারের বকা আছে তা ঠেকাবে কে? উদয় হলেন আকতার স্যার । ওদের দেখেই তার হুংকার...... .... তোমাদের পেটে কত কথা আছে বলতো? পড়ালেখা নাই শুধু আড্ডা আর গল্প। বকা আর উপদেশ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। নাহ স্যারকে নিয়ে আর পারা গেল না। যে যার মতো চলে গেল ক্লাসরুমে। গল্পটা ক্লাসেই করতে হবে।

তানজুর বাসা কলেজ থেকে বেশ দূরে। আগের রাতে ওর মা ষ্টোক করার কারণে আমেনা , জান্নাতি আর মৌ গেল তানজুর বাসায়। ওর মাকে দেখে বাসার গেট দিয়ে বের হতেই গেটের সামনে আকতার স্যারের মুখোমুখি ওরা। আকতার স্যারের আত্মীয়ের বাসা পাশের বাসায় । দেখা করতে এসেছেন।
আরে ! তোমরা আমার ছাত্রী না ? এখানে কি?
কারণ বলাতে স্যারের মন গলালো না তার আগেই ..... বুঝেছি এই করে বেড়াও ? পড়ালেখা নাম নাই শুধু ঘুরে বেড়ানো? রবিবার ক্লাসে আসো.... বুঝাবো....... আরো ইত্যাদি ইত্যাদি।
কলেজের পাশে সপ্তাহব্যাপী বস্ত্রমেলার প্রায় দিনের দর্শক হলো মৌ আর ওর বান্ধরীরা। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও ঘুরছিলো ওরা, হঠাৎ দেখা হয়ে গেল ক্লাস মেট মারুফ, জনিদের সাথে। ভয় দেখানো ওষুধ হিসেবে ওরাও আকতার স্যারকে বলে দেয়ার ভয় দেখাতেই মেলা থেকে সেদিনের মতো বের হয়ে আসলো ওরা।
তানজু, মিলি, আমেনা , ফারিহা, মৌ দের আড্ডার একাংশ থাকে কিভাবে আকতার স্যারের পরের ক্লাসে বা তার সামনে থেকে পার পাওয়া যায়।
এতো কিছুর পরও আকতার স্যারই ওদের প্রিয় স্যার । স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে অনেকেই চায় ওরাও চেয়েছিলো কিন্তু স্যার এক কথার মানুষ, তিনি প্রাইভেট পড়াবেন না। যা পড়াবেন ক্লাসেই। আসলেই তাই তিনি ক্লাসে যা পড়ান এরপর বাসায় গিয়ে বা প্রাইভেট পড়ার কোন প্রয়োজনই হয় না।
আকতার স্যারের বকা খায়নি এমন কেহ নেই কিন্তু তার ক্লাসে উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। পিনপতন নিরবতা বিরাজ করে স্যারের ক্লাসে। তার পড়ানোর সময়ে সকলে গ্রোগ্রাসে গিলতে থাকে সবকিছু।
মৌ, তানজু ৭ বান্ধবীরা স্যারের বকা খায় , আকতার স্যার আতঙ্কে ভুগে সবসময়ে , তবুও ওদের বড় দলটাকে যেন স্পেশাল বকা আর স্নেহের ভান্ডার খুলে দিয়েছেন। দেখলেই বকা দেন আবার নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেন, পড়ালেখার খোঁজ নেন। তাইতো সবসময় ওরা একদিকে আতঙ্কে থাকে অন্যদিকে স্যারকে ভালোলাগে।
আকতার স্যার সহ সকল প্রিয় শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্মান রইলো।

শায়মা আপুর গল্প লেখা থেকে উৎসাহিত হয়ে ...........
http://www.somewhereinblog.net/blog/saimahq
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১:৫৮