দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতির অস্তিত্ব বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের মুখে কোণঠাসা। আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ত পথে ভিনদেশি ঐতিহ্য, আচার ব্যবহার, পোশাক এবং ধর্মীয় প্রভাব বাংলাদেশী কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের মনোজগতে যে প্রভাব ফেলছে তাতে দেশপ্রেম ও সাজাত্যবোধ গড়ে ওঠার পথে বিরাট বাধার সৃষ্টি করছে। ফলে এদেশের শিশু-কিশোররা তার অতীতে সংগ্রামী বীর পুরুষদের কথা ভুলে জাতীয় বীর হিসেবে ভিনদেশি চরিত্রকে স্নাত স্মরণীয় মনে করছে। এভাবে এদেশীয় শিশু-কিশোরদের মনে হীনমন্যতা ধীরে ধীরে শিকড় বিস্তার করছে। ফলে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক দখলদারিত্বের পথ নির্মাণে ভারতীয়দের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। এতে দেশটির সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের থাবায় বিপন্ন এদেশের সার্বভৌমত্ব। এখন আমাদের একটি দেশকে পদানত করতে হলে সে দেশের সংস্কৃতি ঐতিহ্যকে চূরমার করার রেওয়াজ অতি প্রাচীন। সংস্কৃতিতে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লোলুপ থাবা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে।
ভারত সরকারের চাপে এদেশের সরকার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অসহায়। শিল্প, সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশ বিষয়ক অধিকাংশ প্রকল্প সরকার নিচ্ছে ভারতীয়দের চাপে। বাংলাদেশ হয়ে উঠছে ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার ‘উর্বর ক্ষেত্র’, শিল্পীদের রমরমা বাজার। তারা বাংলাদেশকে ‘বাণিজ্যিক ক্ষেত্র’ হিসেবে বেছে নিচ্ছে। দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি থাকলেও এসব চলছে চুক্তির তোয়াক্কা না করে। এ দেশের বিদ্যমান আইন না মেনে তারা চালাচ্ছে তাদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা। এতে সংস্কৃতি ধ্বংসের পাশাপাশি ভারতে চলে যাচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকা।
এ দেশে এখন সরকারি, বেসরকারি অনেক অনুষ্ঠান শুরু হয় ভারতীয়দের অনুকরণে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে, ঢোল বাদ্য বাজিয়ে।
মন্ত্রী, সচিব, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, আওয়ামীপন্থী, বাম সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা এটা করছেন। ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। গত মার্চ মাসে এ দেশের স্বাধীনতা লাভের চল্লিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ছিল ভারতীয়দের জয়জয়কার। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত বাজানোও আজকাল আর বিচিত্র কিছু নয়। গত ১ এপ্রিল ঢাকায় আয়োজিত রোটারি ক্লাবের বাংলাদেশ শাখার সম্মেলনে নীতিমালা অমান্য করে বাজানো হয় ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত। শিল্পীর পাশাপাশি হিন্দিভাষী উপস্থাপিকাও আনা হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের উদ্যোগে এসব অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে।
এক গবেষণা মতে, সরকারি সহায়তার পাশাপাশি গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, সঙ্গীত শিক্ষালয়, নাট্যবিদ্যালয়, নাট্যশালা, আর্ট স্কুল, ফ্যাশন শো, সঙ্গীত-অভিনয়-সুন্দরী প্রতিযোগিতা, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, সেমিনার, এনজিও, হাসপাতাল, রূপচর্চা কেন্দ্র, শিক্ষাবৃত্তি, ক্লাব-সমিতি, সাংস্কৃতিক সফর, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি এদেশে ঢুকছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এক রাষ্ট্রের আইন না মানাটা ওই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা। অবমাননার বিষয়টা যেভাবে চলে আসছে তাতে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দিন দিন বিস্তৃত হয়ে উঠছে।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ভারত প্রাচীন সংস্কৃতির দেশ হলেও আমরা দেশটির পর্নো সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মিডিয়া ব্যবসায়ীরা ওই পর্নো সংস্কৃতি উপভোগ করছে। এতে এ দেশের সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারছে না। সংস্কৃতি চর্চার নামে এ দেশের যারা আইন না মেনে ভারতীয় শিল্পীদের আনছেন, তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। ফলে তারা একের পর এক শিল্পীকে আনছেন।’
বলা হয়ে থাকে, একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পর এ জাতির সাংস্কৃতিক জাগরণের উজ্জ্বলতম উদাহরণ একুশের বইমেলা। গত ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আয়োজিত বাংলা একাডেমীর এবারের বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলো নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. অমর্ত্য সেন। মেলা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একজন ভারতীয়কে বিশেষ অতিথি করায় নানা প্রশ্নের জন্ম হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে বলা হয়, দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়াতে, এ দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রমাণের জন্য ড. অমর্ত্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড. অমর্ত্য নিজেই সাম্প্রদায়িক চেতনার। তার সাম্প্রতিক ‘আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ে ইসলাম ধর্ম বাদ দিয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে।
এবারের বইমেলার এক মাসের আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যা আগে কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে এভাবে হয়নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ফসল বাংলা একাডেমীর বইমেলার পুরো মাসের আলোচনা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথকে বিষয় করায় নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেননা, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আলোচনা করতে আমন্ত্রণ জানানো হয় কলকাতার অনেককে। একই বিষয়ে এদেশে বিশেষজ্ঞ থাকলেও তাদের মধ্যে অনেকে আমন্ত্রণ পাননি।
একাডেমীর দাবি, রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ বিষয় নির্ধারিত হয়। মেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানাতে গত বছরের ২ ডিসেম্বর একাডেমীর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এর পরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুলকে নিয়ে একইভাবে পুরো মাসের আলোচনা অনুষ্ঠান করবেন কি-না?’ প্রশ্নটার উত্তর দেননি তিনি। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে চলছে রবীন্দ্রবন্দনা। রবীন্দ্রনাথের নাটক মঞ্চায়নে, তাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র বানাতে আর্থিক সহায়তা দিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নতুন একটি প্রকল্প নিয়েছে। শিল্পকলা একাডেমী এ প্রকল্প পরিচালনা করছে। অথচ জাতীয় কবি নজরুলকে নিয়ে এরকম প্রকল্প সরকারের নেই। নজরুল এখন চরম উপেক্ষিত। অভিযোগ আছে, ভারত সরকারের চাপে সরকার এ প্রকল্প নেয়।
গত ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাত্র সাতদিন পর আর মর্মান্তিক বিডিআর বিদ্রোহের দ্বিতীয় বার্ষিকীর আগ মুহূর্তে ঢাকায় ‘ডেসটিনি গ্রুপ ট্রাইনেশন বিগ শো’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত হয় ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে উদ্দেশ্যমূলক কনসার্ট। অনুষ্ঠানটি করা হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সঙ্গে মানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য। শো’র টিকিটের দাম রাখা হয় দুই হাজার থেকে দুই লাখ টাকা। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষা চর্চার পরিবর্তে বলিউডের শিল্পীদের এনে হিন্দিগান পরিবেশন গর্হিত কাজ।’
অন্যদিকে একাত্তর সালে স্বাধীনতা লাভের চল্লিশ বছর পূর্ণ হয় এবার। এ উপলক্ষে সরকারি, বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে মার্চ মাসজুড়ে। এর মধ্যে অনেকের অনুষ্ঠানের তালিকায় ছিলেন ভারতীয় শিল্পীরা। এমনকি সরকারি প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমী ও ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ধিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’ মিলেও ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান করে। এ দু’প্রতিষ্ঠানের যৌথ আয়োজনে গত ৪ মার্চ শিল্পকলা একাডেমীতে ছিল ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী বিদ্যা শাহ, ১৮ মার্চ পণ্ডিত যশরাজের সঙ্গীত সন্ধ্যা। তারা ঢাকার বাইরেও অনুষ্ঠান করে।
আওয়ামীপন্থী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর গণসঙ্গীত উত্সবে গত ২৮ মার্চ শিল্পকলা একাডেমীতে, ৩১ মার্চ বিয়াম মিলনায়তনে ছিল ভারতীয় শিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের অনুষ্ঠান। গণসঙ্গীত শিল্পী না হলেও সরকারকে খুশি রাখা, ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার পথ আরও বিকশিত করতে তাকে আনা হয়। স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ভারতীয় শিল্পী ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলা বাদন আয়োজন করে সরকার সমর্থক একটি জাতীয় দৈনিক। গত ১৯ মার্চ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শিল্পীদের সংগঠন ‘কিরাত’র উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারি-২ এ আয়োজিত হয় চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক মৈত্রীর সেতু স্থাপন এ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য বলে আয়োজকরা জানান।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত দুই বছর তিন মাসে শতাধিক ভারতীয় সঙ্গীত, অভিনয়শিল্পী এ দেশে কনসার্ট করে। এ সময়ের মধ্যে কতজন এসেছে, এর ঠিক পরিসংখ্যান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েও নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে অভিজাত ক্লাবগুলো ভারতীয় শিল্পীকে আনলেও তা গোপন রাখেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লুকোচুরি করে শিল্পীদের আনা হয়। ট্যাক্স ফাঁকি দিতে আয়োজকরা এ লুকোচুরি করেন। অভিজাত ক্লাবগুলো ভারতীয় আইটেম গার্ল, ডিজিটাল জকিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেন অনুমতি ছাড়া। সে দেশের শিল্পীরা এদেশে আসছে। কামিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক বৈষম্যের মতো সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। সুস্থ সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে এ ধরনের এক তরফা, যথাযথ অনুমতি ছাড়াই ভারত থেকে শিল্পীরা আসছে। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে তারা। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত বলিউড কিং শাহরুখ খানের ‘কিং খান লাইভ শো ইন ঢাকা’য় অংশ নিয়ে শাহরুখ পান কোটি কোটি টাকা। তিনি কোনো ট্যাক্স দেননি বলে জানায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র।