বাংলাদেশে করোনা দাপটের সময়কাল ইতিমধ্যে দুই মাস অতিক্রম করেছে। এই দুই মাসে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের সাথে সচেতনতার দ্বন্দ্ব কোনো প্রজাপতি রাত ধরে হেঁটে যাওয়া গোধূলীর বিষণ্ণতার মত মনে হয়েছে। এই দুই মাসে অসংখ্য পরিবর্তনের ছায়ায় উঠে এসেছে আমাদের অসহায়ত্ব। বিগত কয়েক বছর ধরে ওয়াক্তের নামাজ না পড়ে শুধু জুম্মা আর ঈদের নামাজ পড়া আমি গত দুই মাস ধরে শুধু ওয়াক্তের নামাজ পড়ি, জুম্মার নামাজ পড়া হয়নি… ২৭শে রমজানের পর অদ্ভুত এক নীরবতা, নেই কোন আয়োজন, নেই কোন ব্যস্ততা। রমজান মাসের আবেগ শেষ হয়ে দরজায় কড়া নাড়তে থাকা আগামীকাল ঈদ যেন শুধুই ক্যেলেন্ডারের পাতা্য ঝুলতে থাকা আরো একটি দিন! জীবনের প্রতিটি ঈদই কোন না কোন ভাবে ভিন্নতার রঙে রঙিন ছিলো, কিন্তু এই ঈদ এখন পর্যন্ত আমার জীবনের বিবর্ণতার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
পরিবারের সবাইকে ছাড়া একাকী এই ঈদ আমার ঘরের জানালা দিয়ে গড়িয়ে পড়া নরম রোদের আলোয় একটি বিমুর্ত বিকেলের ছায়া। এই বিকেলে নেই জীবন আর জৌলুশের বিজ্ঞাপনের নিয়ন আলোর ঝলসানি, আছে শুধু স্রষ্টার আমোধ শক্তির ঘোষণা।
অথচ আজ মৌনতা বাঁধ ভাঙার কথা ছিলো,
উল্লাস আর উচ্ছ্বাসের হুংকারে ক্লান্তির সাথে মুগ্ধতার সখ্যতার কথা ছিলো,
নৌকার পালের মত আমাদের মেঘমালা জড়ো করার কথা ছিলো,
কিন্তু আমরা, সব ভুলে ব্যাকুল তৃষ্ণায় পড়ে আছি জড়ো চঞ্চলতায়।
বৃষ্টিহীন বিকেলে সম্পর্কের স্নিগ্ধতায় আমরা হতাম সিক্ত নীলাম্বরী,
সমস্ত বিকেল জুড়ে মমতার শিহরণে সময়টা বাঁধতাম অন্যরূপে,
নিবিড় অভিসারে ভীতু কম্পনে জ্বালতাম সংকোচের আগুন,
অতচ আমরা আজ অদেখা উত্তাপে হারাচ্ছি ষ্পর্শের মুহূর্তগুলো অনন্ত মহাকালে।
ব্যাঙাচির জীবনচক্রের মত ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর কৃষ্ণ গহব্বরে জলমগ্ন আমরা –
প্রতিদিনের পথে পথে মাকড়শার জাল পায়ে জড়িয়ে
ভুলে থাকার যুদ্ধে তুমি, আমি, আমরা এবং আমাদের এই বেঁচে থাকা,
হয়তো বেঁচে আছি তাই মায়েদের মুখ এখনও সাঁজে রঙিন স্বপ্নের আঁচলে।
ভুলে থাকার যুদ্ধ – হোসেন মৌলুদ তেজো
জীবনের অসংখ্য একলা বিকেলগুলো কেটেছে ভরপুর কোলাহলে। কখনও কখনও নিজের একাকীত্বই সমৃদ্ধ করেছে কবিতার ডায়রিটাকে। কিন্তু এই বিকেল সব এলোমেলো গল্প আর শব্দ বুনোটের মেল… একটা ভারী দীর্ঘশ্বাসে ভর দিয়ে ভাবনার স্রোত বিপরীতমুখে ঠেলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা।
সাধারণত ২৭শে রমজানে আমরা সবাই বাড়ির উদ্যেশে রওয়ানা দেই। আক্ষরিক অর্থে আম্মার ঈদের শুরু তখন থেকেই। এই লম্বা পথের পথচলায় জড়ো হতে থাকে অসংখ্য ছবির গল্প। কয়েক জোড়া চোখের নিরলস অপেক্ষা – ছোট ছোট স্বপ্নের ক্যানভাস আঁকে। প্রজন্মের এই মিলনমেলার ভাষাহীন মুগ্ধতা ঈদের আনন্দকে ছাপিয়ে যেতো অনেকটুকু। পৃথিবীর নিয়মে, চক্রাকার এ মানব জীবনে গতকালের সন্তানরা আজকে পিতামাতা। একটা সময় ছিলো যখন আমাদের ঈদ মানে ছিলো অপেক্ষা। এই আনন্দের উপলক্ষ জীবনের প্রয়োজনে রুপ বদলেছে পাল্টেছে উৎসবের ধরণ, তবে উদযাপনের আবেদন এখনও অমলিন।
ঈদের দিন সকালে সবার আগে গোসল করে নামাজের জন্য রেডি থাকেন আমার বড় ভাই। মোটামুটি সময়মত রেডি হতেন আমার বাবা আর আমার ছোট ভাই – আর আমি, অফফ এতো সকালে ঘুম থেকে উঠা, তারপর গোসল করা, তারপর আবার বাইরে যাওয়া! শুরু হতো আব্বার ডাকাডাকি – কোন রকম নামাজটা শেষ করেই যেনো মুক্তি! এই ঈদের সকাল পুরোটাই মুক্ত, কিন্তু অনুভূতিগুলো কেম্ন যেনো বন্ধী। এই মুহুর্তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “একটি কথা” কবিতার কথা খুব মনে পড়ছে আমার। অনুভূতির এই আস্ফালনে কেনো যেনো মনে হচ্ছে সুনীল ঠিকই বলেছিলেন “বালির নিচে বালিই ছিল” – হয়তো সবসময়ই থাকে।
একটি কথা বাকি রইলো থেকেই যাবে
মন ভোলালো ছদ্মবেশী মায়া
আর একটু দূর গেলেই ছিল স্বর্গ নদী
দূরের মধ্যে দূরত্ব বোধ কে সরাবে।
ফিরে আসার আগেই পেল খুব পিপাশা
বালির নিচে বালিই ছিল, আর কিছুই না
রৌদ্র যেন হিংসা, খায় সমস্তটা ছায়া
রাত্রি যেমন কাঁটা, জানে শব্দভেদী ভাষা।
বালির নিচে বালিই ছিল, আর কিছু না
একটি কথা বাকি রইল, থেকেই যাবে।
একটি কথা – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
একদিন আমি, তুমি, আমরা সবাই এই মহামারী জয় করবো। করোনাকালীন সময়ে দূরে আর কাছে, সকলে বা একাকীত্বে ভালো থাকি সবাই। আমরা আবার আমাদের শেকড়ে ফিরে যাবো, স্পর্শে আর আনুভবে সম্পর্কের গল্পগুলো আবারও ডালপালা ছড়াবে। বালির নীচের বালি সরিয়ে আমরা বের করে আনবো আমাদের সেট কাঙ্ক্ষিত জীবনচক্র। বিবর্ন এই ঈদ আয়োজনে করোনা হয়ে থাকুক স্রষ্টার আমোঘ শক্তির সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০২০ বিকাল ৫:০৮