মিজারুল কায়েসঃ এক দাম্ভিক আওয়ামী কুটনিতিকের নাম
এই লোকটাকে সরাতে এতো দেরি হলো কেন ? নাকি তার আওয়ামী জোর খুব শক্ত ?
প্রথমবারের মতো আয়োজিত তিন দিনের গার্ল সামিটে অংশ নিতে ২১ জুলাই লন্ডনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী। তার ঠিক আগের রাতে তাড়াহুড়ো করে কর্মস্থলে ফেরেন মিজারুল কায়েস।
তবে তার স্ত্রী রয়ে গেলেন ইটালিতেই, যিনি ‘দরিদ্র বাংলাদেশিদের জন্য তহবিল’ সংগ্রহের কথা বলে লন্ডনে একটি অননুমোদিত ওয়েবসাইট চালান।
এই দম্পতির ইটালি যাত্রার ঠিক আগেই মিজারুল কায়েস তিন দিনের সফরে আয়ারল্যান্ড ঘুরে আসেন।
যুক্তরাজ্য মিশনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানান, প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাজ্য সফরের ঠিক আগে আট দিন কর্মস্থলের বাইরে ছিলেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার, একজন জ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রদূতের জন্য যা খুবই অস্বাভাবিক।
অবসরপ্রাপ্ত একজন জ্যেষ্ঠ রাষ্ট্রদূত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ ধরনের সম্মেলনের আগে প্রচুর কাজ থাকে।
“প্রধানমন্ত্রীর এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি সফরের আগে আগে এতোদিন নিজের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে একরকম ইতিহাসই গড়লেন হাই কমিশনার কায়েস।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ গত বেশ কিছুদিন ধরে শূন্য রয়েছে। ডেপুটি হাই কমিশনারের পদটি বর্তমানে খালি। সৌদি আরবে বদলির আদেশ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগেই লন্ডনের দায়িত্ব ছেড়ে গেছেন আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
সেই সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেন, “সরকারপ্রধানদের এ ধরনের সফরের আগে দুই দেশের কর্মকর্তাদেরই নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত সময় কাটে। আর একটি দেশে একজন কূটনীতিকের মেয়াদে সরকারপ্রধানের এ ধরনের সফরে দায়িত্ব পালনের সুযোগ একবারের বেশি আসে না।”
তাহলে মিজারুল কায়েসের মতো একজন রাষ্ট্রদূত, যিনি ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বে ছিলেন, কেন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন না? ওই সময়ে তার আয়ারল্যান্ড বা ইটালি সফর কি এতোটাই জরুরি ছিল?
প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে মিজারুল কায়েসকে যুক্তরাজ্য থেকে তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ব্রাজিল মিশনে বদলি করার কথা জানানো হয়, যিনি ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে লন্ডনে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন কূটনীতিক পদত্যাগ করতেন, এমন নজীরও বিশ্বে রয়েছে। কিন্তু কায়েস তা করেননি।
সম্প্রতি সরকারি নিরীক্ষায় লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচের ক্ষেত্রে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা এবং মিজারুল কায়েসের ক্ষমতার অপব্যবহার ধরা পড়ে।
মহা হিসাব নিরীক্ষকের দপ্তরের ওই নিরীক্ষা নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
ওই অভিযোগ ওঠার পর একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আমি অবাক হচ্ছি, কায়েসকে কেন দেশে ডেকে পাঠিয়ে তদন্তের মুখোমুখি করা হচ্ছে না?”
২০১২-২০১৩ অর্থবছরের চূড়ান্ত নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডন মিশনে অনিয়মের বিষয়ে উত্থাপিত ৫৭টি আপত্তির মধ্যে ৪৭টির বিষয়েই কোনো সন্তোষজনক উত্তর নিরীক্ষকরা পাননি।
হাইকমিশনের আর্থিক ব্যয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে সরকারি বিধি লঙ্ঘন এবং অনুমোদন ছাড়া ব্যয় করা বিপুল অংকের টাকা ফেরত নেয়ারও পরামর্শ দেয়া হয় প্রতিবেদনে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনার বিষয়ে কায়েস ‘যথেষ্ট উদ্যোগ নেননি’ বলেও সমালোচনা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, লন্ডনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ মিশনের হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হয়েছেন কায়েস।
লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কর্মসূচি ঠিক করতে সরকারকে মিশনের বাইরে থেকেও সহায়তা নিতে হয়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
খোদ হাই কমিশনের এক কর্মকর্তাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফরের সময় সেখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই কর্মকর্তা বলেন, “তিনি (হাই কমিশনার) কাজটি করতে পারেননি।”
বর্তমানে পাঁচ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। আর নতুন হাই কমিশনার দায়িত্ব নেয়ার আগে সেখানে বাংলাদেশ মিশনের শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন মিশনের কনসুলার আজিম আহমেদ।
গত সোমবার লন্ডন থেকে টেলিফোনে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, কায়েস গত ১৭ জুলাই রোমে এক সভায় যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পৌঁছানোর আগের রাতে লন্ডনে ফেরেন এবং প্রধানমন্ত্রী লন্ডন ছাড়ার পর ওই সভার সমাপনীতে যোগ দিতে আবার রোমে ফিরে যান।
মিজারুল কায়েস ২ অগাস্ট লন্ডনে ফিরতে পারেন বলেও আজিম আহমেদ জানান।
“তিনি (হাই কমিশনার) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। এখন আমরা তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখছি। ফলে প্রশাসনিক ও নিয়মিত কাজে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”
আজিম আহমেদ জানান, মিজারুল কায়েস ইন্টারন্যাশনাল সিভিল সার্ভিস কমিশনের (আইসিএসসি) সভায় যোগ দিতে রোমে গিয়েছিলেন।
অবশ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, কায়েস পররাষ্ট্র সচিব থাকার সময় ওই জাতিসংঘ গ্রুপের সদস্য হয়েছিলেন। এখন সচিবের দায়িত্বে না থাকলেও নিজের উদ্যোগে তিনি আইসিএসসির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গঠিত স্বাধীন সংগঠন আইসিএসসির ওয়েব সাইট ঘেঁটে দেখা যায়, এর সদস্যরা নিজ নিজ উদ্যোগেই এর সঙ্গে জড়িত থাকেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ইটালিতে অবস্থানরত মিজারুল কায়েসের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি ভয়েস মেসেজ পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
মিজারুল কায়েস এখন ‘ব্যক্তিগত ছুটিতে’ আছেন বলে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাই কমিশনার কায়েস মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়েই আসিএসসির সভায় যোগ দিতে রোমে যান।
তবে এ বিষয়ে এর বেশি কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
এদিকে এতোসব অনিয়মের অভিযোগের পরও কায়েসকে দেশে ডেকে না পাঠিয়ে বদলি করায় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে।
মিজারুল কায়েসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ায় বিএনপিও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
এক সময়ের পররাষ্ট্র সচিব এবং বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর মতে, কায়েসের এই ‘সাদামাটা বদলি’ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
“এত সব অভিযোগের পরও কেন তাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্রাজিলে পাঠানো হলো, তা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকারের উচিৎ ছিল, এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে দেশে তলব করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।”
কায়েসের বদলি নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘অর্ণব’ নামে একজন মন্তব্য করেছেন, “মিজারুলকে অবশ্যই উপযুক্ত সাজা দিতে হবে। সরকার এ ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে- আমরা তা দেখতে চাই।”
‘আখতার শাহ’ নামের আরেকজন পাঠক লিখেছেন, “গার্ল সামিটে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফরেই তার (কায়েসের) কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেছে ।”
‘জুয়েল’ নামে একজন মন্তব্য করেছেন, “একজন হাই কমিশনার তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন- বিষয়টা অদ্ভুত। সরকারের এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।”
সূত্র- Click This Link