১০ লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা ॥ বিষফোঁড়া
০ রোহিঙ্গারা তাকিয়ে শেখ হাসিনার সফরের দিক্রে’৭৮ সালে জিয়ার আমলে আসা শুরুÑ বেশি আসে খালেদার আমলে
০ হিযবুত তাহরীর, জেএমবি, জামায়াত, আল কায়েদাসহ অনেক জঙ্গী সংগঠন কাজ করছে
০ রামুর বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নেয়
০ খালেদার জনসভা বড় করতে যোগ দেয়
এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে জিইয়ে রয়েছে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে জীবন বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে আসা রোহিঙ্গা সমস্যা। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে বছরের পর বছর অবস্থান করতে থাকায় সরকারের জন্য এটি একটি বিষফোঁড়ার মতো হয়ে আছে। এক সময় মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করে এ দেশে অবস্থানের সুযোগ দেয়ার পর বিষয়টি এখন জটিল এক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের এ সব রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনদের বিরাট একটি অংশ এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে এক ধরনের অবৈধপন্থার স্থায়িত্বের দাবিদার হয়ে গেছে। সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করার সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে প্রয়োগ করা না হলে এ দেশে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তা অনুমান করাও মুশকিল।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে মিয়ানমার সরকার এগিয়ে আসবে কিনা, সেদিকে গভীরভাবে অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশের কূটনীতিকসহ উৎসুক মহল। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃতীয় বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে সোমবার সকালে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে পৌঁছেছেন। সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমারে এটি দ্বিতীয় সফর। এ সফরের প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন সে দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের নাগরিক এ সব রোহিঙ্গাদের সে দেশে ফিরিয়ে নিতে আহ্বান জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে টেকনাফ-উখিয়া সীমান্ত এলাকাসহ কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা এবং গোটা দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে মিয়ানমারের নাগরিক প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। যদিও সরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা কক্সবাজার-বান্দরবানে ৪ লক্ষাধিক বলে দাবি করা হয়ে থাকে। সমস্যার সমাধানে কালক্ষেপণের কারণে ক্রমাগতভাবে এদের বংশবিস্তার ঘটছে এ দেশে। বর্তমানে এরা শুধু কক্সবাজার অঞ্চলেই নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভাষা, চেহারা, চালচলন, আচার ব্যবহার, খাদ্যাভাসসহ প্রায় সব কিছুর সঙ্গে মিল রয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। ফলে এদের শনাক্ত করাও এখন কঠিন এক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, তারা তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবে। আবার কখনও কখনও রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিক নয় বলেও বলা হয়ে থাকে। কখনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে, কখনও সে দেশের সামরিক জান্তার দমন-নিপীড়নে উপায়ান্তর না দেখে আবার কখনও ভাগ্যান্বেষণে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকজন ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেই চলেছে। এদের একটি অংশ সীমান্তে চোরাপথে সীমান্তরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আয় রোজগার করে আবার ফিরে যাওয়ারও ঘটনা রয়েছে। তবে এ ধরনের সংখ্যা খুবই কম। অত্যাচারিত নিপীড়িত সর্বহারা শরণার্থী হয়ে এ দেশে অনুপ্রবেশ-কারীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের একটি গোষ্ঠী সন্ত্রাস, জঙ্গীপনাসহ বহু ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। একশ্রেণীর এনজিও ও জঙ্গী-গোষ্ঠীগুলোর নেপথ্য সহযোগিতায় এরা বাংলাদেশ থেকে নিজ দেশে অর্থাৎ মিয়ানমারে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক। আবার মিয়ানমার সরকারের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলোও এদের ফিরিয়ে নেয়ার পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। ফলে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে বাংলাদেশ সরকার বড় ধরনের সমস্যায় রয়েছে। সঙ্গত কারণে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার মিয়ানমার পৌঁছেই সে দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, সর্ব প্রথম ১৯৪২ সালে জাপান-ব্রিটিশ যুদ্ধের সময় রোহিঙ্গারা ব্রিটিশের পক্ষে থাকায় জাপানী সৈন্যদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে চলে আসে। ১৯৬৫ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় জাতিগত দাঙ্গার কারণে মুসলমানদের রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন সীমান্ত অতিক্রম করে এ দেশে চলে আসা শুরু করে। এর পর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের বিএনপি সরকারের আমলে (১৯৭৮) সালে এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া সরকারের আমলে সীমান্ত পেরিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গার আগমন ঘটে, যা এখনও বিক্ষিপ্তভাবে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তরক্ষী বিজিবি জওয়ানরা প্রতিদিন ওই সব রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছে। বিএনপি সরকারের আমলে মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ে দফায় দফায় বৈঠক শেষে বেশ কিছু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। ওই সময় একাধিক মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠী, রোহিঙ্গা জঙ্গী ও কতিপয় এনজিও সংস্থার প্ররোচনায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ছেড়ে লোকালয়ে মিশে যায়। জামায়াত-শিবিরসহ একাধিক মৌলবাদী গোষ্ঠী ওই সব রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন কর্মকা-ে ব্যবহারের জন্য কৌশলে এ দেশের নাগরিক বলে দাবি করতে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। ওই সব রোহিঙ্গারা বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের বিস্তৃত সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১৯৯১ সালের শেষদিকে প্রায় ২ লক্ষাধিক (বেসরকারীভাবে প্রায় ৪ লাখ) রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলেও সরকারী হিসাব মতে প্রায় ২৭ হাজার রোহিঙ্গা স্বদেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়াও টেকনাফের লেদা এবং উখিয়ার কুতুপালং আন-রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে অবস্থান করছে। আবার কক্সবাজার শহরে স্থায়ীভাবে এবং বিভিন্ন ভাড়াবাসায় বসবাস করছে অন্তত ২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ওই সব অবৈধভাবে অবস্থান ও বসবাসকারী রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করেছে ১৯৯৪ সালে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের আমলে। কিছু দিন আগে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ঘোষণা দিয়ে বলেছে রোহিঙ্গা নামে কোন গোষ্ঠী সে দেশে নেই। তবে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় ও বাংলাদেশ এ অভিযোগ মানতে নারাজ। আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী উল্লেখ করে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট তাদের দেশান্তর করার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে জামায়াত-বিএনপি, আরএসওর জঙ্গীরা ও স্বার্থান্বেষী মহল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়ার প্ররোচনা দেয়া শুরু করে।
একাধিক সূত্র জানায়, গত বছরের ৩ জুন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা-রাখাইন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পেছনে জঙ্গী গ্রুপ আলকায়েদা, জামায়াত ও আরাকান বিদ্রোহীদের সম্পৃক্ততা এবং দুটি এনজিও সংস্থার প্রতিনিধিদের ইন্ধন ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি অশান্ত করে তুলতে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসররা আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের নেতাদের পরামর্শে মিয়ানমারে বিদ্রোহী রোহিঙ্গাদের দিয়ে কাহারিপাড়া বার্মিজ স্কুলের শিক্ষিকা রাখাইন মহিলাকে বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে তুলে নিয়ে জঙ্গলে পালাক্রমে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে। এ ঘটনায় গত বছরের ৫ জুন মিয়ানমারের লুণ্ঠিন বাহিনী-পুলিশ মংডু থেকে আলকায়েদা বিদ্রোহী গ্রুপের পাঁচ জঙ্গীকে আটক করেছিল। সূত্র আরও জানায়, জামায়াত-শিবির ও একাধিক জঙ্গী গ্রুপের কতিপয় নেতা টেকনাফ-উখিয়ার দুটি শরণার্থী শিবির ও বস্তিতে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এখনও গোপন বৈঠক চালিয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত নেতাদের মদদে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ অন্তত ৪ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখনও। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো ওই সব রোহিঙ্গাদের দেশে থাকতে দেয়া কোন লাভ নেই বলে মতপ্রকাশ করেছেন সচেতন মহল।
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ও টেকনাফের লেদা এলাকায় বন বিভাগের কয়েক শ’ একর সংরক্ষিত পাহাড় দখল করে মিয়ানমারের প্রায় ১ লাখেরও বেশি অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বসবাস করছে। ওই সব অবৈধ রোহিঙ্গারা এখন তাকিয়ে আছে প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরের দিকে। এরা এভাবে আর বাংলাদেশে থাকতে চায় না। ফিরে যেতে চায় নিজ দেশ মিয়ানমারে। এদের এখন একটাই দাবি, হয় নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নতুবা এখানে শরণার্থীর মর্যাদা দেয়া। এ সব রোহিঙ্গারা অবৈধ অনুপ্রবেশ করে আসার পর থেকে বসবাসের জন্য প্রায় ১০ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে পাহাড় কেটে তৈরি করেছে ৯ হাজারেরও বেশি ঝুঁপড়ি ঘর। এদের দেখাদেখি নতুন করে আসা রোহিঙ্গারাও আশপাশের পাহাড়ে জড়ো হচ্ছে। সর্বশেষ গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে রোহিঙ্গা জঙ্গীরা নারকীয় হামলা চালিয়েছে বৌদ্ধবিহার ও পড়ুয়াপল্লীতে। মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা এ দেশের খেয়ে আবার এ দেশের বিরুদ্ধেই নানা ষড়যন্ত্রসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ওপর বার বার ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল আওয়ামী লীগের অর্থাৎ বর্তমান সরকারের ওপর থেকে সংখ্যালঘুদের সমর্থন ফিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা।
প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গাদের আশা ॥ বিশাল বস্তির হাজার হাজার রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার সফর করছেন। রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ মনে করছে তাঁর এ সফরে বাংলাদেশের এতবড় রোহিঙ্গা বোঝার স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে একটা কূলকিনারা হবে। হাজার হাজার রোহিঙ্গায় ঝুঁপড়িতে বন বিভাগের বিশাল এলাকা ভরে গেছে। এ সব পাহাড়ে কোন গাছ নেই, নেই ঝাড়ঝোঁপ ও জঙ্গল। মাটির ঘর তৈরির জন্য নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বন বিভাগের উখিয়া বন রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে কুতুপালং পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে প্রায় দেড় শ’ একরের মতো বনভূমিতে প্রায় ৯ হাজার ঘরবাড়ি তৈরি করে ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এর পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি পাহাড়ে বাস করছে আরও ১৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করা বন বিভাগের স্বল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে কোন মতেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। পাহাড় দখল করে বসবাসকারী বিশাল অঙ্কের রোহিঙ্গা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এটা বন বিভাগের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এটি রাষ্ট্রীয় সমস্যা। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ে লেখালেখি করেছি।
১০ লাখ রোহিঙ্গা ॥ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবৈধভাবে বসবাস করছে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকায় বনাঞ্চল উজাড় করে গড়ে উঠেছে অবৈধ রোহিঙ্গা বসতি। পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, মূল্যবান বনজসম্পদ উজাড় করে আশঙ্কাজনক হারে গড়ে ওঠা ওই সব বস্তিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- ও রোহিঙ্গা নারীরা পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ছে। আশির দশকে আসা রোহিঙ্গারা বর্তমানে উখিয়া টেকনাফ এলাকায় জনপ্রতিনিধিত্ব করাসহ স্থানীয়দের সঙ্গে আত্মীয়তা ও বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রশ্রয় পেয়েছে বেশির ভাগ। অথচ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সরকারীভাবে নিষেধ রয়েছে। ওই সব রোহিঙ্গারা ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আলিশান দালান তৈরি করে স্থানীয় হিসেবে বসবাস করে চলছে। এমনকি অনেক রোহিঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে বসবাস করায় বাংলাদেশী দাবি করে জাতীয় সনদও সংগ্রহ করে নিয়েছে।
জামায়াতীদের রোহিঙ্গা প্রীতি ॥ কক্সবাজার ও বান্দরবানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এবং আরাকান বিদ্রোহী সংগঠনকে আগে থেকে সশস্ত্র সহায়তা প্রদান করে আসছিল মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নেতাকর্মীরা। টেকনাফ-উখিয়ায় আশ্রিত মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ ওই মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় নিষিদ্ধ ঘোষিত আরএসও, আরএনও, এআরএনও, এআরইউ, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন হরকত-উল জিহাদ, হিযবুত তাহ্রীর, জেএমবি, আলহারামাইন ও আল্লার দলসহ অসংখ্য সংগঠনের সদস্যরা জামায়াত-শিবিরের গোপন অপতৎপরতার সঙ্গে লিপ্ত রয়েছে বলে সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মৌলবাদীদের ওই ঐক্যটা ধরে রাখতে রামুতে বৌদ্ধবিহারে ধ্বংসযজ্ঞের পর বেগম জিয়ার সমাবেশে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গা জমায়েতের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। পরে ওই সময় তাদের সেই ফন্দি নস্যাত করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।
বৈধ রোহিঙ্গা ॥ কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে ১ হাজার ২২০ পরিবারের মোট ১০ হাজার ৭৭৭ জন রোহিঙ্গা ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে ১ হাজার ৭৫৫ পরিবারে মোট ১৫ হাজার ৩৭৮ জনসহ মোট ২৬ হাজার ১৫৫৫ জন শরণার্থী প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে সোমবার জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ জালাল উদ্দিন।
নাগরিক দাবি ॥ ৩৬ বছর পূর্বে আসা রোহিঙ্গারা বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করছে। তারা বাংলাদেশী ভুয়া ঠিকানায় পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করে চলছে। ওদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা সুবিধাভোগী কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কারণে জাতীয়তা সনদ পেয়েছে ওরা। আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি বলেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। চিহ্নিত ওই সব আশ্রয়দাতারা বরাবরই পার পেয়ে যাচ্ছে। এতে স্থানীয় সচেতন মহল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বিবাহবন্ধন ॥ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশীদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সরকারীভাবে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তা মানছে না স্থানীয়দের অনেকেই। রোহিঙ্গা ললনাদের গৃহবধূ করে তুলে নিচ্ছে তাদের বসতগৃহে। ভাসমান ওই সব রোহিঙ্গাদের হাতে নিহত হয়েছে এ দেশের বহু নাগরিক। মাদক বিক্রি, পতিতাবৃত্তি এমন কোন অপকর্ম বাদ নেই, যা রোহিঙ্গারা করে না। তাদের কারণে নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে কোমলমতি শিক্ষার্থী ও যুব সমাজের। বিশেষ মহল ও জনপ্রতিনিধি কর্তৃক আশ্রয়ে লালিত-পালিত এ সমস্ত রোহিঙ্গারা পর্যটন সম্পদও ধ্বংস করছে। প্রশ্রয়দাতা মৌলবাদী গোষ্ঠীসহ অবৈধ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদান বা গণদাবিতে পরিণত হয়েছে এখন।
শরণার্থী আইন মানে না রোহিঙ্গারা ॥ আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন অনুসারে শরণার্থীদের আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করতে হয়। কোথাও যেতে হলে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু রোহিঙ্গারা অনুমতির তোয়াক্কা করে না। তাদের ওপর যেন কারও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এদের হাতে স্থানীয় হাজার হাজার বাসিন্দা জিম্মি হয়ে পড়েছে। স্থানীয় কিছু সরকারদলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে উৎকোচের মাধ্যমে ম্যানেজ হয়ে তাদের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করে চলছে বলে জানা গেছে। ফলে দূষণ ও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে পরিবেশ। অবৈধ বসবাসকারী বিশাল অঙ্কের এই রোহিঙ্গা নিয়ে সচেতন মহলও উদ্বিগ্ন। অনুপ্রবেশকারী ওই রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের পরিবেশ বিষিয়ে উঠছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চায় স্থানীয়রা।
প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ, ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই থেকে ৭ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে দুটি শিবিরে আশ্রিত শরণার্থী প্রত্যাবাসন কার্যক্রম। ১৯৭৮, ১৯৯১, ১৯৯২ ও ১৯৯৪ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ও প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে বিপুলসংখ্যক মিয়ানমার নাগরিক থেকে যায় এ দেশে। আবার প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গারাও ফের অনুপ্রবেশ করে এ দেশে। কক্সবাজার, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অন্তত ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। ১৯৭৮ সালে বিএনপি শাসনামলে প্রায় ৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আসে বাংলাদেশে। তখন প্রত্যাবাসন ফাঁকি দিয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা পরিবার থেকে যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ১৯৯২ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন অবস্থায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি শরণার্থী। এর মধ্যে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন শরণার্থী প্রত্যাবাসন হলেও একাধিক মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ফের তাদের বেশিরভাগ রোহিঙ্গা চলে আসে এ দেশে।
অবৈধ রোহিঙ্গারা বসবাস করছে যেখানে ॥ কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনার ডেল, টুইটার টেক, নুনিয়াছড়া, ফিশারিঘাট, পেশকারপাড়া, বড়বাজার, মাঝেরঘাট, রোমালিয়ারছড়া, আলীরজাহাল, এসএমপাড়া, টেকপাড়া নতুন ব্রিজ, বিডিআর ক্যাম্প (বিজিবি) চৌধুরীপাড়া, সাহিত্যিকাপল্লী, পাহাড়তলী, হালিমাপাড়া, জিয়ানগর, নতুন জেলখানা এলাকা, ঘোলদীঘিরপাড়, বৈদ্যরঘোনা, ক্যাংপাড়া, কলাতলীর বড়ছড়া, খুরুশকুল, পিএমখালী, ঈদগাঁও, ইসলামাবাদ, ভারুয়াখালী, চৌফলদ-ি, ইসলামপুর, পোকখালী ও জালালাবাদ এলাকায় অবৈধ রোহিঙ্গারা বসবাস করছে।
রোহিঙ্গা কারা ॥ রোয়াইঙ্গা থেকে রোহিঙ্গা। রোয়াং হচ্ছে বর্তমান মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোসাঙ্গ এলাকা। আর এই রোসাঙ্গ রাজ্যই হচ্ছে বর্তমান মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ। রোসাঙ্গ, রোহাঙ্গ বা রোয়াং অঞ্চলের এ মুসলিম জনগোষ্ঠী চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের মানুষের কাছে রোসাইঙ্গা, রোহাইঙ্গা, রোয়াইঙ্গা বা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। বর্তমানে এ নামটি পৃথিবীর মানুষরা রোহিঙ্গা নামে চিনে। মিয়ানমারে (বর্মা) বসবাসকারী এক জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। তারা যে দেশে থাকে বা যে দেশ থেকে আসে তার নাম রোয়াং। অস্বীকার করার উপায় নেই, মুখের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক কিংবা আত্মীয়তার কারণে রোহিঙ্গা ও কক্সবাজার জেলাবাসীর মধ্যে বেশ মিল রয়েছে।
Click This Link