পার্ব্বত্য চট্টগ্রাম রণক্ষেত্রে তিব্বতীয় কমাণ্ডোরা
প্রাক-কথন:
ইন্দো-চীন যুদ্ধের পর এবং ১৯৬২ সালের শেষের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর 'রিসার্চ এন্ড এ্যানালাইসিস উইং' (RAW)-এর জোর প্রচেষ্টা ও লবীর কারণে তৎকালীন নেহেরু সরকারের নির্দেশে গঠন করা হয় এলিট কমান্ডো ইউনিট যার প্রাথমিক গোড়াপত্তন হয়েছিল তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা'র সাথে সে দেশে পালিয়ে আসা যোদ্ধাদেরকে নিয়ে। চুসি গ্যাংদ্রাগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে খামপাসদের রিক্রুটের ভেতর দিয়ে এই নয়া ইউনিটের জন্ম। নেতারা ওই উন্নয়নমুখি প্রস্তাবে খুব দ্রুতই সাড়া দেন এবং সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং পরবর্তীতে ইউনিটের কার্যক্রম ও সাজ-সরঞ্জাম দেখে এও আশা প্রকাশ করেন যে, ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতের স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্থাৎ নিজের কাজেই লাগানো যাবে। এব্যাপারে 'ইন্ডিয়ান এক্সটারনাল ইন্টেলিজেন্ট সার্ভিস'(RAW), 'সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (CIA)', এবং 'চুসি গ্যাংদ্রাগ'-এর মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। তিব্বতের তিনজন টপ লিডারের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত ও ভারতে প্রবাসী দু'জন যথাক্রমে জেনারেল গনপো তাশি ও জাগো নামগিয়াল দর্জি যারা আগে থেকেই ভারতে মুসতাংভিত্তিক একটি গেরিলা বাহিনীর সদস্য সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিলেন, এরাই পরে চুসি গ্যাংদ্রাগ-এর পক্ষে বাহিনীর সর্বময় দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৫,০০০ সদস্য বিশিষ্ট এই পাহাড়ী গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় দেহরাদুন-এ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও RAW-এর সরাসরি অপারেশনাল কমান্ডের অধীনে গঠিত হয় এই 'স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স' (SFF), চীনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকি মোকাবেলার কাজে এটি প্রথম সমবেত গোপন ইন্টেলিজেন্স ও কমান্ডো হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই বাহিনীর প্রাথমিক প্রশিক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন CIA-এর প্যারামিলিটারি অফিসাররা এবং ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (IB)-এর নিজস্ব স্পেশাল অপারেশন্স ইউনিট - স্পেশাল সার্ভিস ব্যুরো (SSB)। দু'বছরের প্রশিক্ষণ শেষে এই SFF বাহিনীকে পরিপুর্ণ প্রশিক্ষিত এয়ারবোর্ণ বাহিনী হিসেবে নিবেদিত মাউন্টেইন ও জাঙ্গল ওয়ারফেয়ার ইউনিট হিসেবে প্রতিস্থাপন করা হয়। SFF-এর আরো বেশি সুখ্যাতি ছড়ায় যখন এর প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব পড়ে "এস্টাবিলিশমেন্ট ২২" এর ওপর, কেননা এর ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন মেজর জেনারেল সুজন সিং, ব্রিটিশ আর্মির লিজেন্ডারি ফিগার মিলিটারি ক্রস প্রাপ্ত, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে ২২তম মাউন্টেইন রেজিমেন্ট'র কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন, আরো ছিলেন আফ্রিকায় লং রেঞ্জ ডিজার্ট স্কোয়াড্রনেরও সেনাপতি।
যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামাদি:
অস্ত্রশস্ত্র: IMI 5.56mm Tavor Assault Rifle, 5.56mm AK-105, Colt M4A1 Carbine, HK MP5 A3 Sub-Machine Gun, Sig-Sauer 7.62mm SSG3003 sniper rifle, Steyr 5.56mm Scout Tactical Rifle , IMI 9mm Uzi SMG, FN Minimi 5.56mm LMG, Glock17, Glock19, Shipon AT Rocket Laucher , Steyr M1A1 9mm Pistol.
ট্রান্সপোর্ট: The Indian Air Force's Sarasawa based 117 Helicopter Unit '' Himalyan Dragons '' provides airlift capability with its HAL Advanced Light Helicopter (ALH) and Mi-17ShIV Transport Helicopters.
-----------------------
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতীয় কমান্ডো বাহিনী: একটি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস
সে যাইহোক, এই SFF অবশ্য কখনো তাদের জাতশত্রু চীনের রেড আর্মির বিরুদ্ধে কোনো অপারেশনে জড়ায় নি। তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে এই বাহিনীকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ইস্টার্ণ ফ্রন্টে অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করা হয়।
সে বছরের অক্টোবরের শেষে এবং নভেম্বরের শুরুর দিকে ফোর্সের ৩,০০০ সদস্যের এক বিগ্রেডকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামে পাঠানো হয় টাস্কফোর্স হিসেবে। পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে এবং তৎকালীন ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ অনুরোধেই মূলতঃ SFF-কে নিয়ে আসা হয় সেখানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরত মুক্তিবাহিনীকে তারা প্রশিক্ষণ দেয়, বর্ণিত বাংলাদেশী যুদ্ধ "অপারেশন মাউন্টেইন ঈগল"-এ SFF সদস্যরা অত্যাধুনিক বুলগেরিয়ান একে-৪৭ রাইফেল থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি কারবাইনও ইস্যু করে। তাঁরা পার্ব্বত্য চট্টগ্রামে কাপতাই বাঁধ ও অনেক ব্রীজ এবং অন্যান্য সকল ধরনের যোগাযোগমাধ্যম ধ্বংস করা সহ বহুসংখ্যক মিশনই পরিচালনা করে, বাহিনীর ইন্সপেক্টর জেনারেল (IG) ও মেজর জেনারেল সুজন সিং মনেপ্রাণে কামনা করছিলেন যে তাঁরা শেষপর্যন্ত চট্টগ্রামেই প্রথম বিজয়-কেতন ওড়াবেন; কিন্তু পরে তারা অনুধাবন করলেন যে, এটা তাদের জন্যে সুবিধাজনক হবে না, কারণ SFF সদস্যদের পাশে আর্টিলারি শক্তি কিংবা এয়ারলিফট্ দেবার মত বিমানবাহিনীর সাপোর্ট পাওয়ার তেমন আশা নেই। তিন সপ্তাহ ধরে সীমান্ত এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ চলার পর SFF-এর ৬টি ব্যাটেলিয়ানকে ৩টি সাবগ্রুপে জড়ো করে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তারা বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করেন। এই তিব্বতীয় সৈন্যরা ভারতীয় বিমান বাহিনীর কাছ থেকে ৪টি Mi-4 হেলিকপ্টার ধার নেয়। তারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ৯৭ স্বাধীন বিগ্রেডের একটি বৃহৎ অংশকে যেখানে যে অবস্থায় ছিল সেখানে সেভাবেই আটকে রাখে, দুর্ধর্ষ ২য় ব্যাটালিয়ন মায়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সবগুলো ডিফেন্স লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তিব্বতীয় সেনাবাহিনীর বিচারে তাদের প্রথম বিগ্রেডিয়ার জেনারেল বা First Dapon সেই যুদ্ধ SFF Task Force-এর অংশ হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্র সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেন।
পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের অধিনায়ক লে.জেনারেল এএকে নিয়াজী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পন ও যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে স্বাক্ষর করা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে SFF বাহিনী তাদের ৫৬ জন সদস্যকে হারায় এবং আরো ১৯০ জন আহত হয়। যুদ্ধের পর ভারত সরকার তিব্বতের প্রবাসী এই সেনাদলের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শৌর্যময় অংশগ্রহণ ও অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দুঃসাহসী অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৫৮০ জন সদস্যকে নানা অভিধায় পুরস্কৃত করেন।
কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একবার সেইসব কমান্ডো নেতাদের ডেকে নেন এবং এবং যুদ্ধজয়ে তাদেরকে ধন্যবাদ জানান - যা ছিল নিতান্তই বিষয়ভিত্তিক বা শ্রেনীভুক্ত, কাগজপত্রে যার কোনো উল্লেখ নেই । বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর বা তৎপরবর্তী আর কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দলই সেই তিব্বতীয় অতিথি সেনাদলের ত্যাগ-তিতীক্ষা ও প্রাণবিসর্জনের বিপরীতে বিন্দুমাত্র সহমর্মিতাও প্রকাশ করেনি। এব্যাপারে একটি তিব্বতীয় ওয়েবসাইট www.tibetwrites.org লিখেছে, "The new country’s founder, Sheikh Mujibur Rahman, personally called the SFF leaders to thank them for their part in that creation. But this had been a classified mission – one that, officially, still does not exist. As such, none of the SFF fighters have ever been decorated, nor have their contributions ever been officially recognized." বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধে অনেক বিসর্জনের ভেতর দিয়ে সেসব গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অদ্যাবধি অকথিতই রয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবার মতন বিজয়দীপ্ত গৌরবের পাশাপাশি এই বেদনাদায়ক উদাসীনতা চিরকালের জন্য এক বিরাট অকৃতঘ্নতার নিদর্শন হয়ে থাকবে বৈকি!
অন্যদিকে গোটা '৭১ সাল জুড়েই গণপ্রজাতন্ত্রী চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অবজ্ঞা করেছে, স্বীয় স্বার্থে পাকিস্তানকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করেছে এমনকি স্বাধীনতাপরবর্তীকালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদলাভের প্রস্তাবনায় ভেটো দিয়েছে। চীনের এই বিরোধীতা কেবল সেখানেই থেমে থাকেনি, স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চীনাসমর্থিত সবগুলো রাজনৈতিক দল (মতিন-আলাউদ্দিনের কমিউনিস্ট পার্টি বা নকসাল, হকের পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি, ন্যাপের কিছু খন্ডাংশ প্রভৃতি মাওবাদী গ্রুপ) মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে, সুযোগ বুঝে তারা পাকবাহিনীর সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছে এবং বহুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে - ঠিক যে কর্মকাণ্ডগুলো করেছিল আজকের জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল। এতোকিছুর পরও চীন এখন আমাদের সেরা বন্ধু হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে, বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের বিশাল বাজার এখন চীনের দখলে; এদেশের নেতা-নেত্রীরা সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে চীন সফরে যেতে যতোটা আহলাদিত হন, তিব্বতের নাম যেন তাঁদের কাছে ততোটাই অপাঙ্কতেয়! আর পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে-পর্ব্বতে, হয়তো কোনো গভীর অরণ্যে, দিকচিহ্নহীন কোনো গিরিখাতের মাটিতে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন কোনো তিব্বতী কমাণ্ডো - যার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কথা কেউ কোনোদিন স্মরণ করবে না। সত্যিই আমরা কী বিচিত্র!
সূত্র:
-http://www.militaryphotos.net
-http://en.wikipedia.org/wiki/Sino-Indian_War
-http://en.wikipedia.org/wiki/History_of_Tibet
-http://www.tibetwrites.org/?Not-their-own-wars
-http://www.friendsoftibet.org/articles/india.html