অনেক অনেকদিন আগের কথা।
খ্রিস্টপূর্ব ৫১ অব্দে, বসন্তের কোনো এক সময় রোম সম্রাট টলেমি অলেতিস মারা গেলেন আর তার বিশাল সাম্রাজ্য স্বীয় কন্যা আঠারো বছর বয়স্কা ক্লিওপেট্রা ও তার বার বছর বয়স্ক পুত্র টলেমি-১৩কে উইল করে দিয়ে গেলেন। ক্লিওপেট্রার জন্ম হয় ৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে। ক্লিওপেট্রার বয়োজ্যোষ্টা আরও দু’বোন ছিল, ক্লিওপেট্রা-৬ আর বেরেনিস; আর ছোটবোনের নাম আরসিনো-৪। ছোট আরও দু’ভাইও ছিল যথাক্রমে টলেমি-১৩ ও টলেমি-১৪। মনে করা হয়, ক্লিওপেট্রা-৬ ছোটবেলায় মারা যান, আর বেরেনিস কোনো কারনে ছিলেন অযোগ্যা। সম্রাট টলেমি অলেতিসের মৃত্যুর সময় রোমান নেতা পম্পে-কে দায়িত্ব দিয়ে যান রাজ্য ও একইসাথে তার সন্তানদের দেখাশোনা করার জন্য।
এই টলেমি অলেতিস বংশগতভাবে প্রায় দু’শতাব্দিকাল ধরে মেসিডোনিয়ার শাসনকর্তা ছিলেন। আস্তে আস্তে টলেমি বংশের শক্তি ও ক্ষমতা কমে আসছিল আর অন্যদিকে রোমের শাসকদের ক্ষমতা যেন দিন দিন বাড়ছিল। একের পর এক যুদ্ধে টলেমি পরাজিত হচ্ছিলেন রোমানদের কাছে কিংবা নিদেনপক্ষে সন্ধি করে আসছিলেন যা ব্যাতীত তার আর কিছুই করার ছিল না। এভাবে এক সময় মিশরও রোমানদের শাসনাধীনে চলে আসে। তখন তাদের খাজনা দিয়ে দখলের হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা হয়। টলেমি অলেতিসের অনুপস্থিতিতে যেন রাজবংশের পতনের ঘন্টাধ্বনিই বেজে উঠলো।
তখনকার মিশরীয় আইনে ক্লিওপেট্রার একজন আপন সঙ্গী থাকা বাধ্যতামূলক ছিল যে কিনা স্বামী, ভাই বা পুত্র যে কেউ হলেই চলতো। কাজেই তাকে তখন তাকে বিয়ে করতে হয় তারই আপন ছোটভাই টলেমি-১৩কে, যখন তার বয়স সবেমাত্র ১২ বছর। কিন্তু, ক্লিওপেট্রা ক্ষমতায় বসে কিছুদিনের মধ্যে যে কাজটি করলেন তা হচ্ছে, প্রচলিত মুদ্রার ওপর থেকে টলেমি-১৩’র ছবি তুলে দিলেন, সমস্ত অফিসিয়াল কাগজপত্র থেকেও তার নাম বাদ দিয়ে দিলেন অবজ্ঞা করে। কিন্তু আইনে ছিল দ্বৈতশাসনে পুরুষের নাম থাকবেই এবং তা নারীর উপরে থাকবে। এভাবে ক্লিওপেট্রা নিজেই নিজেকে দেশব্যাপী বিস্তর সমালোচনার মুখোমুখি দাঁড় করালেন। সাইপ্রুস, কোয়েলি-সিরিয়া ও সিরেনাইকা বহিঃশক্তির দখলে চলে গেল। রাজ্যময় অরাজকতা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো, দেশে দেখা দিল চরম খাদ্যাভাব। যদিও ক্লিওপেট্রা ছিলেন মানসিকভাবে অত্যন্ত শক্তিধর মেসিডোনিয়ান রানী যার সুন্দর স্বপ্ন ছিল যে নিজ দেশকে তিনি আরও ভালো করে গড়ে তুলবেন, আরো বৃহত্তর পরিসরে তিনি রানী হবেন। ধীরে ধীরে তিনি সেরকমটিই হতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বিগত দিনের ন্যায় অন্যান্য হেলেনিয় রানীদের মতই তিনি ছিলেন একটু নরম মেজাজের যে কিনা ভালবাসার পাত্রী, দুর্বল চরিত্রের নারী। যে কোনো মূল্যে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া রক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলেন।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার তিন বছরের মাথায়, তার কিছু কিছু কৃতকর্মের জন্যে আলেকজান্দ্রিয়া কোর্ট থেকেও সতর্কতা মূলক বিজ্ঞপ্তি হাতে পেলেন। যেমন, পার্থিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধরত সিরিয়ার গভর্ণররের দুই পুত্র যখন সাহায্য প্রার্থনা করতে ক্লিওপেট্রার দরবারে আসেন তখন জেনারেল থিওডোরাস-এর নেতৃত্বে তার কিছু সেনা অফিসার তার ভাই বা স্বামীর প্ররোচনায় ওই দুই ভাইকে হত্যা করে বসে। কেননা, তারা জানতো যে, তার ভাইকে হাত করা সহজ এবং তার কৃপায় পরে হত্যাকারিরা কাউন্সিল সদস্য হয়েছিল। এসব দেখে ক্লিওপেট্রা রাজধানী ছেড়ে থিবাইদ চলে যান। টলেমি-১৩ এক ডিক্রি জারি করেন, একমাত্র আলেকজান্দ্রিয়া বাদে কোথাও কোনো খাদ্যশস্য পেরণ করা যাবে না। এখানে ব্যতিক্রম হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়া রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে যেহেতু এটি ছিল মুলতঃ ক্লিওপেট্রার প্রায় নিজস্ব এবং কাছের মানুষদের এলাকা, আর তারা তখন আলেকজান্দ্রিয়ার বাইরে অবস্থান করছিল, যাতে সকলেই বোঝে যে, সেটা টলেমি-১৩’এর বিশেষ করুণা। এই অনুদান যেন ক্লিওপেট্রার ওপর থেকে জনগণের মন উঠে যায় তারই প্রচেষ্টা।
এছাড়া, ক্লিওপেট্রা সে সময় আরব উপজাতীয় অঞ্চলের পেলুসিউম থেকে আর্মি অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন আর বোন আরসিনোকে সঙ্গে নিয়ে সিরিয়ায় গমন করেন।
এসময় (আগস্ট, ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ফারসালুসের যুদ্ধে পম্পে পরাজিত হলেন। পরাজয়ের পর তিনি আলেকজান্দ্রিয়া রওয়ানা দিলেন রানীকে এই বলে বলে বোঝানো উদ্দেশ্যে যে, তিনি আর টলেমি-১৩’র সাথে নেই যদিও তিনিই ছিলেন সিনেট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত বৈধ অবিভাবক। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিনি ভাবতে পারেন নি যে, ফারসালুস তার জন্যে কতটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সে বছর ২৮ সেপ্টেম্বর পথিমধ্যে তিনি নিহত হন এমনকি টলেমি-১৩’র সামনেই।
চারদিন অন্তর ৩ হাজার ২শ পদাতিক ও ৮শ অশ্বারোহী যোদ্ধাসহ বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে জুলিয়াস সিজার আলেকজান্দ্রিয়ায় আগমন করেন।এছাড়াও তার সঙ্গে বারোজন রোমান সরকারের ব্যাজধারী বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত সেনাসদস্যও ছিল। রোমে তখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, এই ১২জন সৈন্য তারই ইঙ্গিত বহন করছিল যার কিঞ্চিৎ ছোয়া আলেকজান্দ্রিয়াতেও স্পর্শ করেছিল।টলেমি-১৩ ছিলেন পেলুসিউম-এ, আর সিজার রাজপ্রাসাদে অবস্থান নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। কিন্তু কয়েকদিন পরই টলেমি-১৩ তার বিশ্বস্ত ইউনুচ, পোথিনুসসহ আলেকজান্দ্রিয়ায় এসে উপস্থিত হন। ক্লিওপেট্রার বাইরের যাওয়ার কোনো হেতু ছিল না। তবুও চোরাইভাবে নিজেকে কার্পেটে মুড়িয়ে শত্রুপক্ষের বেষ্টনী ভেদ করে সিজারের সন্মুখে হাজির হন। সেরাতেই সিজার-ক্লিওপেট্রা জুটিবদ্ধ হয়ে পড়েন আর সিজার ক্লিওপেট্রা-টলেমি দু’জনকেই পরদিন সকালে রাজপ্রাসাদে এসে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে দুত পাঠান। ততক্ষণে টলেমির কাছে সবকিছুই পরিস্কার হয়ে যায় এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে তিনি বিশ্বাসঘাতকদের পাল্লায় পড়েছেন। তিনি রাজপ্রাসাদে ঘাতক বাহিনী পাঠানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সিজারের গার্ডদের কাছে ধরা পড়েন। চিন্তা করা হয় যে, সিজার ক্লিওপেট্রাকে সর্বময় কর্তৃত্ব দিয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার রানী এবং একই সাথে রোমেরও পুতুল-প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে রাখার পরিকল্পনা এঁটেছিলেন।
কিন্তু নভেম্বর মাসে পোথিনুস টলেমির বাহিনীকে যুদ্ধের আহবান জানান এবং হাজার বিশেক লোকজন নিয়ে সিজারকে ঘেরাও করেন। এসময় টলেমির বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর অংশবিশেষ ও কিছু অস্ত্রাগার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তবে সিজার এসব যুদ্ধ দমন করেন, ফারোস বন্দর-বাতিঘর সুরক্ষিত রাখতে সমর্থ হন। ক্লিওপেট্রার ছোটবোন আরসিনো রাজপ্রাসাদ থেকে নিরাপদে পালিয়ে অ্যাকিলাসের কাছে গিয়ে আশ্রয়লাভে সমর্থ হন এবং নিজেকে মেসিডোনিয়ার রানী বলে ঘোষণা দেন যা আলেকজান্দ্রিয়ার ঘাতক ও সৈন্যরাও সমর্থন জানায়। কিন্তু আরসিনোর এই তৎপরতাকে ক্লিওপেট্রা ক্ষমা করেননি। যুদ্ধ চলাকালেই সিজার পোথিনুসকে ফাসি দেন আর অ্যাকিলাস ঘাতক গ্যানিমিডি’র দ্বারা নিহত হন। টলেমি-১৩ বা ক্লিওপেট্রার ভাই বা স্বামী পালিয়ে যাবার সময় নীল নদে ডুবে প্রাণ হারান।
টলেমি-১৩’র মৃত্যুর কারণে ক্লিওপেট্রা-ই হন মিশরের একচ্ছত্র রানী। আর সিজারও নিজের পজিশনকে পুনঃস্থাপিত করেন। কিন্তু আইন অনুসারে ক্লিওপেট্রাকে এখন তার পরবর্তী ছোটভাই টলেমি-১৪কে বিয়ে করতে হবে যার বয়স তখন সবেমাত্র ১১ বছর। এই নিয়ম প্রতিপালন ছিল মিশরের সর্ব্বোচ্চ ধর্মীয় পুরোহিতদের জন্য একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমাধান। সিজার অনেক ঝুঁকি সত্ত্বেও রানীর সম্মেহনীর চাইতেও বেশিকিছু করেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন মিশরের যে বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র রয়েছে সেদিকে হাত প্রসারিত করা রানীর সুদৃষ্টিলাভের চাইতেও বেশি গুরুত্বপুর্ণ। যাহোক, ক্লিওপেট্রার ব্যক্তিগত বুদ্ধিমত্তা ও উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রাজকীয় গুণাবলীও এইক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছিল। আর বলতে গেলে হিসেবের বাইরেই ক্লিওপেট্রা বরঞ্চ একটু তাড়াতাড়িই গর্ভবতী হন কারণ সিজার ভাবছিলেন যতদ্রুত সম্ভব রাজসিংহাসনের একজন যোগ্য উত্তরাধিকার দরকার। সিজার ও ক্লিওপেট্রা একবার দু’মাসের জন্য নদীভ্রমনে বের হন এবং দেনদারা নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করেন আর সেখানেই তিনি মিশরের ফারাওহ্ হিসেবে অভিষিক্ত হন। আর তারও পরে সিজার সিরিয়ায় বাণিজ্যভ্রমনে থাকাকালে ক্লিওপেট্রা তাদের প্রথম পুত্রসন্তান(টলেমি সিজার)’র জন্ম দেন (২৩ জুন, ৪৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)।
পরের বছর, সিজার রোমে ফিরে আসেন। দশ-বছরের একনায়কত্ব দেয়া হয় তৎসহ ব্যাপক সংবর্ধনাও। দু’মাস ব্যাপী সংবর্ধনা চলাকালে ক্লিওপেট্রাও রাজকীয় সফরসঙ্গী হয়ে রোমে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু সংস্কাচ্ছন্ন রিপাবলিকানরা এই একত্র অবস্থানকে চরম দৃষ্টিকটু বলে গণ্য করেন। ক্লিওপেট্রার ব্যক্তিগত সম্মানও অনেকক্ষেত্রে প্রশ্নের সন্মুখীন হতে থাকে।
(ক্রমশ)
----------------------------------
সকল পর্ব:
প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব | তৃতীয় পর্ব | চতুর্থ(শেষ) পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১০ রাত ৩:২৩