নোবেল পুরষ্কারের ১১৮ বছরের ইতিহাসে মাত্র ৩য় মহিলা হিসাবে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করলেন কানাডার University of Waterloo এর পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড।
সৌভাগ্যক্রমে ওয়াটারলু আমার সাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ে; মানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া-লেখা করার সময় আমার অফিস রুম ও গবেষণাগারের পাশে যে একজন ভবিষ্যৎ নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী পদার্থ বিজ্ঞানীর অফিস ও গবেষণাগার ছিলও কোন দিনও জানতে পারি নি। আমার বিশ্বাস ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার কোন দিন ভাবেনি ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড নামে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপক নোবেল পুরষ্কার অর্জন করবে। ভাবলে এত দিনে তাকে পূর্ণ অধ্যাপকক হিসাবে প্রোমোশন দিতো।
ছোটবেলায় পড়েছিলাম চিনের দুঃখ হোয়াংহো নদী; আর মিশরের দুঃখ নীল নদ তেমনি ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক ছাত্র-ছাত্রীদের দুঃখ ছিলও নোবেল পুরষ্কারের লিস্টে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না দেখা; বিশেষ করে কানাডার শীর্ষস্থানীয় ৭ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হিসাবে। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন আমার প্রথম অফিস ছিলও পদার্থ বিজ্ঞান ভবনের ২২০ নম্বর রুম।পদার্থ বিজ্ঞানী ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের অফিস রুম নম্বর হলও ২৫২। প্রতিনিয়ত দেখা হতো বিল্ডিং এর করিডোরে। আমার অফিস রুমের সমানে দিয়ে নিজের অফিস রুমে যেতো; আর তার অফিস রুমের সামনে দিয়ে আমার অফিস রুমে যেতাম।
ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কয়েকজন বৈজ্ঞানিককে ভবিষ্যৎ নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী হিসাবে মনে করা হয় বৈজ্ঞানিক ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড তাদের লিস্টে ছিলেন না। বেশিভাগ বিজ্ঞানী নোবেল পুরষ্কার বিজয়ের অনেক পূর্বে থেকেই বিখ্যাত অধ্যাপক হয়ে থাকেন নিজ-নিজ ফিল্ডে। এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী বলা চলে ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড। ১৯৮৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করার পর থেকই অধ্যাপনা করছেন এর পরেও পূর্ণ অধ্যাপক হিসাবে প্রোমোশন পান নি। ভৌত বিজ্ঞান বিষয়ে লিঙ্গ ও বর্ণ বৈষম্যের অভিযোগ অনেক পুরনো। পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম নোবেল পুষ্কার বিজয়ী মহিলা বিজ্ঞানী মেরি কুরি নিজ দেশ পোল্যান্ডে পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য পড়া-লেখা করতে পারেন নি। ভৌত বিজ্ঞান বিষয়ে লিঙ্গ বৈষম্য কেমন তার প্রমাণ সর্বশেষ কোন মহিলা পদার্থ বৈজ্ঞানিকের নোবেল পুরষ্কার বিজয়ের ৫৫ বছর পরে ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের নোবেল পুষ্কার অর্জন।
ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের জন্ম তার বর্তমান কর্মস্থল ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরের গুয়েলফ শহরে। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেছেন নিজের জন্মস্হল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের অবস্থিত কানাডার বিখ্যাত ম্যাক-মাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় হতে।এর পরে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন আমেরিকার নিউইয়র্ক রাজ্যের রচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পিএইচডি গবেষণার সুপারভাইজার ছিলেন বৈজ্ঞানিক জেরার্ড মৌরু।
ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড যে আবিষ্কারের জন্য পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ২০১৮ সালের নোবেল পুরষ্কার অর্জন করলো সেই আবিষ্কার করেছেন পিএইচডি গবেষণার সময়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলও বৈজ্ঞানিক ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের জীবনের প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধটির জন্যই ২০১৮ সালের নোবেল পুরষ্কার অর্জন।
পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ২০১৮ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ৩ জন বৈজ্ঞানিক। ১ জন কানাডার, ১ জন আমেরিকার ও অন্যজন ফ্রান্সে নাগরিক। ফ্রান্সের যে বৈজ্ঞানিক নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি হলেন বৈজ্ঞানিক ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের পিএইচডি গবেষণার সুপারভাইজার বৈজ্ঞানিক জেরার্ড মৌরু। পদার্থ বিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারের অর্ধেক অর্থ পাবেন আমেরিকান অধ্যাপক ও অবশিষ্ট অর্ধেক অর্থ সমান ভাবে পাবেন ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড ও তার পিএইচডি গবেষণার সুপারভাইজার।
এবারে জানা যাক কি সেই আবিষ্কার যার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত পুরষ্কার অর্জন:
বৈজ্ঞানিক ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড ও তার পিএইচডি সুপারভাইজার লেজার বিষয়ে গবেষণা করে একটি শক্তিশালী লেজার আবিষ্কার করেছেন যা আজ সারা পৃথিবী ব্যাপী মানবকল্যনে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমরা প্রিন্টিং এর জন্য যে লেজার প্রিন্টার ব্যবহার করি তা ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের গবেষণার ফলাফল। চিকিৎসার জন্য যে বিভিন্ন প্রকার লেজার ব্যবহার করা হয় যেমন রক্ত-পাত হীন ভাবে চোখের ছানির (চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্যাটারাক্ট) অপারেশন; লেজারের মাধ্যমে চর্ম ক্যান্সার নিরাময় ইত্যাদি। বৈজ্ঞানিক ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের যুগান্ত করি আবিষ্কারের মহত্ন । নিম্নে বৈজ্ঞানিক ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের জীবনের প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ যার জন্য ২০১৮ সালে নোবেল পুরষ্কার অর্জন সেই প্রবন্ধটির সেই প্রবন্ধটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৩ পৃষ্টা। প্রবন্ধটির ডাউনলোড লিংক দেওয়া হলো : COMPRESSION OF AMPLIFIED CHIRPED OPTICAL PULSES
লেজার লাইট প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছিল ১৯৬০ সালের দিকে। কিন্ত ১৯৮৫ সালের পূর্বে লেজার লাইট মানব কল্যাণে ব্যব হার করা যাচ্ছিল না ব্যাপক ভাবে কারণ উদ্ভাবিত লেজার লাইটের শক্তি ও তীব্রতা ছিলও খুবই কম। ১৯৮৫ সালে লেজার লাইট নিয়ে যে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন ডোনা ও তার সুপারভাইজার সেই প্রযুক্তির নাম Chirped Pulse Amplification বা সংক্ষেপে CPA। নিম্নে একটা চিত্র যুক্ত করা হলও যা দেখে বুঝা যাবে ডোনা ও তার সুপারভাইজার এর আবিষ্কৃত প্রযুক্তি সম্বন্ধে।
CPA প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর থেকে লেজার লাইটের শক্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় (নিচে সংযুক্ত গ্রাফ দেখুন)।
অভিনন্দন বৈজ্ঞানিক Donna Strickland ও ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়।
অভিনন্দন বৈজ্ঞানিক জেরার্ড মৌরু । বর্তমানে ফ্রান্সে গবেষনারত। বয়স ৭৪ বছর।
অভিনন্দন বৈজ্ঞানিক অর্থার অসকিন । আমেরিকার বিখ্যাত বেল ল্যবরেটরিতে কর্মরত ও বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত। বয়স ২ বছর কম ১০০ বছর।
******************* পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ও লিঙ্গ বৈষম্য *********************
পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কয়েকজন মহিলা বৈজ্ঞানিকের নোবেল পুরষ্কার পাওয়া উচিত ছিলও বলে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ঐকমত আছে বা ছিলও; কিন্তু তারা পান নি। শুনে অনেকেই অবাক হবেন যে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম মহিলা হিসাবে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত মেরি কুরি এর নাম ছিলও না পুরষ্কারের লিস্টে প্রথম দিকে। লিস্টে ছিলও তার স্বামী পিয়েরই কুরি ও হেনরি বেকোরেল নামক একজন বৈজ্ঞানিকের নাম। পিয়েরি কুরি নোবেল কমিটির কাছে চিঠি লিখে জানান যে আবিষ্কারের জন্য আমাকে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে সেই কাজটি আমি যৌথ ভাবে করেছি আমার স্ত্রী মেরি কুরি এর সাথে। এই আবিষ্কারের কৃতিত্বের দাবিদার একই ভাবে মেরি কুরিও। সুতরাং নোবেল কমিটি যদি মেরি কুরিকে এই পুরষ্কারের জন্য মনোনীত না করে তবে আমি এই পুরষ্কার নেবো না। অতঃপর নোবেল কমিটি মেরি কুরিকে অন্তর্ভুক্ত করেন ১৯০৩ সালের পদার্থ বিজ্ঞানের পুরষ্কার প্রাপ্তদের দলে। যদিও পরবর্তীতে মেরি কুরি রসায়ন বিদ্যায়ও নোবেল পুরষ্কার পান নোবেল পুরষ্কারের ইতিহাসে একমাত্র বৈজ্ঞানিক যিনি একবার পদার্থ বিদ্যায় ও একবার রসায়ন বিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পান। শুধু তাই না, মেরি কুরির মেয়ে ও মেয়ের জামাইও রসায়ন বিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পান। অর্থাৎ এক পরিবারে ৪ জন নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক।
পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার বঞ্চিত মহিলা বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বৈজ্ঞানিকের নাম হলও ভেরা রুবিন যিনি ২০১৬ সালে মৃত্যু বরন করেন। বর্তমানে নোবেল পুরষ্কার শুধুমাত্র জীবিত বৈজ্ঞানিকদের মধ্য হতেই দেওয়া হয়। মৃত বৈজ্ঞানিকের আবিষ্কার যত বড়ই হউক না কেন তা নোবেল পুরষ্কারের জন্য বিবেচিত হবে না। বৈজ্ঞানিক ভেরা রুবিন "ডার্ক ম্যাটার" নামক অদৃশ্য এক বস্তু আবিষ্কার করেছেন। বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন মহাবিশ্বের ৪ ভাগের ১ ভাগ পদার্থ হলও ডার্ক ম্যাটার।
পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার বঞ্চিত মহিলা বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বৈজ্ঞানিকের নাম হলও জোসিলিন বেল বার্নেল। যিনি "পালসার (a fast-spinning neutron star that emits a bright beam of energy.)" নামক একটি বস্তু আবিষ্কার করেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণার ছাত্রী হিসাবে। যে আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৪ সালে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয় জোসিলিন বেল বার্নেল এর পিএইচডি গবেষণার সুপারভাইজার ও অন্য একজন বৈজ্ঞানিককে সাথে বঞ্চিত করা হয় জোসিলিন বেল বার্নেলকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:০৩