দিনাজপুরের ইয়াসমিন থেকে কুমিল্লার তনু; বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির চরিত্র গত ২১ বছরে কত টুকু পরিবর্তন হয়েছে? ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলও ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ১৯৯৫ সালে বিএনপি সরকারের সময় দিনাজপুর জেলায় পুলিশ সদস্যদের হাতে তরুণী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পরিণতি থেকে যদি শিক্ষা নিতো তবে এই ২০১৬ সালে কুমিল্লার তনু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ধামা-চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতো না আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশ সরকারের পলিসি হলো আমেরিকান সরকারের মধ্যপ্রাচ্য পলিসির মতো; সরকার পরিবর্তন হয় কিন্তু ধর্ষকদের রক্ষায় রাষ্ট্রের চরিত্রের পরিবর্তন হয় না।
খবরে প্রকাশ বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিদের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে সতর্ক করা হয়েছে "কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং কুমিল্লা সেনানিবাসে তার লাশ পাওয়া যাওয়া সম্পর্কে ‘আলোচনা না করতে"
রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ কতটুকু ব্যর্থ সেটা তনু নিজের জীবন দিয়ে আর একবার প্রমাণ দিলেন। আজ থেকে ২১ বছর পূর্বে ১৯৯৫ সালের এ দিনে দিনাজপুরে একদল বিপথগামী পুলিশের হাতে তরুণী ইয়াসমিন নির্মমভাবে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। এ বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিবাদে-বিােভে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের মানুষ। ঘটনাটি সংঘটিত হওয়ার স্হাটি ছিলও আমার স্কুল থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে দশমাইল নামক স্থানে। হাইস্কুল পড়ুয়া ছাত্র হিসাবে আমিও ছিলাম ঐ বিক্ষোভে অংশ গ্রহনকরি একজন। আজকে কুমিল্লা শহরের শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে-মেয়ে ঠিক তেমনি দাঁড়িয়েছিলাম আমরা।
দারিদ্র পরিবারের মেয়ে গৃহকর্মী ইয়াসমিন নির্মমভাবে ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে দ্রুত কোন ব্যবস্হা নিতে পারে নাই দিনাজপুর জেলার পুলিশের কর্তা ব্যক্তিরা; কারণ সেই চিরাচরিত প্রবাদ "কাক কাকের মাংস খায় না"। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দিনাজপুর জেলা থেকে সারা বাংলাদেশে। জনগণকে দমিয়ে রাখতে সরকারের শেষ অস্ত্র কারফিউ জারি করে; কিন্তু দিনাজপুর জেলার বিক্ষুব্ধ মানুষ কারফিউ ভেঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়লে পুলিশ গুলি চালিয়ে ৫ থেকে ১০ এর মতো মানুষ হত্যা করে। ৫ টা লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বাকি গুলো আর খুঁজে পাওয়া যায় নাই। ঐ সময় আওয়ামীলীগ ও জামাতে ইসলামীর নেতৃত্বে সারা দেশে চলছিও তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন। তৎকালীন সরকার পুলিশের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল বিরোধীদলের তত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন দমন করতে। সরকার যেহেতু পুলিশের উপর নির্ভরশীল তাই ইয়াসমিন হত্যার ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচারে ধরি মাছ নাছুই পানি আচরণ করে। প্রবাদে আছে গাধা জল ঠিকই খায় তবে সেটা ময়লা করে। তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ঠিকই দারী পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল কিন্তু সরকার ও দল হিসাবে বিএনপি এর একটা চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। যা আজও বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
কুমিল্লা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা ঘটনার পরে মনে হচ্ছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ২১ বছর পূর্বে যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেই একই পথে হাঁটছে ২০১৬ সালের আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। ইয়াসমিন হত্যার ঘটনা ধামা-চাপা দিতে গিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার চিরস্থায়ী ক্ষতির স্বীকার হয়েছিল সেই একই ক্ষতির স্বীকার হতে যাচ্ছে ২০১৬ সালের আওয়ামীলীগ।
গত ২১ বছরে হিমালয় পর্বতের বরফ গলা পানি পদ্মা-যমুনা-মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ভারত মহাসাগরে মিশেছে কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির আচরণের কোন পরিবর্তন হয় নি। ১৯৯৫ সালে দেশের প্রধান দুইটি দলের নেতা ছিলও মহিলা; ২০১৬ সালে এসে প্রধান ৩ টি দলের নেতাই মহিলা। এমনকি দেশের স্পিকারও মহিলা। সরকারী দলের সংসদীয় দলের উপনেতাও মহিলা। কিন্তু দেশের নারীদের নিরাপত্তা কত টুকু পরিবর্তিত হয়েছে সরকার নারীদের রক্ষার্থে কত টুকু দায়িত্বশীল তার প্রমাণ পেতে হলো তনুর প্রাণের বিনিময়ে।
মাকাল ফল চিনেন? আমি নিশ্চিত মাকাল ফলের নাম শুনেছেন জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে। ফলটা দেখতে বাহিরে থেকে খুই সুন্দর। দেখলেই মনে হয় খেতে এটি নিশ্চয় খুবই মজাদার হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় পদ গুলো ঠিক মাকাল ফলের মতো। অন্যান্য দেশের মানুষরা মনে করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি মনে হয় নারীদের জন্য স্বর্গ; বাস্তবের বাংলাদেশ যে নারীদের জন্য একটি নরক রাষ্ট্র তা অন্য দেশের মানুষ খুব কমই জানতে পারে।
২১ বছর পূর্বে সরকারের আচরণ যা ছিলও ২১ বছর পরেও তাই আছে। শতকরা ১ ভাগও পরিবর্তিত হয় নাই। তখন বিএনপি সরকার বিরোধী দলের আন্দোলনের কারণে অপরাধী পুলিশ সদস্যদের বিচারে আগ্রহী ছিলও না; এই ২০১৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অপরাধের বিচার করতে আগ্রহী না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারের পরিবর্তে পুরস্কৃত করছে। যেমন নারায়গন্জে র্যাবের সদস্যদের ৭ খুনে জড়িত থাকার কথা জানতে পারার পরেও সকল প্রকার আর্থিক সুযোগ সুবিধা সহ সেনা ও বিমান বাহিনীর ৩ সদস্যকে অবসরে পাঠানো। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনারের প্রকাশ্য মন্তব্য "সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে পুলিশ"। ২০১৪ সালের ৫ ই জানুয়ারি নির্বাচনের পূর্বে সেনাবাহিনীকে ৪ টা মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স উপঢৌকন দিয়ে জন গনের মেন্ডেট ছাড়াই আগামী ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার লাইসেন্স অর্জন করেছে। সেনাবাহিনীর প্রধানের ভাইকে সাজানো ভোটে মেয়র নির্বাচিত করে সেনাবাহিনীর প্রধানকে পুলিশ বাহিনীর প্রধানের মতো রাজনৈতিক ভাবে পরিচালিত করার ব্যবস্হা করেছেন।
বেসামরিক মানুষ হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষের বিচারের ক্ষমতা নাই; সেনাবাহিনীর কাছে আমাদের যেটা চাওয়া সেটা হলো আপনরা পুলিশকে এই ঘটনার সত্য উৎঘাটনের সাহায্য করে নিরপেক্ষ ভাবে, কোন রকম আবেগ, অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে। এতে করে আপনাদের সম্মান হানী হবে না বরং সম্মানিত হবেন জনগণের বন্ধু হিসাবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষের জন্য বিশ্বের পরাক্রমশালী আমেরিকান সেনাবাহিনীর একটা উদাহরণ দেই। মাত্র ২ সপ্তাহ পূর্বে আমেরিকার সেনাবাহিনীর একজন চার তরকা জেনারেলকে চাকুরিচুত্য হতে হয়েছে। কারণটা হলো নিজের অফিসে বসে সেই কর্মকর্তা পর্ণ ছবি দেখেছেন। ঐ কর্মকর্তার বিচার করে চাকুরিচুত্য করায় আমেরিকান সেনাবাহিনীর সম্মানহানী হয় নাই বরং এই ম্যাসেজ জনগনের কাছে গিয়েছে যে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে না।
ব্যাচারা হুমায়ুন আজাদের দেখে যেতে পড়লো না বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির সবকিছু পুরোপুরি নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে শতকরা ১ ভাগও অবশিষ্ট নাই।
শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে বলতে চাই "better late than never but never late is better" অথবা, শুভস্য শিঘ্রম! যত দ্রত তনু ধর্ষণ ও হত্যার বিচার শুরু করবেন দল ও সরকারের ক্ষতি তত কমাতে পারবেন।
"আমরা সবাই তনুর ভাই ...তনু হত্যার বিচার চাই " #JusticeForTonu
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৬ ভোর ৬:২৮