আব্বাকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করার কথা ভাবতেই পারিনি কখনো । ‘বাবা’ সম্বোধন করার মত “দুর্বল” বা “নরম” প্রকৃতির ব্যক্তিই ছিলেন না আব্বা ! ভীষণ powerful ছিলেন। সবসময় কথা আর ধমক-ধামক দিয়ে চারিদিক অস্থির করে রাখতেন...একেবারে সরগরম উপস্থিতি বলতে যা বোঝায়। ভীষণ রাগি অথবা রাশভারি মানুষ ছিলেন একসময়। অফিস বা বাসা সবজায়গার মানুষই, বলা যায় একঘাটে পানি খেত আব্বা’র সামনে। ব্যাংকের একজন অফিসার আমাদের দুই ভাইবোনকে অংক দেখিয়ে দিতেন হাইস্কুলের কোন এক ক্লাসে। উনার প্রথম দিনের প্রশ্ন ছিল – “তোমাদের আব্বু তোমাদের সাথে হেসে কথা বলেন”? অথচ আব্বা’র হাসি ছিল যাকে বলে – দিলখোলা ! আব্বা হাসলে পাড়ার সবাই শুনতে পেত ।
আমার মনেই পড়ে না, মেট্রিক পরীক্ষার আগ পর্যন্ত আব্বা’র চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো কথা বলেছি। মেট্রিকের রেজাল্ট দেখে আব্বা খুশি হয়েছিলেন, তখন আব্বা’র চোখে চোখ রেখে সেই খুশি আমিও দেখেছিলাম। যদিও সেই খুশি চলে গিয়েছিল দুইবছর বাদে Inter এর রেজাল্টের পর। Intermediate এর রেজাল্ট বের হওয়ার আগ পর্যন্ত আব্বা আমাকে “আব্বু” বলে ডাকতেন আর সাথে “তুমি” সম্বোধনও ছিল। কিন্তু রেজাল্টের পর “তুমি” সম্বোধন, কোনোরকম দয়ামায়া ছাড়া “তুই”-তে নেমে এল আজীবনের জন্য। ঐ মুহূর্তে তার নীচে কিছু থাকলে আব্বা মনে হয় সেটাই বেছে নিতেন। তো, ঐ রেজাল্টের পর আব্বা’র চোখ থেকে আমার চোখ আর সম্মান দুটোই নেমে গিয়েছিল।
আমাদের বাসার নিয়ম ছিল, মাগরিবের আযান শেষ, সবাই বাসায়। এর অন্যথায় হওয়ার কোন নিয়ম ছিল না। আমার বড় দুই ভাইকে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে দেখেছি। আর বোনদের এর বাইরে যাওয়া – সেই প্রশ্ন মনে না আনাই ভাল। আমাদের সে-ই আব্বা, আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম, আমাকে পুরো স্বাধীনতা দিয়ে দিলেন। রাত আটটায় বাসায় আসলেও মনে পড়ে না বকা দিয়েছেন – যেটা ঘরে ফেরার জন্য আমাদের বাসায় ছিল “অনেক রাত”।
আমি গান গাইতে পারতাম; এই বিষয়টা মা আর বড় ভাইয়া মিলে আব্বা’র কাছে পাড়লেন। সুতরাং আমাকে ভীষণ ভয়ে “অডিশন” দিতে হল আব্বা’র সামনে। ‘বিচারক’ অবশ্য খুশি হয়ে শিক্ষকও রেখে দিয়েছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি গান বা খেলাধুলায় আব্বা বরাবর পজিটিভ ছিলেন। স্কুলে থাকতে আব্বা’র বকা খেলে সকালে গানের রেওয়াজ করতে উঠে গান ধরতাম “এই করেছ ভাল, নিঠুর হে...” খুব মন দিয়ে গাইতাম, পুরো দরদ ঢেলে আরকি। আর পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়াতেই কিনা, যাকে বলে অপার স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছি আব্বা মা’র কাছে – বাসার সবার কাছেই; যেটা আবার সবার ফুটফরমাশ খেটে balance হয়ে যেত ।
ফুটবলে আব্বা’র নেশা ছিল। অনেক ছোট বেলায়, আমরা যখন খুলনায় থাকতাম, মনে পড়ে, অফিস শেষে আব্বা আমাকে নিয়ে স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে যেতেন। বাপ ব্যাটা গ্যালারিতে বসে বাদাম খেতে খেতে খেলা দেখতাম। ওয়ার্ল্ড কাপের খেলা কখনো বাদ যেত না আব্বা’র, সেটা যত রাতেই হোক না কেন। ২০১৪’র ওয়ার্ল্ড কাপের কিছু কিছু খেলাও আব্বা রাত জেগে দেখেছেন।
পড়াশোনা আব্বা’র আজীবনের প্রিয় বিষয় ছিল। ব্যাংকার ছিলেন, আগ্রহের কারনে অফিসের পর পুরোদমে ক্লাস করে, পরীক্ষা দিয়ে হোমিওপ্যাথি পাশ করেছিলেন। ওই ডাক্তারি পড়াশোনার বাইরেও আব্বাকে দেখিনি কখনো বই ছাড়া ঘুমাতে গেছেন। সবসময়ের সঙ্গি - বই। আমাদেরকেও, মুখের সামনে বই থাকলে আব্বা কিছু বলতেন না; সে বই যাই হোক না কেন। কাল পরীক্ষা, আমি গল্পের বই পড়ছি, আব্বা কখনো রাগারাগি করেননি। নির্ভয়ে যে কোন বই-ই পড়তে পারতাম। “লেডি চ্যাটারলিয লাভার” আব্বা’র সামনে পড়েছি, আব্বা একবারের জন্য বাঁকা চোখে তাকাননি।
ধর্ম বিষয়ে আব্বা’র অনেক পড়াশোনা ছিল। অনেক লেখালিখি করতেন। তার মধ্যে কিছু বই আকারে বেরও হয়েছে আর বেশকিছু পাণ্ডুলিপি এখনও আছে। সেগুলোর সবই ধর্ম বিষয়ক, একটি ছাড়া। আব্বা বঙ্গবন্ধুকে অনেক বেশি ভালবাসতেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর অনেকগুলো কবিতা লিখে ফেলেন। সেটাও বই আকারে বের হয়েছে – “নিহত বঙ্গবন্ধু, আহত বাংলাদেশ”। বই নিয়ে আব্বা’র কখনই ব্যবসায়িক চিন্তা ছিল না। আব্বা সবসময়ই বলতেন, “মানুষ যেন লেখা গুলো পড়ে, আমার চিন্তাটা পৌঁছাতে পারলেই হবে”। আমাদের ভাই বোনদের মানুষিকতা তৈরি হয়েছে যেভাবে, তার বেশির ভাগটাই আমাদের মা-বাবা’র কারনে। ধর্ম সম্বন্ধে আব্বা মা’র কথাবার্তা ছিল খুব খোলাখুলি। কখনো অন্ধকার কথাবার্তা শুনিনি। আব্বা সাধারনত ন’টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতেন। কিন্তু রাতে খাওয়ার পর আমি অনেকটা ইচ্ছা করে আব্বাকে ধর্মের বিভিন্ন প্রশ্ন করে জাগিয়ে রাখতাম। সেই আলোচনা কখনো কখনো মধ্য রাত পর্যন্তও গড়াত ।
আব্বা যখন চাকরিতে ছিলেন তখন ঘুমের সময়টা ছিল রাত সাড়ে আটটা। ডায়বেটিক থাকাতে পুরো মিলিটারি জীবন যাপন করেছেন; সবকিছু ঘড়ি ধরা। আব্বাকে দেখেছি, সত্যি সত্যি দাঁড়িপাল্লায় মেপে তারপর ভাত খেতে। ফযরের পর আব্বা বের হয়ে যেতেন, আসতেন সাড়ে সাতটার দিকে, সংগে এত্তো বাজার। সেই বাজার আসত, আগেরদিনের বাজার শেষ না হলেও। আর তখনি মা’র সাথে লেগে যেত। এবং অবধারিত ভাবে মা কখনই পারত না। কারন আব্বা’র একটা কার্যকরী অস্ত্র ছিল – “কই, খাওয়ার সময় তো তরকারি পাই না”। এর উত্তর মা কিভাবে দিবে! সুতরাং আব্বা পরদিন আবার বাজার নিয়ে হাযির।
আব্বা’র একটা বিখ্যাত ডায়লগ ছিল “আমি সুস্থ আছি, সূর্য আমাকে বিছানায় পায় নাই”। অর্থাৎ, মানুষ এতো কেন ঘুমাবে! ভোর হয়েছে, উঠে পরো, কাজ বা পড়াশোনা শুরু করো। কিন্তু আমরা ভাই-বোন কেউই সেই রাস্তার পথিক না। ‘বাটে’ না পড়লে ---- ঘুম এবং ঘুম।
আব্বা আরেকটা কথা বলতেন “কথা বলা একটা art। কথা দিয়ে শত্রুকে বন্ধু করা যায়”। আব্বা’র এই গুণ ছিল। আব্বা তাঁর সারাজীবনই বন্ধু দিয়ে ঘেরা ছিলেন। communication এ master ছিলেন আব্বা । আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, রাজশাহী কিংবা খুলনার পাড়াপ্রতিবেশীদের খোঁজ খবর নেওয়া ছিল আব্বা’র প্রতিদিনের কাজ। খোঁজ নেওয়ার তালিকায় শুধু বন্ধু-বান্ধবরাই ছিল না, তাঁদের ছেলেমেয়েরাও থাকত! কি করে যে পারতেন! অথচ আমরা ভাইবোনরা আব্বা’র অন্য অনেক গুনের মত এই অসাধারণ গুণটাও আয়ত্ত করতে পারি নাই। আমাদের শত্রু আছে কিনা জানি না, তবে বন্ধু সংখ্যা যে কম, সেটা আব্বা এবং আমাদের ফোন বিল পাশাপাশি রাখলেই বোঝা যাবে।
আমি আর অর্ক (বড় ভাইয়ার ছেলে) মিলে প্ল্যান করছিলাম, আব্বাকে একটা সারপ্রাইজ দেব তাঁর পরের বইটা বের করে...প্রচ্ছদও শেষ...মুসা নবী’র উপর। আব্বা নাম দিয়েছিলেন “লাঠি’র মহিমা”। বইটা বের হবে, কিন্তু......
পুরোটাই সংসারি মানুষ ছিলেন। আব্বা’র জীবনটা সেমি-ক্লাসিক উপন্যাস এর মত মনে হয়। চৌহালি’র চরে যখন জন্ম নেন, তখন ঐ অঞ্চল আক্ষরিক অর্থেই ‘মানিক বন্দোপ্যাধায়ের পাড়া গাঁ’। যোগাযোগ, চিকিৎসা, স্কুল, মাথার উপর চালা কিছুই ছিল না। শহরে আসতে আস্ত একটা দিনের পুরোটাই শেষ। আব্বা’র কাছে শুনেছি, একটা স্কুল ছিল, তাও বহুদূরে। যাওয়ার উপায় ছিল নিজের দু’টা পা; আর বর্ষায় নৌকা। দাদি চলে গিয়েছিলেন আব্বা যখন ৩/৪ বছরের। মেট্রিকের রেজাল্ট বের হওয়ার আগে দাদাও নেই; অর্থাৎ মা-বাবা ছাড়া তিন ভাই। চরের জীবন কতখানি অনিশ্চিত আর সংগ্রামমুখর এটা কাছ থেকে না দেখলে বোঝা দুষ্কর। “কালকের রাজা, আজকে ফকির” – এই নাম নিয়ে নাটক-সিনেমা হতে পারে কিংবা হয়ও, কিন্তু এটাই চরের জীবন, চরের প্রাত্যহিক ঘটনা। এক রাত বা এক সপ্তাহে পুরো নিঃস্ব। ...
আব্বা’র এক সেট কাপড় ছিল – ফতুয়া আর পায়জামা, আর একটা গামছা। আব্বা স্কুল করতেন এই পোষাকে। কিন্তু ব্যাপারটা এতো সহজ না। চরাঞ্চল হওয়াতে নদী-খাল পার হওয়া লাগতই। গামছা পেঁচিয়ে, বই আর কাপড় চোপড় এক হাতে নিয়ে আরেক হাতে সাঁতার কেটে খাল বা নদী পার হতেন। পারে এসে আবার পায়জামা ফতুয়া পরে স্কুল। এবং এটা একদিন না...বছরের পর বছর। আমি বহুবার চিন্তা করে দেখেছি,......পারতাম? আমার পক্ষে কি আদৌ সম্ভব ছিল? কী ভীষণ ইচ্ছাশক্তি থাকলে একজন মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব! আর ঐ অঞ্চলে এটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আব্বা যখন মেট্রিক পাশ করেছিলেন, তখন আশপাশের গ্রাম থেকে সবাই দেখতে ভিড় করেছিল। কিন্তু আব্বা’র জন্য মেট্রিকের পরের সময়টা আরও কষ্টের ছিল। বিভিন্ন মানুষের বাসায় ‘জায়গীর’ থেকে পড়াশোনা চালানো। ‘জায়গীর’ প্রথার নিয়মটা এমন – তুমি থাকতে পারবে, বিনিময়ে বাসার ছেলে পেলেদের পড়াতে হবে এবং কিছু ফুটফরমাশ শুনতে হবে। এগুলোর সাথে সাথে আব্বাকে রাখালের কাজও করতে হয়েছে। কলেজ থেকে ফিরে সেইসব বাসায় খাবার না পেয়ে, বেগুণের ‘জাই’ নিজে রেঁধে তারপর খাওয়া এবং দিনের পর দিন পার করা – শুধুমাত্র নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। বলছিলাম না সেমি-ক্লাসিক উপন্যাস? আব্বা’র জীবনে চৌহালি থেকে ব্যাংকের কর্মকর্তা হওয়া পর্যন্ত – এই সাহস আর সংগ্রামের অংশটুকুই যথেষ্ট।
পারিবারিক আড্ডায় আব্বাকে অনেকবার বলতে শুনেছি, খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে, “আমি বেঁচে থাকতে তোদের কোন বিপদ হবে না”। হয়ও নি! আমাদের সবাইকে তাঁর সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। সেখানে ভুল ছিল, মন খারাপ করার মত বিষয়ও ছিল, কিন্তু আব্বা তো ছিলেন মানুষ; আমি সেগুলোকে তেমন করেই দেখি – মানুষের ভুল। ঐ ভুলগুলো না থাকলে আব্বা হয়তো মানুষই হতেন না।
আবেগের দিক থেকে একেবারে বাঙ্গালী ছিলেন। ছেলে পেলের সাফল্যে সব মা বাবার চোখেই পানি আসে; আব্বা তাঁর নাতি নাতনিদের ছোটখাটো সাফল্যেও কেঁদেকেটে অস্থির। দেশ ক্রিকেটে জিতে গেল তো আব্বা’র চোখে পানি, আওয়ামীলীগ ভোটে জিতে গেল তো আব্বা’র চোখে পানি। “কাঁদছেন কেন?” – জিজ্ঞেস করলেই উত্তর “ও তোরা বুঝবি না”।
আমাদের পরিবারে খুব কম মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তার মানে, আমরা কেউই কখনো তেমন অসুস্থ হইনি যার কারনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আমার যা মনে হয় - তার কারণও আব্বা-মা; খুব কড়া না হলেও - নিয়ম বাঁধা জীবন আর আমাদের আব্বা’র চিকিৎসা, যিনি পরিচিত মহলে হাতযশ হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছিলেন ।
পরিবারে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল আমার ছেলে তার ভয়ানক ডাইরিয়ার জন্য আর হয়েছিলেন আব্বা নিজে; যে মানুষটা আমাদেরকে সুস্থ রেখেছেন। আব্বাকে ২০১৪ তেই বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ভর্তি হয়ে প্রতিবার মা’র জন্য আব্বা কান্নাকাটি করতেন। কারন প্রত্যেকবার তাঁর মনে হত আর মনে হয় ফিরবেন না। আমি খুব অবাক হতাম মা’র জন্য আব্বা’র কান্না দেখে। কেননা বাসায় সারাদিন মা’র সাথে ঝগড়া। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এবং সেটা সবসময়ই ওয়ান সাইডেড। মা কখনই পাত্তা পেত না। অবশ্য, আমরা কেউ সামনে থাকলে প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন হত। সেই আব্বা হাসপাতালে ভর্তি হলেই মা’র জন্য কেঁদেকেটে একশা’। তাহলে মা’র জন্য আব্বা’র ভালবাসা ছিল ওটাই – সারাদিন রাগারাগি। আব্বা’র এইগুণ দেখে আমি মোটামুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি, কান্নাকাটির দিক থেকে আব্বা মোটেই ‘পরুষালি’ ছিলেন না!
বয়সের ব্যাপারে আব্বা’র attitude ছিল একটু ভিন্ন। মুখে না বললেও, বিষয়টা এমন – বয়স হয়েছে শরীরের, আমার না। আব্বা’র মনোবল ছিল তুখোড়। ২০১০ এ লিভারে ডাক্তার যখন বলল ক্যানসার, আব্বা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন......“আমিও একটু আধটু ডাক্তারি পড়েছি, ক্যানসার হলে যেসব লক্ষন থাকার কথা ছিল, সেগুলোর কিছুই মেলে না, তাহলে ক্যান্সার হল কী করে!” আব্বা সেটা কখনই মেনে নেননি। শরীরে প্রচুর পানি এসে গিয়েছিল। পা, পেট, মুখ ফুলে গিয়েছিল। সিএমএইচ এ গিয়ে প্রথমবার ৩ লিটার পানি বের করা হল। এটার পর আব্বা ভীষণ দুর্বল হয়ে গেলেন। আমি তখন থেকেই মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছিলাম। এরপর আরও ২ বার একিভাবে আব্বা’র পেট ফুটো করে প্রায় ৬ লিটার পানি বের করা হয়েছে। আব্বা দুর্বল হয়েছেন, কিন্তু খুব বেশি পাত্তা দেন নাই। শরীর কেমন জিজ্ঞেস করলেই আব্বা’র উত্তর ছিল “আল্লাহ যেমন রাখসে, লাখ শুকুর; তোরা কেমন আছিস?”।
আব্বা আর আমাকে “তুমি” সম্বোধন করেননি ঠিকই, কিন্তু আমি যখন বড় হলাম, অর্থাৎ চাকরি-বাকরিতে ঢুকলাম, তখন আব্বা’র সাথে অনেকটা বন্ধু’র মতই সম্পর্ক হয়ে গেল। যে আব্বা’র চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতাম না, সেই আব্বা যখন মা’র সাথে রাগারাগি করতেন, আমি আব্বাকে বুঝিয়ে কিছু একটা বলতাম যেন রাগারাগি না করেন। মেনে নিতেন। সংসারের নানা বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনা করতেন । দেখেছি, সংসারের জটিল সমস্যাগুলোকে সমাধানের জন্য আব্বা সময় নিতেন; বোধহয় Time is the best & finest healer-এর জন্যই ।
নিজের ছেলেমেয়েদেরকে যেমন কড়া শাসনে রেখেছিলেন, নাতি নাতনিদেরকেও রাখতে চেয়েছিলেন; পুরোটা পারেননি – জেনারেশান গ্যাপ । আব্বা’র কাছে পড়াশোনা ছিল ভোরবেলা আর সন্ধ্যার পরের সময়টুকু। কিন্তু এখন তো বাসাবাড়িতে পড়ার সময় শুরুই হয় রাত দশটা বা তারও পর; সেই সাথে ‘সামাজিক যোগাযোগ’ মাধ্যমে ব্যস্ততা, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে গেইমিং – কতরকম আয়োজন – এগুলো তো আবার আব্বা’র হিসাবে ছিল না। সুতরাং রাগারাগি হতই। “কই, আমি তো ওদের পড়তে দেখি না!” – এই অভিযোগ আব্বা’র থাকতই।
আমার ছেলের প্রথম জন্মদিনে আব্বা তাঁর সহজাত অভ্যাসেই একটা কবিতা লিখে বাঁধাই করে নাতিকে উপহার দিলেন । কবিতায় “শত জন্মদিন” আসুক বলে দোয়া দিলেন। আমার ছেলে এর মাহাত্ম্য কতদিনে বুঝবে কে জানে!
আব্বা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন......এটাই সত্য এবং বাস্তব; কিন্তু আমার উপলব্ধিতে এখনো আসলো না! সত্যিই কি নাই? কোথাও কি নাই? এটা তো হতেই পারে না, তাই না আব্বা? মানুষ কি মৃত্যুতে শেষ হয়? সম্ভব? আপনার সাথে বিভিন্ন সময়ে দীর্ঘ আলোচনায় যা শিখেছি বা আমার কাছে, আমার বিচার বুদ্ধিতে অসম্ভবই মনে হয় । আপনি তো আছেন আশপাশে...অন্য রূপে, অন্য কাজে...... ।
সবসময়ের মত আমাদেরকে আগলে রেখেন আর দোয়া দিয়েন। আমরা কেউ তো আপনার মত সাহসী আর কর্মঠ হইনি, দোয়া ছাড়া চলবে কি করে!
ভাল থাকবেন আব্বা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:১৭