বারিককে এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে দেখে হাসি দৌড়ে ঘরে ঢোকে। তার তো এত শিগ্রি ফেরার কথা না! গাড়ি জমা দিয়ে আসতে আসতে সেই রাত নয়টা হওয়ার কথা। আর এখন মাত্র দুপুর বারোটা!
শাশুড়ি মারা যাওয়ার সময় বলে গেছে, আমার বারিককে দেইখে রাইখ বৌমা। শাশুড়ি চলে যাওয়ার পর শ্বশুর ঐ এক বারিক ছাড়া আর কারো সাথেই খুব একটা কথাও কয় না। পাগল কিসিমের ছেলেকে শ্বশুর খুব ভালবাসে। বাপ বেটা সময়ে সময়ে কি সব নিয়ে কথা কয় হাসি বুঝতে পারে না। মারেফতি কথা বার্তাই হবে; জিজ্ঞেস করলে বলে তুমি ওগুলা বুজবা না...।
তোমার কি শরীর খারাপ? হাসি বারিকের মাথায় গলায় হাত দিয়ে দেখে। গা তো গরম না, তাইলে কি হইল! বারিক চোখ বন্ধ করে একপাশে শুয়ে থাকে। নরম গলায় বলে – আজকে আর গাড়ি চালাব না বৌ। মনটা খুবই খারাপ হয়ে আছে।
অনেকদিনের সংসার বারিকের সাথে। হাসি তার স্বামীকে চেনে। একা থাকলে মনটা আরও খারাপ হয়ে থাকবে। কি যেন হয় তার মাঝে মাঝে, একটু ভাব ধরেও থাকে তখন। হঠাৎ হঠাৎ কোন একটা গান সারাদিন ধরে গুনগুন করে।
স্বামী’র এই স্বভাব হাসি জানে। একটু বাউলা কিসিমের। এই স্বভাবটা তার আবার খুব পছন্দের, কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করে না। সংসার করতে গেলে এই স্বভাবকে উৎসাহ দেওয়া যায়? তাকে তো আর সংসার সামলাতে হয় না! ছয়জনের ঘর কিভাবে চলে তা হাসি জানে...। হাসি বারিককে জোর করে নিজের দিকে ফিরায়ে জিজ্ঞেস করে – কি হইসে কও না ক্যান? শুনি, ক্যান চইলা আসলা?
হাসি'র জোরাজুরিতে বারিক মুখ তুলে তাকায়; বৌকে সে এড়াতে পারে না । সব ধরে ফেলে। বারিকও জানে মা যাওয়ার পর বৌটাই সংসারটাকে জ্যান্ত রাখসে...।
বারিক অন্য কোনো দুনিয়ায় তাকায় থাকে যেন। কূল না পাওয়া মানুষ বলে মনে হয় তাকে। নিচু গভীর কোন খাদ থেকে যেন উঠে এসে বারিক আস্তে আস্তে বলে - বৌ, আল্লাহ্ আমাকে তো মাছি, ছাগল, মশা,... জোঁক, সাপ, ব্যাঙ...এইগুলা বানাইতে পারত। তাই না? তখন তুই তো দুই হাতে পিষে মারতে পারতি... তোকেও তো আল্লাহ্ উকুন, উই পোকা, শকুন বানাইতে পারত... আমারে, তোরে আল্লাহ্ যে মানুষ বানাইসে তার পিছনে তো কারন আছে। তাই না? মানুষ মানে তো জানিস – আশরাফুল মাখলুকাত – আল্লাহ’র দুনিয়ায় যা কিছু আছে, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ তারা, আকাশ, বাতাস, ফুল পাখি, ফেরেশতা এমন কি হিন্দুদের দেব দেবতা – তাদের চেয়েও উত্তম হল মানুষ। সেই মানুষের মধ্যেও আবার উত্তম-অধম আছে, তাই না? আমাদের নবী মানুষই ছিলেন রে বৌ, যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ্ এই দুনিয়াই সৃষ্টি করত না। আবার আমরাও সেই মানুষ, সেই রক্ত, সেই চোখ চামড়া, হাত পা......আমরা কি করি আর উত্তম মানুষরা কি করে! বৌ, আজকে লালনের একটা গান শুইনা মনটা উথাল পাথাল হইয়া গেল রে। আমার জন্মটা পুরাটাই বুঝি অকামে গেল...
এখনো সেই ছয় বছর আগের হাসিই লাগে বৌটাকে! সেই আগের মতই ভুরূ তুলে কৌতূহল নিয়েই জিজ্ঞেস করে – কি গান!
বারিকের গলায় সুর আছে দরদও আছে – চোখ বন্ধ করে ভরদুপুরে সে গান ধরে –
“এমন মানব জনম আর কি হবে, মন যা কর ত্বরায় কর এ ভবে।।“
আবার মানুষ হয়ে আসব কিনা ঠিক নাই রে...যা কিসু করার তাড়াতাড়ি করতে কইসে লালন...তাড়াতাড়ি করতে কইসে...
“অনন্তঃ রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই, শুনি মানবের উত্তর কেহ নাই,
দেব-দেবতাগন করে আরাধন জন্মনীতি মানবের।।“ - বুঝলি কিছু বৌ? ভাইবা দেখ, তোর আমার জায়গা কোথায় দিসে আল্লাহ্, আর আমরা কি করি! কি কইরা ঘরবাড়ি পুড়াই! মানুষ হইয়া কি কইরা মানুষরে মারি। ধর্ম নিয়ে কত মারামারি কাড়াকাড়ি করি...
বারিক ঝিম ধরে পড়ে থাকে কতক্ষণ...
“কতই ভাগ্যে হলে না জানি, মনরে পেয়েছ এই মানব তরণী!
বেয়ে যাও ত্বরায় তরী, সুধা রয় যেন ভরা না ডোবে, মন যা কর ত্বরায় কর এ ভবে।।“
কত পুণ্য করসিলামরে...আল্লাহ্ আমারে মানুষ বানায় পাঠাইসে! আমি কি করলাম এই জীবনে! কিছুই তো করা হল না রে বৌ। ভাল কাজ দিয়ে তো জীবনটারে ভরলাম না, শুধু একাই বাঁচলাম...কারো জন্য তো বাঁচতে শিখলাম না...
হু হু করে ওঠে বারিকের সব স্বত্বা...
“এই মানব হবে মাধুর্য ভজন, তাইতে মানুষরূপ গঠল নিরঞ্জন!
এবার ঠকলে আনা দেখি কিনা, অধির লালন তাই ভাবে; মন যা কর ত্বরায় কর এ ভবে।।“
কত নোংরা কাজ করতিসি প্রতিদিন, কত খারাপ চিন্তা করি নিত্যদিন, আমি কি মানুষ হইতে পারলাম রে বৌ? সময় তো শেষ হয়ে যায়!
নিঃশব্দে বারিকের দুই চোখ বেয়ে কান্না ভেঙ্গে পড়ে। হাসি কোন কথা খুঁজে পায় না। শুধু হাত দিয়ে পরম মমতায় বারিকের চোখ মুছে দেয়।
হাসি’র ভিতরও অদ্ভুত এক অনুভুতি কাজ করে। নিজেকে একি সাথে অনেক বড় আর খুব ছোট মনে হতে থাকে।.........তাই তো, আমিও তো একজন মানুষ। যার অবস্থান আল্লাহ’র পরে! সত্যিই...আল্লাহ’র পরেই!
মনে মনে হাসি বলে ওঠে - ও মা গো!
সারা শরীর জুড়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার। কি ভারি দায়িত্ব রে বাপ! জীবনটা কিসে খরচ করতিসি?
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৩:১২