২০০৭ এর জানুয়ারির ১১ তারিখের পর আমাদের দেশে অনেক রকম 'হিরো' জন্মেছিলেন, তাদেরকে আমরা যারা ছোট মানুষ তারা মনের আনন্দে কিছু নামও দিয়েছিলাম, যেমন কিং'স পার্টি, হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ফেউ, বৈঠক খানায় বসে গড়া পার্টি ইত্যাদি। ১১ তারিখের পর পর বেশ কিছু নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছে বাংলাদেশে, সেখানে দেশি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃত অভিনেতাও ছিলেন, তাদের মধ্যে সব থেকে পরিচিত এবং বিতর্কিত আমাদের নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনুস। তাঁর কর্পোরেট বক্তৃতায় ভক্তরা ভক্তিতে গদগদ হন, সুখ স্বপ্নে বুঁদ হয়ে যান - যেন কোন দেবতা এসে তাদের কে অন্য ভুবনে নিয়ে যাচ্ছেন - তো তিনি এসে অনেক চটকদার এবং সংলাপ সম্বলিত নাটক এর dialogue দিলেন, ভক্তরা ছুটলেন পিছে, নতুন ভঙ্গিতে মহল্লায় মহল্লায় পার্টি অফিস খুললেন, ডিজিটাল পদ্ধিতিতে তাঁর আদরের জনগনের মতামত নেবার জন্য, সারাও মিলেছিল, কিন্তু যে 'investment' তার তুলনায় 'return' আসে না বিবেচনায় বিচক্ষণ corporate business man সাথে সাথে decision change করে ফেললেন - না ওটা আমার জায়গা না!
আমাদের জন্য ভেবে দেখার বিষয় রেখে গেলেন তিনি, পার্টি করার ধনুর বাঁকা পণ নিয়ে ব্যস্ত ইউনুস সাহেব বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সেই পরিচিত নাটকীয় ভঙ্গিতে বলেছিলেন এখন আর পিছনে ফেরার পথ নাই, আমি রাজনীতিতে নেমে পড়েছি। হয়তো কোন ঊর্ধ্বলোকের ঈশারায়।
মাইনাস ২ ফরমুলার যখন আবিস্কার হল তখন ২ নেত্রিকে সরে যেতে প্রথম আলোর মতি সাহেবের সাথে উনিও সুর মিলিয়েছিলেন ওদের সরে যাওয়া উচিৎ, নতুন নেতৃত্বের উপর ভার ছেড়ে দেওয়া উচিৎ(কারন ইউনুস সাহেব চিরনতুন এর পক্ষে), একটা পার্টি এতদিনে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি(ইউনুস সাহেব বিস্মিত!), পরিবার কেন্দ্রিক পার্টিতে পরিনত হয়েছে(ইউনুস সাহেব বিরক্ত)... ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ দেখুন ভদ্রলোকের কাণ্ডকারখানাঃ
১। যে মানুষ দেশকে ভালবাসে, যে দেশের জন্য উন্নতি করার স্বপ্ন দেখে সে কখনো, তার পাশে কে দাঁড়ালো না দাঁড়ালো, তার জন্য রাজনীতি করতে এসে আবার পিছিয়ে যায়! পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে এই সিদ্ধান্তের জন্য ইউনুস সাহেব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? ভাল জায়গা হবে না নিশ্চিত।
২। আমাদের রাজনীতিবিদরা পারেনি পরিবারের বাইরে নেতৃত্ব তৈরি করতে, কিন্তু যিনি অভিযোগ করেন সেই ইউনুস সাহেব কি পেরেছেন? বর্তমান চিত্র উত্তর দিচ্ছে পরিষ্কার।
৩। শান্তিতে নোবেল পাওয়াটা নিয়ে আলোচনা করা খুব জরুরি মনে করি না, জানা সময়ের বেশির ভাগ শান্তি নোবেল পুরস্কারই বিতর্কিত, সতরাং ওটাতে নতুন কোন point যোগ করার ইচ্ছা নাই, শুধুমাত্র বলে রাখি, আমাদের এই বাংলাদেশের কোন মানবিক সংকটকালে তাঁকে কাছে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, মনের উপর ভর করে চেষ্টা করুন old memories recollect করতে, পেপার পত্রিকা ঘাঁটুন, youtube এ যান, অনেক খুঁজেও পাবেন বলে মনে হয় না। মনেও করতে পারবেন না কবে থাকে শেষবার সাভারের জাতীয় স্মৃতি সৌধে বা শহিদ মিনারে দেখা গেছে। আর ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে ব্যাপক শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন অথবা ফিরিয়ে এনেছেন - এমন দাবি তাঁর অন্ধ ভক্তও করবে না। তাহলে শান্তিতে নোবেল কেন? উত্তর খুব দুরের হবে।
এদিকে টেলিভিশন এর টক শো গুলোতেও শুরু হয়ে গেছে 'সব গেল সব গেল রব' যেন এই দেশে ইউনুস সাহেব ছাড়া আর কোন আলোচনা নাই। খেয়াল করলে দেখবেন এই so called সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বেশির ভাগই সেই মাইনাস ২ এর পক্ষে অথবা সরাসরি জড়িত। এই group গুলোর বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড় অভিযোগ হল তারা পুরো রাজনীতি বিষয়টাকেই বিতর্কিত করে ফেলেছেন আর রাজনীতিবিদদের কে করেছেন সমাজের সব চেয়ে অপাঙ্কতেও। অথচ তাদের পক্ষে দেশেকে দেবার কিছু নেই কিংবা সেই যোগ্যতাই নেই।
রাজনীতিতে নেমে খাঁটি business man এর মত বুঝে ফেলেছিলেন politics=business=not profitable আর তাই পাত তাড়াতাড়ি গুটিয়ে ভেগেছেন, ন্যাড়া সেজেছেন এবং আর আসবেন না এ পণও করেছেন। টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে এসে ডঃ কামাল হোসেন, হোসেন জিল্লুর রহমান অথবা এম হাফিয, মজাফফর আহমেদ, ব্যবসায়ি আনিসুল হক কিংবা তাদের মত লোকেরা যখন 'দেশের সম্মান গেল, ভাবমূর্তি গেল, মানি লোকের মান গেল' বলে তখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, দেশ যখন ১১ জানুয়ারির পর সম্পূর্ণ অনিশ্চিতের ভিতর ছিল তখন এই 'সুশীল সমাজ' এর প্রতিনিধিরা সব এক জায়গায় একমত ছিল দেশকে রাজনীতি শুন্য করার ব্যাপারে, মাইনাস ২ এর ব্যাপারে। একাট্টা ছিল দেশটাকে চরম রসাতলে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে। তারা কিন্তু কেউ রাজনীতি করতে নামেনি, দেশকে উদ্ধারে কেউ আসেনি। এখন তাদের সমস্ত চেষ্টা ডঃ ইউনুস কে ফেরেস্তার কাছাকাছি কোন প্রানীতে পরিণত করার, যার কোন দোষ নেই এবং যাকে দেখতে হবে আইনের অনেক ঊর্ধ্বে। 'সুশীল সমাজ' এর এই ক্ষতিকারক ভণ্ডামি আমাদের চিনতে অসুবিধা হওয়ার কথা কি?
যে কোন দেশকে এগিয়ে নিতে পারে একমাত্র রাজনীতিবিদরাই, আর কেউ না, আর কারো সে যোগ্যতা নাই, সেই তাদেরকে বাদ দিয়ে কিছু ব্যবসায়ি হঠাৎ দেশপ্রেমিক সেজে দেশ সেবার মহান ব্রতে ব্রতী হলেন, দেশ প্রেমিক হওয়া মোটেই দোষের কিছু না কিন্তু শেষমেষ ডিগবাজি খেয়ে আবার যার যার ব্যবসাতে মনোযোগি হলেন, আপত্তিটা ওখানেই এবং তাদের তখনকার কিংবা এখনকার ভূমিকা নিয়ে আমরা কেন প্রশ্ন করি না? সব দোষ কেন সবসময়ই রাজনীতিবিদদেরই দিই? আমাদের বোধবুদ্ধি কেন এই প্রশ্ন আমাদের মধ্যে জাগায় না?
যার যার জায়াগা থেকে নিজেরা কি দিচ্ছি আমাদের দেশকে? আমরা কতটা সততা দেখাই? ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে সব লোভ সামলে দেশ পরিচালনা আমাদের সমাজে বড় একটা যোগ্যতা মনে করি, সেই কাজ টা এখনও পর্যন্ত এই সরকার অনেকাংশে কৃতিত্বের সাথে করে চলেছে। অন্তত পক্ষে তাদের intention ভাল বলেই ঠাওর হয়। বিতর্ক থাকতেই পারে এ বিষয়ে। থাকাটাও জরুরি, না হলে ঐ যে বললাম ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার কারনে যে কোন সময়েই বিচ্যুতি ঘটা স্বাভাবিক।
আমি জানি না, সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারনে তাদের রাজৈতিক ভবিষ্যৎ কেমন হবে, প্রভুরা মন বেজার করলে অনেক কিছুই হতে পারে, কিন্তু আমি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে না মোটেই, তর্ক থাকতে পারে যেভাবে করা হয়েছে, কিন্তু সিদ্ধান্তে ভুল কিছু আছে কি?
কথাটা শুনতে 'প্রতিশোধ' 'প্রতিশোধ' শোনাবে কিন্তু যদি বলি ডঃ ইউনুস, মাইনাস ২ যখন আপনার মাথায় এসেছিল কিংবা নতুন নেতৃত্বের কথা বলে যখন রাজনীতিবিদদের কে বলেছিলেন সরে যেতে তখন তা অকপটেই communicate করেছিলেন আমাদেরকে, এই কম স্মরনশক্তির জনগণকে আর আজ যখন আপনাকে সরে যেতে বলা হচ্ছে এবং আইন সিদ্ধভাবেই তখন কেন আদালতের দারস্থ হলেন? কেন মায়া কান্না কাঁদছেন ' ভাল' বিদায় পাওয়ার জন্য? এখন কেন আপনার ছোট্ট (দেশের তুলনায় তো বটেই) একটা সংগঠন ছাড়তেই কলিজায় মোচড় দিচ্ছে? রাজনীতিবিদদের 'shoe' তে ঢুকিয়ে দেখুন আপনি আরও অনেক পুরনো, সেকেলে এবং বড় বেশি গড়-ক্ষমতালোভি। শ্রদ্ধায় বসানোর মত আলাদা কোন জায়াগা আমার কাছে আমি পাইনি।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ২:৪৩