যদিও ঘটনাটার ব্যাপকতা বোঝার মত বোধকরি মানসিক বয়স তখনো হয়নি, যখন জানতে পারলাম আমাদের আরো একটা পরিচয় হতে যাচ্ছে, তারপরও অজানা আনন্দে শিহরিত হয়েছি। আমরা বাবা-মা হব, আরো একজন অসম বয়সী বন্ধুর আগমনে খুশিই তো হব। আর সবার মতই নতুন নতুন স্বপ্ন বুনি আর তীব্র উৎসাহে কিন্তু কিছুটা আনাড়ি অভিজ্ঞতায় ডাক্তারের কাছে আসা যাওয়া শুরু করি, রুটিন চেকআপ বলতে যা বোঝায় সেটাই - করে যাই।
তেমনই একদিনে...
......হলুদ ট্যাক্সিগুলো তখনো নতুনই ছিল। ওই দিন আমার স্ত্রীকে অনেক যত্ন করে ঠিক না, বলা যায় অনেক সাবধানে একটা হলুদ ট্যাক্সিতে করে নিয়ে আল্ট্রাসোনোগ্রাফির জন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম। ...বসে আছি অপেক্ষায়। রোগিদের বেশিরভাগই এক্সপেক্টিং মা, প্রায় সবাই আমাদের মতই - স্বামী-স্ত্রী একসাথে। চারিদিকে জোড়া-জোড়া হাসিখুশি মুখ, আমরাও তাদেরই মত।
অপেক্ষার পালা শেষে আমার স্ত্রী ভিতরে গেলেন, বাইরে আমি অনেকটাই নির্ভার অপেক্ষায় সুসংবাদের আশায়। খুব দ্রুতই আমার ডাক পড়ল ভিতরে যাবার।
.........আমি গিয়ে আমার স্ত্রী'র মুখ দেখে চমকে উঠি, ফ্যাকাসে, আতংকিত, সব হারানো মানুষ যেন। একজন সম্পূর্ণ ফ্রাস্ট্রেটেড মানুষের মুখ এমনই হয় হয়ত। আমাদের স্বপ্নের রঙিন সুতো ঘুড়ি হঠাৎ করেই যেন ফুরিয়ে গেল, ছিঁড়ে গেল।
আমি কিছু বলার বা করার ক্ষমতা হারাই। অবিন্যস্ত পায়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। আমাদের চোখ বাইরের অপেক্ষমান সব হবু মা-বাবাদেরকে ঝাপসা করে দেয়।
বাইরে এসে ট্যাক্সির চেষ্টা করতেই আমার স্ত্রী তীব্র তীক্ষ্ণ অভিমানে অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠেন আর সাবধান হওয়া কেন, সিএনজিতেই যাব। ........সিএনজি পেলাম, উঠলাম বাসার পথে। ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছি, পাশে একটা গাড়ি এসে থামতেই ৫ কি ৬ মাসের একটা শিশু (আমাদেরই অনাগত শিশু ছিল কি না সে!...) ছোট্ট টুনটুনি হাতে জানালার কাঁচে আলতো থাবা দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টায়। সে এক অতুলনীয় দৃশ্য! আমরা দুজন কী ভীষন অনিশ্চিত এক পরিচয় সংকটে ঝুলে আছি আর এক শিশু তার সব-তুচ্ছ-করা অবহেলায় আমাদের দিকে হাসি ছুড়ে দিচ্ছে। ঐ দৃশ্যে বুকের ভিতরটা হা হা করে উঠেছিল। ঘটনাটা এখনো আমার কাছে ক্লাসিক মনে হয়। যেন আমাদের বলছে - শুধু শুধু, কোন মানে হয় না, আসব তো আমি!
জটিল জীবনের প্লাস মাইনাসের ভীড়ে সেই ছবিটির এখনো স্থানচ্যুতি হয়নি।
তারপর সময় গেছে, বছর পার হয়েছে, অনেক কান্না আর অনিশ্চয়তা গেছে..........
...আমাদের ছেলে এখন ইশকুলে যায়। অফুরন্ত কথা বলে। খোলা মাঠের মত হাসতে শিখেছে সে। ব্যবহারে জড়তার লেশমাত্র নাই। সহজ বন্ধু সবার সাথে। এখনো সে সত্যি একজন শিশু।................প্রকাশ করি না, কিন্তু পাগলের মত তাকে ভালবাসি আমরা দুজনে। আর সব বাবা-মা'র মতই হয়ত....
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৫