আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি,১৯৮৩ সালের আজকের এই দিনটি বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
এই দিনই স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খানের প্রণিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।যোগ দেয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ আর শিক্ষা সংকোচন-কে ভিত্তি ধরে প্রণিত এই শিক্ষানীতির অন্যতম প্রধান তিনটি ধাপ ছিলঃ
## প্রথম শ্রেণী থেকে আরবি এবং দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক
## বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন খর্ব করা
## শিক্ষার ব্যয়ের ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীর পরিবারকে বহন করতে হবে।
এই যেন আইয়ুবের শরীফ শিক্ষাকমিশনের কার্বন কপি।
৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আলাদা আলাদাভাবে স্বৈরশাসনের প্রতিবাদ করে আসলেও ৮৩ সালের আজকের এই দিনেই সব প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন একসাথে রাস্তায় নেমে আসে।এই দিনটিকে তাই এক অর্থে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী তারুণ্যের প্রথম সংঘবদ্ধ উত্থানদিনও বলা চলে।
অবৈতনিক বৈষম্যহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতির দাবীতে শিক্ষার্থীরা প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে সমাবেশ করে এবং পরবর্তীতে মিছিল নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে স্মারকলিপি পেশ করার জন্য বের হয়। মিছিলের সামনের দিকে ছিল ছাত্রীরা। কার্জন হল এবং হাইকোর্ট এরিয়ায় এসে মিছিলটি কাঁটাতারের ব্যারিকেডের সম্মুখীন হলে সেখানেই বসে পড়ে স্লোগান দিতে থাকে। কিন্তু, এরশাদের পেটুয়া পুলিশ বাহিনী সেখানেই নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর লাঠি,জলকামান,টিয়ারগ্যাস এমনকি পরবর্তীতে গুলিও নিক্ষেপ করে।শিক্ষার্থীরা পুলিশি হামলার মুখে আশ্রয় নেয় শিশু একাডেমীর ভিতরে,সেখানে তখন একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিল।
কোমলমতি শিশুরাও সেইদিন রক্ষা পায়নি এরশাদের পুলিশ বাহিনীর হাত থেকে, গুলিতে নিহত হয় শিশু দীপালি। পুলিশ তাঁর লাশ গুম করে ফেলে।
সমগ্র ঢাকা মহানগর ব্যাপী সেইদিন আনুমানিক ১০ জন নিহত হয়,আহত হয় শতাধিক,চালানো হয় গণগ্রেফতার । নিহত একজন জয়নালের লাশ পুলিশ যেভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েছিল তা আজও তাঁর সেইদিনের সঙ্গীদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এইসব নিউজ যাতে সারাদেশে ছড়াতে না পারে সেই জন্য মিডিয়ার উপর কড়াকড়ি সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়। ১৪ থেকে ১৭ই ফেব্রুয়ারি সারাদেশ ব্যাপী চালানো হয় গণগ্রেফতার। গ্রেফতার হন শেখ হাসিনা,তোফায়েল আহমেদ,আদুল জলিল, আব্দুস সামাদ আজাদ,মতিয়া চৌধুরী,সাহারা খাতুন সহ শীর্ষস্থানীয় অনেক ছাত্রনেতা।
কিন্তু,সেন্সরশিপ ও গণগ্রেফতার ছাত্রজনতাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আবারো রাস্তায় নেমে আসলে শুধু ঢাকা মহানগরেরই অন্তত ৭ জায়গায় শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়,ঢাকর বাইরের পরিস্থিতিতো আরও ভয়াবহ ছিল।ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহবানে গায়েবানা জানাজায় শরীক হন রেকর্ড সংখ্যক ছাত্র জনতা।গণঅভ্যুত্থানের ভয়ে এরশাদ সরকার ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে।অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
সেই থেকে শুরু সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর প্রতিরোধ,যার চূড়ান্ত বিজয় আসে ৯০ সালে এসে।আজ আমাদের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি দাবিদাররা ১৪ ফেব্রুয়ারিকে পালন করে তথাকথিত ভালবাসা দিবস হিসেবে।বাংলাদেশে যার উত্থান আরেক স্বৈরশাসক, ৯৬ এর ডাইনি খালেদার দোসর শফিক রেহমানের হাত ধরে। কবে,কিভাবে সেটা না হয় একটু ইতিহাস পড়ে জানারই আহবান থাকল
এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের বিবেকের,আপনারা ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ছাত্র জনতার প্রতিরোধ দিবস এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞের দিন হিসেবে পালন করবেন নাকি ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করবেন!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৫৫