এই কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে এথামাস নামক এক গ্রিক রাজার মাধ্যমে যিনি তার স্ত্রী নেফেলির প্রতি বিরাগগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন;তাকে দূরে সরিয়ে রেখে রাজকুমারী ইনোকে বিয়ে করেন।প্রথম স্ত্রী নেফেলি তার সন্তান ফ্রিক্সাসকে নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন।তিনি ভাবলেন যে দ্বিতীয় স্ত্রীটি হয়তো তার পুত্রকে হত্যা করার চেষ্টা করবে যাতে তার নিজ পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকার হতে পারে এবং তার ধারনাই ঠিক ছিল।এই দ্বিতীয় স্ত্রীটি এসেছিলেন এক বিখ্যাত পরিবার থেকে।তার পিতা ছিলেন থিবিসের স্বনামধন্য রাজা ক্যাডমাস; তার মা ও তিন বোন ছিলেন নিষ্কলংক জীবনের অধিকারী।কিন্তু ইনো নিজে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন ফ্রিক্সাসের মৃত্যু ঘটানোর জন্য।যেভাবেই হোক তিনি সকল শষ্য বীজের মালিকানা পেয়েছিলেন এবং চাষীরা তা বপন করার পূর্বেই তিনি এগুলোকে তাপে নষ্ট করে ফেললেন;ফলে আদৌ কোনো ফসলই ফললো না।রাজা ভবিষ্যতবক্তার কাছে এক বার্তাবাহককে পাঠালেন।ইনো বার্তাবাহককে প্ররোচিত করলেন এবং এটা বলাতে বাধ্য করালেন যে, ‘ভবিষ্যতবক্তা ঘোষনা করেছেন যে আর কখনো ফসল ফলবে না যদি না তারা তরুন রাজপূত্রটিকে উতসর্গ না করে’।
রাজা তরুন রাজপুত্রের মৃত্যু অনুমোদন দিতে বাধ্য হলো।প্রচলিত কাহিনী এরূপ যে,যখন ছেলেটিকে বেদীতে নেয়া হলো তখন স্বর্নের পশমময় এক বিস্ময়কর মেষ তাকে এবং নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা তার বোন হেলিকে হঠাৎ উপরে তুলে নেয় এবং বায়ুর ভিতর দিয়ে বয়ে নিয়ে যায়।যখন তারা ইউরোপ ও এশিয়াকে বিভাজনকারী সংকীর্ন পথটি অতিক্রম করছিলো তখন মেয়েটি পিছলে পড়ে গেল জলে।সে ডুবে মারা গেল এবং প্রনালীটির নাম হলো তার নামেঃ হেলির প্রনালী।
ফ্রিক্সাস ভূমিতে নেমে এল নিরাপদে,কলচিসদের দেশে।কলসিয়রা ফ্রিক্সাসের প্রতি সদয় হলো; তাদের রাজা ঈটিজ তার এক কন্যার সাথে ফ্রিক্সাসের বিবাহ দেন।আর ফ্রিক্সাস দেবতা হার্মিস কর্তৃক পাঠানো তাকে রক্ষাকারী স্বর্নের পশমময় সেই মেষটিকেই জিউসের উদ্দেশ্যে উতসর্গ করে এবং তিনি মূল্যবান স্বর্ন মেষের চামড়া দিয়ে দিলেন রাজা ঈটিজকে।এই মূল্যবান স্বর্নের চামড়াকে কেন্দ্র করেই সূচনা ঘটে বিখ্যাত এক অভিযানের যাতে গ্রীসের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ বীরেরা অংশগ্রহন করেছিলো এবং জ্যাসন-মিডিয়ার এক জনপ্রিয় উপাখ্যানের।
ফ্রিক্সাসের এক পিতৃব্য অধিকার সূত্রে ছিলেন গ্রিসের এক রাজা,কিন্তু পেলিয়াস নামক তারই এক ভ্রাতুষ্পুত্র তার কাছ থেকে রাজত্ব কেড়ে নেয়।রাজার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে জ্যাসন ছিল রাজত্বের ন্যায়সংগত অধিকারী।তাকে গোপনে দূরের এক নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং যখন সে প্রাপ্তবয়স্ক হলো তখন সে নির্ভয়ে ফিরে এসে তার চাচাতো ভাই পেলিয়াসের কাছ থেকে রাজত্ব দাবি করে।সে পেলিয়াসকে বলে যে,আমি তোমার চাচাতো ভাই এবং সবাই আমাকে জ্যাসন নামেই সম্বোধন করে।তুমি যা কিছু সম্পত্তি নিয়েছো সবই তোমার কাছে রাখো।কিন্তু রাজদন্ড ও সিংহাসন হস্তান্তর করো আমার কাছে যাতে এর দ্বারা কোনো অন্যায় বিবাদের সূত্রপাত না ঘটে।পেলিয়াস তার কথা উত্তর দিলেন বিনয়ী ভাষায়, ‘কাজেই তাই হোক,তবে প্রথমেই একটি কাজ করতে হবে।মৃত ফ্রিক্সাস আদেশ করেছেন স্বর্ন মেষের চামড়া কলচিসদের দেশ থেকে গ্রীসে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তার আত্নাকে স্বভূমিতে ফিরিয়ে আনতে।কিন্তু এরই মধ্যে আমি বার্ধক্যে উপনীত হয়েছি যেখানে তোমার যৌবনপুষ্প কেবল পূর্ন বিকশিত হচ্ছে।তুমিই এই অভিযানে যেতে পারো এবং আমি জিউসের নামে শপথ করে বলছি যে,আমি তোমার কাছে রাজত্ব ও সার্বভৌম শাসন তুলে দেব’।তিনি এমনটি বললেন মনে-প্রানে এই বিশ্বাস রেখে যে এরূপ চেষ্টায় জ্যাসন সফল হবে না এবং জিবীত অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে না।
এই মহান অভিযানের ধারনাটি জ্যাসনের কাছে খুবই আকর্ষনীয় মনে হলো।তিনি সম্মতি দিলেন।এই অভিযানের জন্য আর্গো নামে এক জাহাজ তৈরি করা হলো।আর এই আর্গো জাহাজের অভিযাত্রীদেরই আর্গোনট বলে সম্বোধন করা হয়।শ্রেষ্ঠ ও মহৎ সকলেই আসলো আর্গোনটদের দলে যোগ দিতে।তাদের মধ্যে ছিল শ্রেষ্ঠ বীর হারকিউলিস ,ছিলেন মহান সংগীতজ্ঞ অর্ফিউস,ক্যাস্টর ও তার ভাই পোলাক্স,একিলিসের পিতা পেলেউস এবং আরো অনেকে।দেবী হেরা তাদের সকলের মধ্যে এই প্রতিজ্ঞা প্রজ্বলিত করেন যে,তারা যেন জীবনের বিনিময়ে হলেও সহযাত্রীদের সাথে পান করে সাহসের অমরত্বের অনন্যতা।তাদের সামনে অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ সব বিপদ এবং এদের মধ্যে কোনোটি কেড়ে নিল অনেক প্রান,যেন তারা চলে গেল সেই অমরত্বের সুধা পান করার জন্য।
তারা প্রথমে অবতরন করলো লেমনস নামেক অদ্ভুত এক দ্বীপে।এখানে কেবল নারীরা বাস করতো।তারা পুরুষদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছিলো এবং বৃদ্ধ রাজা বাদে সকল পুরুষকেই হত্যা করে।সেই বৃদ্ধের কন্যা হিপসিপাইলি ছিল সকল নারীদের নেতা।এই ভয়ংকর নারীরা অবশ্য আর্গোনটদের সাদরে গ্রহন করে যতক্ষন পর্যন্ত না তারা আবার পাল তুললো ততক্ষন এই নারীরা তাদের জন্য উৎকৃষ্ট কাহবার,মদ,পোশাক দিয়ে সাহায্য করে।
লেমনস ছাড়ার পরপরই আর্গোনটরা তাদের দল থেকে হারালো হারকিউলিসকে।হাইলাস নামক এক বালক ছিল হারকিউলিসের বর্মবাহক ও তার প্রিয় পাত্র।বালকটি সমুদ্র থেকে জল তোলার সময়ে এক জল-উপদেবী তার গোলাপের শুভ্রতাময় সৌন্দর্যকে দেখে ফেললো এবং তাকে চোম্বন করার ইচ্ছা পোষন করে।সে তার বাহু প্রসারন করে বালকটিকে জলের গভীরে টেনে নিয়ে যায়।হারকিউলিস তাকে সর্বত্র উন্মাদের মত খুজলেন;সমুদ্র থেকে দূরে বনের গহীন থেকে গহীন্তর স্থানে তিনি চষে বেড়ালেন।তিনি ভুলে গেলেন স্বর্ন মেষের চামড়া,আর্গো ও তার সহযাত্রীদের কথা;শুধুমাত্র হাইলাস ছাড়া সবকিছু।তিনি ফিরে এলেন না এবং অবশেষে তাকে ছাড়াই জাহাজ রওনা দিল।
তাদের পরবর্তী অভযান ছিল হার্পিগনের বিরুদ্ধে।এরা ছিল বাকানো চোখ ও চোয়াল বিশিষ্ট ভয়ংকর উড়ন্ত প্রানী।এরা উড়ে যাবার সময়ে এক অসহনীয় দুর্গন্ধ রেখে যেত যা সকল জীবিত প্রানীকেই অসুস্থ করে তোলে।উপকূলের যে স্থানে আর্গোনটরা রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে জাহাজ ভেড়ালো সেখানে বাস করতো এক বৃদ্ধ যাকে দেবতা এপোলো দান করেছিল ভবিষ্যতবানী করার ক্ষমতা।কিন্তু দেবতা জিউস এই বৃদ্ধের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে ভয়ংকর শাস্তি আরোপ করে।যখনই সে খাবার গ্রহনের জন্য প্রস্তুত হত তখনই জিউসের শিকারী হার্পিগুলো ছুটে আসতো এবং নষ্ট করে ফেলতো খাবারগুলো।এগুলোকে তারা এতোই নোংরা করে ফেলতো যে,খাওয়া তো দূরের এর কাছেও কেউ ভিড়তে পারতো না।আর্গোনটদের ফিনেউস নামের এই হতভাগ্য বৃদ্ধ সাদরে গ্রহন করে এবং তাদের কাছে সাহয্য প্রার্থনা করে।নিজ দৈব ক্ষমতার কারনে সে জানতে পেরেছিল যে বিশেষ দুজনের পক্ষেই তাকে হার্পিগনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।তারা হলেন মহান বায়ু দেবতা বোরিয়াসের পুত্রদ্বয়,যারা আর্গো যাত্রীদেরই অন্তর্ভূক্ত ছিলেন।সকলেই সহানুভূতির সাথে তার কথা শুনলো এবং সেই দুজন তাকে আন্তরিকভাবে সাহায্য করারও অঙ্গীকার করে।
বৃদ্ধ তখনো খাবারের একটি দানাও মুখে দিতে পারেনি অথচ বিকট আকৃতির হার্পিগুলো শুন্য থেকে উড়ে এসে নোংরা করে ফেললো খাবার এবং গোগ্রাসে গিলে ফেললো সবটুকু।তাদের পিছনে অসহ্নীয় এক দুর্গন্ধ ফেলে রেখে এরা উড়ে যাচ্ছিল।কিন্তু বায়ুস্রোতের সমান বেগ সম্পন্ন উত্তর বায়ু দেবতার পুত্রদ্বয় এদেরকে অনুসরন করে এবং ধরে ফেলে।নিশ্চিতভাবেই এরা হয়তো এদেরকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতো কিন্তু স্বর্গ থেকে রংধনু দেবী আইরিস নেমে এসে হার্পিগুলোকে রক্ষা করে এবং অঙ্গীকার করে যে এরা আর কখনো ফিনেউসকে যন্ত্রণা দেবে না।সেই আনন্দে বৃদ্ধটি সারারাত ধরে বীরদের সাথে ভোজনে অংশ নেয়।
সে তাদেরকে আসন্ন বিপদ সন্বন্ধেও উপদেশ দিলো,বিশেষত সংঘর্ষপ্রবন পাথর সিম্পলগেইড সম্বন্ধে।সমুদ্র যখন উত্তপ্ত হয় তখন দুটি পাথম বিরতীহীন সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।সে বললো,এদের মাঝখান দিয়ে অতিক্রমের জন্য প্রথমত একটি ঘুঘু পাখি দ্বারা চেষ্টা করতে হবে।এটি যদি নিরাপদে অতিক্রম করতে পারে তখনই কেবল সুযোগ আছে তাদেরও নিরাপদে অতিক্রম করার।কিন্তু যদি ঘুঘুটি ব্যর্থ হয় তবে অবশ্যই তাদের ফিরে আসতে হবে এবং স্বর্ন মেষের চামড়া আনার সকল আশা ত্যাগ করতে হবে।
পরদিন সকালেই তারা স্বভাবতই একটি ঘুঘু নিয়ে যাত্রা শুরু করলো এবং শীঘ্রই চোখে পড়লো বিশাল গড়নের পাথরগুলো।তারা ঘুঘুটিকে ছেড়ে দিলেন এবং এটিকে নজরে রাখলেন।এটি এর ভিতর দিয়ে উড়ে গেলো এবং নিরাপদে বেরিয়ে গেল।কিন্তু এর লেজের কিছু পালক এর মধ্যে আটকা পড়ে ছিড়ে যায়।বীরগন যত দ্রুত সম্ভব এর পিছন পিছন ছুটলো।পাথরগুলো আলাদা হয়ে গেলো এবং একেবারে শেষ পর্যায়ে পাথরগুলোর আবার পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ হয় এবং জাহাজের একেবারে পশ্চাৎ ভাগের সুসজ্জিত শেষ অংশটি বিনষ্ট হয়।এমন সামান্য ক্ষতির বিনিময়ে তারা বড় কোনো ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পেলেন।
সেখান থেকে অনতিদূরেই ছিল নারী যোদ্ধাবাহিনী আমাজনদের দেশ।এরা ছিল শান্তিকামী উপদেবী হারমোনির কন্যা;এদের পিতা ছিল যুদ্ধ দেবতা এরেস।মিথলজির বিভিন্ন গল্পে এই আমাজনদের দেখা যায়।ট্রয় যুদ্ধের সময় গ্রীকরা এই আমাজনদের সাহায্যও চেয়েছিলো।আর্গোনটরা এ দেশটি পাশ কাটিয়ে গেলেন।দ্রুত এগিয়ে যাবার সময়ে তাদের চোখে পড়লো ককেশাস পর্বত এবং এ পর্বতের চূড়ায় প্রমিথিউসকে ।তারা শুনতে পেলেন ঈগলের বিশাল ডানা ঝাপটানোর শব্দ যা উড়ে যাচ্ছে রক্তাক্ত খাবার প্রমিথিউসের দিকে।
তারা কোনো কিছুর জন্যই থামলো না এবং সেদিনই সূর্যাস্তের সময় পৌছালেন স্বর্ন মেষের দেশ কলচিসে।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৩ রাত ১০:২১