১৯২৪ সাল।
ল্যান্ডস্বার্গ কারাগার।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অ্যাডলফ হিটলার আট মাসের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। কারাগারে তিনি বিশেষ বন্দীর মর্যাদা পেয়েছেন। একটি বড় আরামদায়ক কক্ষে তাকে রাখা হয়েছে এবং “বিশেষ বন্দীর” যাবতীয় সুযোগ সবিধা তাকে প্রদান করা হয়েছে। বন্দীকক্ষের জানালা দিয়ে, হিটলার দূরের নয়নাভিরাম পাহাড়গুলো স্পস্ট দেখতে পেতেন।
এরকম মনোরম পরিবেশে বসে, হিটলার ক্রমাগত একটি বইয়ের ডিকটেশন দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার ছায়াসঙ্গি রুডলফ হেস(Rudolf hess), প্রিয় নেতার বইয়ের ডিকটেশন নিতেন।
বইটি হিটলারের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের নিদর্শন। এর মাধ্যমে, মানবজাতি জানতে পারবে, নাৎসিবাদ তথা ন্যাশনাল সোশিয়ালিজম কি জিনিস। জানতে পারবে তার স্বপ্নের কথা, তার আদর্শের কথা। জানতে পারবে তার সংগ্রামের যৌক্তিকতার কথা। বইটির কাজ দ্রুত শেষ করা অত্যন্ত জরুরি।
পাণ্ডুলিপি তৈরি হওয়ার পর, হিটলার বইটির নাম দেন “Viereinhalb Jahre (des Kampfes) gegen Lüge, Dummheit und Feigheit” বাংলায় যার অর্থ, “মিথ্যাচার, নিমকহারামি এবং কাপুরুষতার বিরুদ্ধে আমার সাড়ে চার বছরের সংগ্রাম।“
ফলে যা হওয়ার তাই হল। বইটির প্রকাশক ম্যাক্স আমান(Max amann), কোনরূপেই এই বিদঘুটে নাম মেনে নিতে চাইলেন না। ম্যাক্স আমান ছিলেন নাৎসিদের পাবলিশিং সংস্থার প্রধান। তিনি হিটলারকে বললেন যে, এরকম বিদঘুটে নাম দেখলে, লোকজন লাথি দিয়ে বইটি ফেলে দিবে। তার জোরাজুরিতে বইটির নাম রাখা হয় Mein Kamph বা “আমার সংগ্রাম”।
বইটি নিয়ে আমানের এত বেশী উচ্চাশা ছিল না। তিনি আশা করেছিলেন হিটলার বিয়ার হল বিদ্রোহ নিয়ে মেলা কিছু লিখবেন। সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি পাঠকদের আগ্রহকে ধরে রাখতে সাহায্য করবে, আমান এমনটাই বিশ্বাস করতেন। বইটিকে আত্মজীবনী বলার চেয়ে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রচারের একটি মাধ্যম বলা যেতে পারে। নাৎসিবাদ যদি হয় একটি ধর্ম, তাহলে Mein Kamph হবে নাৎসিদের বাইবেল।
বইটির দ্বিতীয় অংশে, জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে হিটলার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খরচ করেছেন। নিজস্ব যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, অন্য সব জাতি নিকৃষ্ট। জার্মান জাতি, হিটলারের মতে যারা আর্যদের প্রতিনিধিত্ব করে, তারাই হবে পৃথিবীর রাজা।
বইয়ের প্রথম সংকরণ ১৯২৫ সালে প্রকাশিত হয়। প্রথম বছর বিক্রি হয় ৯,০০০ কপি। কিন্তু পরবর্তী তিন বছরে এ সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৩০ সালে, নির্বাচনে নাৎসি পার্টির দ্বিতীয় স্থান লাভ করার সুবাদে বইয়ের বিক্রি বেড়ে ৫৪,০০০ কপিতে গিয়ে দাড়ায়। আর ১৯৩৩ সালে, হিটলারের চ্যান্সেলর হওয়ার বছরে, বইয়ের বিক্রি অকল্পনীয় ১০ লাখ কপিতে গিয়ে ঠেকে। এর পড়ে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। পড়ুক বা না পড়ুক, মানুষ এই নাৎসি বাইবেলটিকে নিজেদের ঘরে রেখে কিছুটা নিরাপদবোধ করতেন।
****
১৯২৫ সালে হিটলার কারগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। তিনি বুঝতে পারলেন, সংগ্রামের পথ এখন আরো বন্ধুর। নাৎসি পার্টিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তার বক্তৃতা দেওয়ার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি ১৯২৭ সাল পর্যন্ত বক্তৃতা দিতে পারবেন না।
এমতাবস্থায়, অনেকেই হিটলারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। কারণ, মানুষ জানতেন, সবাক হিটলার যা করতে পারবে, নির্বাক হিটলার তার কিছুই করতে পারবে না।
চারদিকে এমনিতেই করুন অবস্থা ছিল, তার উপর মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে আরেকটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১৯২৫ সালে, জার্মানি তার অর্থনৈতিক দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠবার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠে। ডক্টর জালমার হোরেস গ্রেইলি শাখটের নেতৃত্বে, জার্মানি তার অর্থনৈতিক মন্দাভাব কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছিল। যেখানেই গনতন্ত্রের অস্তিত্ব রয়েছে, সেখানেই আমেরিকা তার হাত প্রসারিত করেছে। আমেরিকা জার্মানিকে প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক সাহায্য দান করতে থাকে। জার্মানিকে সেই সময়ে প্রদান করা অনেক ঋণ, আমেরিকা কোনদিন ফেরতও চায়নি।
আর তাছাড়া “ডস প্ল্যান”(the dawes plan) নামক একটি বিশেষ প্ল্যানের কল্যাণে, জার্মানিকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের যে অকল্পনীয় বাৎসরিক ক্ষতিপূরণ দিতে হত, তাও মোটামুটি প্রদানযোগ্য পরিমাণে নেমে আসে।
এছাড়া আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফ্রান্স, জার্মানির বানিজ্যিক অঞ্চল, তথা রুড়(ruhr)অঞ্চল থেকে নিজেদের অনেকাংশে গুটিয়ে নেয়। ফ্রান্সের কাছ থেকে নিজেদের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অঞ্চল তথা “রুড় অঞ্চল” ফিরে পেয়ে জার্মানি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
ধীরে ধীরে জার্মানরা তাদের স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবন ফিরে পেতে শুরু করে। মানুষ ভুলে যেতে শুরু করে ভারসাই চুক্তির কথা। আর এটাই ছিল হিটলারের দুশ্চিন্তার বড় কারণ।
যে সরকার ব্যবস্থায় মানুষ সুখী স্বচ্ছন্দ জীবনের নিশ্চয়তা পাচ্ছে, তাকে মানুষ সহজে ত্যাগ করবে না। সুখী মানুষ সহজে পরিবর্তন চায় না। হিটলার বলেন, “একজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ঘটবে ঘোড় বিপদের সময়ে। আমাদের এখন অপেক্ষা করতে হবে মোক্ষম সময় ও সুযোগের জন্যে। আমরা এখন কেবল আশা করতে পারি যে, এই সুসময় বেশীদিন থাকবে না।”
হিটলারের কথা বাস্তবে পরিণত হবে চারটি বছর পর।
****
অবশ্য, এই দীর্ঘ অপেক্ষার সময়গুলো হিটলার বসে বসে কাটিয়ে দেননি। অনেকে তার শেষ দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু তারা জানতেন না যে, হিটলার ছিলেন একজন চমৎকার সংগঠক। উপরের মহলে লাগাতার তদবির করবার মাধ্যমে, নাৎসি পার্টি পুনরায় তাদের বৈধতা ফিরে পায়। অবশ্য, হিটলারের বক্তৃতার উপর নিষেধাজ্ঞা তখনো বহাল ছিল।
হিটলার এবার নাৎসি বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করেন। রাষ্ট্রের আদলে, নাৎসি পার্টিকে গড়ে তুলবার যুগান্তকারী পরিকল্পনা করা হয়।
হিটলার বলেন, “যেহেতু বর্তমান রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত হব, সেহেতু পার্টির সকলেরই রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ম নীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে বাস্তব ধারনা থাকা উচিত। মানুষ এখনও বুঝতে পারছেনা, তাদের এই সুখ সাময়িক। আমরা এখনও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারিনি। আমরা ক্ষমতায় এলে, বর্তমান পরিকল্পনাটি, আমাদেরকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছুতে সহায়তা করবে।"
হিটলারের এই মাস্টার প্ল্যান অনুসারে, নাৎসি বাহিনী হবে- A State Within a State. "রাষ্ট্রের অন্তঃপুরে আরেক রাষ্ট্র"
***
A State Within a State, এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে, নাৎসি পার্টিকে ঢালাও করে সাজানো হয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থার আদলে সৃষ্টি করা হয়, কৃষি বিভাগ, বিচার বিভাগ, স্বরাষ্ট্র বিভাগ, অর্থনৈতিক বিভাগ, শ্রম বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ, সেই সাথে জাতি ও সংস্কৃতি বিভাগ। এছাড়া খোলা হয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং সবশেষে, নাৎসিদের বিখ্যাত প্রোপ্যাগান্ডা বিভাগ।
দলে দলে যেন মানুষ নাৎসি পার্টিতে যোগদান করে, সেই লক্ষ্যে খোলা হয় কিছু বিশেষ বিভাগ। যেমন, Hitler Youth, এটি ছিল ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের জন্যে। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের জন্যে আলাদা সংঘঠন ছিল।
কিশোরদের পরিপূর্ন বিকাশ সাধনা এবং তাদের নাৎসি মূলমন্ত্রে দীক্ষিত করাই ছিল Hitler Youthএর কাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, সিংহভাগ Hitler Youth গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে গঠন করা হয়, দুধর্ষ প্যাঞ্জার ডিভিশন "The Hitler Jugend." মিত্রবাহিনী স্বীকার করেছিল যে, Hitler Jugendএর সদস্যরা ছিল মারাত্মক বেপরোয়া। সহজে তারা আত্মসমর্পন করত না।
এছাড়া নারী সদস্যের জন্যে নাৎসি পার্টিতে ছিল আলাদা অঙ্গসংগঠন। সংগঠন ছিল ডাক্তারদের জন্যে, উকিলদের জন্যে, বিচারকদের জন্যে। এমনকি সিনেমা নির্মাতা, চিত্রশিল্পী, কবি সাহিত্যিকদের জন্যেও সংগঠন ছিল।
****
হিটলারের এই সিউডো-রাষ্ট্রে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়, S.A(Storm abteilung) কে। আর রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্যে খোলা হয় নতুন শাখা The S.S(Schutz-staffel, বাংলায় যার অর্থ "নিরাপত্তা বাহিনী"। S.S এর নেতা ছিলেন একজন কৃষিবিদ্যায় ডিগ্রীধারী কৃষক-কাম-রাজনীতিবিদ। নাম হেইনরিচ হিমলার( Heinreich Himmler).
শুরুতে S.S এর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২০০। কিন্তু ১৯৪৫ সালের মধ্যে তা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ততদিনে কসাই হিমলারের নেতৃত্বে, এই সংগঠনটি পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করে ফেলেছিল।
(যুদ্ধের শেষের দিকে, S.S রা জানত যে, ধরা খেলে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। এই কারণে, S.S রা বার্লিনের যুদ্ধে, বার্লিনের প্রতিটি বিল্ডিঙের প্রতিটা রুমের জন্যে লড়াই করে। এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে, গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে, তারা হাতাহাতি লড়াই করে।)
(চলবে)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার লেখার লিঙ্কস
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৮