১৯১৮ সালের ১০ নভেম্বর, জার্মানি ও তার মিত্রপক্ষের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। পরের দিন, তথা ১১ নভেম্বর জার্মানি ও মিত্রশক্তির মধ্যে আত্মসমর্পণ চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই পরাজয় হজম করতে, অনেক জার্মান প্রস্তুত ছিলেন না। কেননা, সেই সময় বিভিন্ন যুদ্ধের ময়দানে জার্মানরা শত্রুপক্ষের সাথে তুমুল লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায়, পরাজয়ের খবর অনেক জার্মানের কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আসে। পরাজয়ের গ্লানি তারা কখনো হজম করতে পারেননি।
যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে জার্মান রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। জার্মানিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৩ সালে, হিটলার, চ্যান্সেলর হবার মাধ্যমে, জার্মানিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাঝে, ১৯১৮ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত, যে গণতান্ত্রিক যুগ ছিল তাকে WEIMAR REPUBLIC বলা হত।
১৯১৯ সালের ২৮ জুন, জার্মানির সাথে মিত্রপক্ষ "ভারসাই চুক্তি(versailles pact)" করে। জার্মানির অন্যান্য মিত্রদের সাথে ভিন্ন ভিন্ন চুক্তি সম্পন্ন করা হয়। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর ছিল ভারসাই চুক্তি।
জার্মানিকে এই আত্মঘাতী চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়।
চুক্তির মাধ্যমে, জার্মানির সাথে মিত্রপক্ষের যুদ্ধাবস্থার ইতি টানা হয়।
কিন্তু যুদ্ধের জন্যে পুরাপুরি জার্মানিকে দায়ী করা হয় এবং রাজা কাইজার দ্বিতীয় উইলহেমকে প্রধান যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করা হয়। জার্মানরা তাদের কাইজারকে ভালবাসত, এবং এই সিদ্ধান্ত তাদের মনে তীব্র আঘাত হানে।
চুক্তি অনুসারে, জার্মানিকে যুদ্ধের সমস্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়। জার্মানির পক্ষে তা প্রদান করা বাস্তবিকপক্ষে সম্ভব ছিল না। জার্মানি এই ক্ষতিপূরণের অতি সামান্য অংশ দিতে গিয়েই দেউলিয়া হয়ে যায়।
ফলে অল্প কয়দিনেই দেশে অর্থনৈতিক ধস নামে। লোকজনের কোন কর্মসংস্থান ছিল না। এই সময় অনেক যুদ্ধফেরত মানুষ এসে দেখল যে, বিভিন্ন কল কারখানার এবং অফিস আদালতের বড় বড় পদগুলো ইহুদীদের দখলে। ১ম বিশ্বযুদ্ধে পুরো জার্মানি যেখানে যুদ্ধের পক্ষে ছিল, সেখানে ইহুদী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ ছিল যুদ্ধের বিপক্ষে। এই কারণে ইহুদীদের থেকে সবচেয়ে কম লোক যুদ্ধে গিয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইহুদীদের টান ছিল অবাক করার মত। যুক্তরাষ্ট্র যখন যুদ্ধে যোগদান করে, তখন ইহুদীদের আনন্দের সীমা ছিল না। এভাবে সাধারণ জার্মানদের মনে ইহুদিবিরোধী মানসিকতার বীজ রোপিত হয়। ইহুদীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও উঠে যে, তাদের পরোক্ষ ইন্ধনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১ম বিশ্বযুদ্ধে মরার উপর খাড়ার ঘার মত যোগদান করে। এতগুলো দেশের আক্রমণ জার্মানির পক্ষে একা সামলানো সম্ভব হয়ে উঠেনি বলেই তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
ভারসাই চুক্তির প্রতি জার্মান নাগরিকের ঘৃণা অমূলক ছিল না। কারন একে তো পুরা যুদ্ধের সমস্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়েছে, তার উপর, জার্মানিকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্যে আরো অনেক কঠিন শর্ত আরোপিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, বিশাল জার্মান আর্মি ভেঙ্গে দেওয়া এবং জার্মানির অনেক ভুখন্ড নিরাপত্তার অজুহাতে কেড়ে নেওয়া।
চুক্তি অনুযায়ী, জার্মান আর্মিতে সৈন্য সংখ্যা হবে সর্বোচ্চ এক লাখ(১,০০,০০০)।
সাধারণ সৈন্যদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বারো বছর, এবং অফিসারদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পঁচিশ বছর সেনাবাহিনীতে থাকবার অনুমতি প্রদান করা হয়।
জার্মানির একটি নামকাওয়াস্তে নৌবাহিনী থাকবে। নৌসেনা সংখ্যা সর্বোচ্চ পনের হাজার(১৫,০০০) থাকতে পারবে।
ব্যটলশীপ সর্বোচ্চ ৬টি। তাও এদের ওজোন ১০,০০০ টনের বেশী হতে পারবে না।(দশ হাজার টনের ব্যটলশীপকে তখন খেলনা ব্যটলশীপ বলা হত)।
নৌবাহিনীতে মাত্র ৬টি ক্রুজার(৬,০০০ টন), ১২টি ডেস্ট্রয়ার(৮০০ টন), আর মাত্র ১২টি টর্পেডো বোট থাকতে পারবে।
নৌবাহিনীতে কোন সাবমেরিন এবং বিমানবাহী রণতরী থাকতে পারবে না।
ভারসাই চুক্তি অনুসারে জার্মানি কোন ধরণের অস্ত্র আমদানি অথবা রপ্তানি করতে পারবে না।
জার্মান সেনাবাহিনীতে কোন ধরণের ট্যাঙ্ক থাকতে পারবে না।
ভারসাই চুক্তি অনুসারে, জার্মানিকে তার সম্রাজ্যের অনেক অংশ, মিত্রবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করতে হয়। সে সব স্থানে বসবাসকারী জার্মানরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। নতুন দেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও তারা নিজেদের জার্মান হিসেবেই দেখত। মনে প্রাণে পুনরায় জার্মানির সাথে মিলিত হবার স্বপ্ন দেখত তারা।
১ম বিশ্বযুদ্ধে হারার কারণে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ, জার্মানিকে আলসাস(alsace) এবং লাউরেইন(lorraine) নামক দুটি স্থান ফ্রান্সের কাছ হস্তান্তর করতে হয়। কিন্তু এই দুটি স্থানে বসবাসকারী সকলেই ছিল একেবারে অরিজিনাল জার্মান।
উত্তর শ্লেষ-উইক(Northern Schleswig) নামক স্থান হস্তান্তরিত হয় ডেনমার্কের কাছে।
অধিকাংশ প্রুশিয়ান(prussian) এলাকা পোল্যান্ডকে দিয়ে দিতে হয়। যেমন পযনান(poznan), পশ্চিম প্রুশিয়া(west prussia) পোল্যান্ড নিয়ে নেয়।
ইউপেন-মালমেনডি(eupen-malmendy) নামক স্থান বেলজিয়ামের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়াকে পৃথক করে ফেলা হয়।
অতি বিখ্যাত দানযিগ(danzig) সমুদ্র বন্দর পোল্যান্ড নিয়ে নেয়। মূলত এটি করা হয়েছিল পোল্যান্ডকে সমুদ্রসীমা প্রদান করার জন্যে।(এর পুর্বে পোল্যান্ডের কোন সমুদ্রসীমা ছিল না)।
বিভিন্ন উপমহাদেশে জার্মান কলোনিগুলো মিত্রপক্ষ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ভারসাই চুক্তি মতে এইসব কলোনিগুলো আর কখনো জার্মান সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না।
যেমন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, নিজেদের মধ্যে ক্যামেরুন(cameroon) এবং টোগোকে(togo) ভাগ করে নেয়।
বেলজিয়ামের ভাগে রুয়ান্ডা(ruanda) এবং উরুন্ডী(urundi) নামক দেশ দুটি পড়ে।
জার্মানি নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ আফ্রিকার অধিকাংশ এলাকা দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এছাড়া আফ্রিকায় আরো অনেক জার্মান নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছিল যা ব্রিটেন বগলদাবা করে নিয়ে যায়।
প্রশান্ত মহাসাগরেও জার্মান উপনিবেশ ছিল। এদের মধ্যে মারশাল-আইল্যান্ড(marshall island), ক্যারলিন-আইল্যান্ড(caroline island), মারিয়ানা-আইল্যান্ড(mariana island), পালাউ-আইল্যান্ড(palau island) সবগুলো জাপানের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সামোয়া-আইল্যান্ড(samoa island), নিউ-জিল্যান্ডকে এবং পাপুয়া-নিয়-গিনি(papua new guinea) অস্ট্রেলিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
****
পুর্বেই বলা হয়েছে যে, ভারসাই চুক্তিতে, জার্মানিকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের সম্পুর্ন ক্ষতিপূরণে বাধ্য করা হয়। জার্মানি শুরুতে চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি না হলেও, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে রাজি করানো হয়।
প্রাথমিক সিদ্ধান্তে, ২২৬ বিলিয়ন জার্মান মার্ক ক্ষতিপুরণ হিসেবে ধার্য হয়। কিন্তু বিশেষ অনুরোধে, তা কমিয়ে ১৩২ বিলিয়ন জার্মান মার্ক করা হয়।
১৩২ বিলিয়ন মার্ক হল তৎকালীন ৩১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার(বর্তমানে ৪৪২বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
এই ক্ষতিপূরণের ১ম কিস্তি দিতে গিয়েই জার্মানি আক্ষরিক অর্থে দেউলিয়া হয়ে যায়।
বিয়ার ছাড়া আর কিছুই কিনা সম্ভব হয়নি।
অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হল, ১ম বিশ্বযুদ্ধের আগে, এক জার্মান মার্ক ছিল চার মার্কিন ডলারের সমতুল্য।
কিন্তু যুদ্ধের পর ১৯২৩ সালের শুরুতে ১৮,০০০ জার্মান মার্কের বিনিময় মুল্য দাড়ায় এক মার্কিন ডলার।
১৯২৩ সালের জুলাইে তা হয় ৩,৫০,০০০ জার্মান মার্ক।
১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে তা হয় ১০লাখ জার্মান মার্ক।
২০১০ সালে এসে, জার্মানি, ১ম বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতিপূরণের শেষ কিস্তি পরিশোধ করে।
হিটলারের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার এক বড় কারণ হল এই অন্যায় ভারসাই চুক্তি।
(চলবে)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে আমার অন্যান্য লেখা