ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাটের বাসভবনে প্রায় দুই ঘণ্টা দীর্ঘ বৈঠক করেছেন বিএনপির কূটনীতিক উইংয়ের নেতারা। গত সোমবার সকালে (১৬/০৫/১৬) রাজধানীর গুলশানে এ বৈঠক হয় বলে জানা গেছে। বৈঠকে আলোচনার বিষয় জানা যায়নি।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটের বাসায় বিএনপির এ বৈঠক বিএনপি রাজনীতির অস্থিরতাই প্রমাণ করছে। বিএনপির অন্যতম থিংকট্যাঙ্ক প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান, ‘আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদর রহমান সজীব ওয়াজেদ জয় হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে এখন কারাগারে আছেন। অতিসম্প্রতি খালেদা জিয়া জয়ের একাউন্ট নিয়ে মনগড়া কথা বলে বিপাকে পড়েছেন। এ বক্তব্য নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত হচ্ছে। সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা হচ্ছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর দিল্লিতে বৈঠক। আসলাম চৌধুরী সরকারকে উৎখাত করতে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গিয়ে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রতিনিধির সঙ্গে একটি হোটেলে গোপন বৈঠক করেন। গত মার্চে মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করলে সম্প্রতি সে ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস হয়। এরপরই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। ইতোমধ্যে মোসাদ প্রতিনিধির সঙ্গে আসলাম চৌধুরীর গোপন বৈঠকের বেশ কয়েকটি ছবি বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা সেই বৈঠক সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর নেয়ার পরই সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রকাশ পায়।
ইসরায়েলের বর্তমান ক্ষমতাসীন পার্টির সদস্য এবং একজন উপমন্ত্রী এন সাফাদির সঙ্গে আসলাম চৌধুরী বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের উৎখাতের বিষয়ে বৈঠক করেছেন। সাফাদি ও আসলাম চৌধুরীকে ফুল দিয়ে বরণ করা ও একসঙ্গে বৈঠক করার ছবি একসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুক পেইজেও মেন্দির সঙ্গে আসলামের বৈঠক, আলাপ-আলোচনা ও খাওয়া-দাওয়ার একাধিক ছবি প্রকাশ পায়। এ সম্পর্কে ইসরায়েলভিত্তিক অনলাইন সংবাদ মাধ্যম জেরুসালেম অনলাইন ডটকম একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, মেন্দি এন সাফাদি সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন। সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেছেন তিনি। সেখানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। নতুন সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ ক‚টনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। গত সম্মেলনে চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এহেন ধনাঢ্য আসলাম চৌধুরীকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বানিয়েছেন। চৌধুরী সাহেব অস্বীকারও করেননি যে তিনি সাফাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি বা দলের সঙ্গে বন্ধুত্বকে প্রকারান্তরে ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় ফিলিস্তিনি দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ইউসুফ এস রামাদান। কথাটি বিএনপির বেলায় মর্মান্তিক সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, এমন খবর পত্রিকায় এসেছে। বিএনপি নিঃসন্দেহে একটি বড় দল। সেই দলে বহুমুখী সমর্থক আছে। দলের অভ্যন্তরে সাপের মতো ফণা তুলেছে নানা প্রশ্ন- আসলাম চৌধুরীকে নিয়ে। তার এই তৎপরতা সরকার পক্ষের একটি হাতিয়ার হবে বলেও সমর্থকরা অভিমত দিয়েছেন। দলের মধ্যে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। আসলাম চৌধুরী গ্রেপ্তারের পর দলটি আরো বেকায়দায় পড়েছে। দলের নেতারাই বলেছেন, আসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরই ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল। তিনি নিজেও সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারতেন। এটা না করার দলের ওপর প্রভাব পড়বে। বিএনপির রাজনৈতিক অস্থিরতা আসলাম চৌধুরীর ঘটনায় আরো বাড়বে। বিএনপির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রামাণিক অভিযোগগুলো মারাত্মক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতে বিডিআর বিদ্রোহ হলো, এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোটের সম্পৃক্ততার খবর পত্রিকায় এসেছে। এরপর একটি অসফল আর্মি ক্যু হয়েছিল, এরপরই গোলাম আযমের ছেলেকে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। এ নিয়ে যে তীক্ষè প্রশ্ন উঠেছে তা বিএনপিকে তাক করেছে। বিএনপির উত্থানের মধ্যে সামরিক অভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যা, জেলহত্যা, তাহের হত্যা, খালেদ মোশারফ হত্যার নাজুক বিষয়গুলো জড়িত বলেই উল্লিখিত অনভিপ্রেত ঘটনাগুলো বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে না গিয়ে, নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে দেশে পরিচ্ছন্ন, জনমতভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে হরতাল, জ্বালাও পোড়াও, ঘেরাও করে দেশে চরম অস্থিরতা তৈরি করেছিল। তাতে অবর্ণনীয় কষ্ট হয়েছে দেশের মানুষের। নিম্ন পেশাজীবী, শ্রমজীবী নর-নারীরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। এরপর অগ্নিবোমা। শত শত মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। এসব ঋণাত্মক ঘটনা বিএনপিকে হতাশা আর অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিএনপি বারবার বিদেশের দরজায় ধরনা দিচ্ছে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার। মনে হয় বিএনপি জনমত গঠন করতে চায় না, সরকারকে যেকোনো উপায়ে বিদেশি শক্তির সাহায্যে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। মোসাদের সঙ্গে চক্রান্ত করা মারাত্মক অভিযোগ। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ চলে আসছে যে, পাকিস্তানের ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে। তাদের নির্দেশে জামায়াত-শিবিরিকে দিয়ে বাংলাদেশে সহিংস ঘটনা ঘটানো হয়েছে। খোদ খালেদা জিয়া একবার এক বিদেশি পত্রিকায় প্রতিবেদন লিখে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন সরকারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে। সামান্য ইউপি নির্বাচনের ব্যাপারেও বিএনপির নেতারা বিদেশি দূতাবাসে ধরনা দিয়েছেন। কথায় কথায় রাষ্ট্রদূতদের বাসায় গিয়ে গোপন সলা-পরার্মশ করা আগুন নিয়ে খেলার সমতুল্য। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চড়া গলার বামপন্থি দলগুলোর এসব চোখে পড়ে না। নাকি চোখ দুটোই সরকারের বিরুদ্ধে স্থির?
মোসাদ ইসরায়েলের মারাত্মক হিংস্র গোয়েন্দা সংস্থা। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকারকে মোসাদ তথা ইসরায়েলের জায়নিস্টরা মোটেই পছন্দ করে না। কারণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ইয়াসির আরাফাতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি শেখ হাসিনাকে স্নেহ করতেন বন্ধুর মেয়ে হিসেবে। বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা দুজনই প্যালেস্টাইনি মুক্তি সংগ্রামকে জোরালো সমর্থন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় বসার আগে ঢাকায় প্যালেস্টাইনি হাই কমিশন বা দূতাবাস খোলার অনুমতি দিয়েছেন। এসব কারণে ইসরায়েলি গোয়েন্দা শেখ হাসিনার সরকারের ওপর খুব রুষ্ট। এই ক্রুদ্ধতা কাজে লাগিয়ে বিএনপির আসলাম চৌধুরী মোসাদ কানেকশন করেছেন সরকার উৎখাতের তাগিদে। অর্থাৎ মার্কিন, পাকিস্তান ও ইসরায়েল- তিন দেশের সঙ্গে বিএনপি কানেকশন চলছে। অভ্যন্তরীণভাবে থেকে থেকে যে হত্যাকাণ্ডগুলো চলছে তাও জামায়াত-শিবিরের সম্পৃক্ততা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এসব নিরীহ নির্দোষ মানুষ, পীর-পুরোহিত, ধর্মযাজক, ব্লুগার, বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ফন্দিটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পাপ কিন্তু বাপকেও ছাড়ে না। যুদ্ধাপরাধীরা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বাঁকা পথের রাজনীতি দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৬ সকাল ১০:১০