একাত্তরের নরঘাতক, আলবদর বাহিনীর প্রধান ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরের পর এবার ফাঁসি কার্যকরের চূড়ান্ত বিচারিক প্রক্রিয়ায় আছেন একাত্তরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ‘বাঙালি খান’ হিসেবে পরিচিত আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলী।
৬৪ বছর বয়সী মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মৃত্যুদন্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণ, নির্যাতনসহ ১৪টি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে ১০টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কাসেম আলীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড বহাল রেখেছেন। একাত্তরে চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর কমান্ডার মীর কাসেম আলীর করা আপিলের সংক্ষিপ্ত রায় গত ৮ মার্চ ঘোষণা করা হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আসামিপক্ষের সামনে থাকবে দুটি ধাপ।
আসামি আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) ও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার সুযোগ পাবেন। দুটি আবেদনই নাকচ হলে সরকারের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ দন্ড কার্যকর করবে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত ছয় বছরে ২৩টি মামলায় ২৩ জনের ফাঁসির (মৃত্যুদন্ড) আদেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে শীর্ষ ছয় যুদ্ধাপরাধীর চূড়ান্ত আপিল নিষ্পত্তি হয়েছে। চিহ্নিত পাঁচ স্বাধীনতাবিরোধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
তাঁরা হলেন জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।
জানা গেছে, মীর কাসেম আলীর রায় লেখার কাজ শুরু হয়েছে। লেখা শেষ করার পরপরই সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিদের স্বাক্ষর শেষে রায়ের অনুলিপি প্রকাশ করা হবে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করার পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু হবে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পুনর্বিবেচনার আবেদনের মধ্য দিয়ে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ সংক্ষিপ্ত রায়ে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মির্জা হোসেইন হায়দার ও মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
এটি আপিলের সপ্তম মামলা, যার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। অনুলিপি হাতে পেলেই রায় পর্যালোচনার আবেদন (রিভিউ) করতে পারবেন আসামিপক্ষ। মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ৬ জনকে নির্যাতন করে হত্যার দায়ে ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর তাঁকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল।
জানা গেছে, ফাঁসির দন্ড বহাল রেখে একাত্তরে আলবদর নেতা মীর কাসেমের আপিলের রায় লেখার কাজ চলছে। রায় লেখা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশ করা হবে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মূল হোতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আটজনকে হত্যা-গণহত্যা প্রমাণিত হওয়ায় তাঁর সর্বোচ্চ দন্ড দেওয়া হয় আপিলের রায়ে।
নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিমকোর্টে এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর তা ট্রাইব্যুনালে যাবে। পরে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন ট্রাইব্যুনাল। পরোয়ানা আসামিকে পড়ে শোনাবে কারা কর্তৃপক্ষ।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আগেই বলেছেন, আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউর রায়ে বলা আছে, পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামি রিভিউ করতে পারবেন।
তিনি বলেন, অপেক্ষা করব এই ১৫ দিনের জন্য। তাঁরা যদি রিভিউ পিটিশন দাখিল না করেন, তাহলে আমরা এই রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা নেব।
মীর কাসেম আলীর ডিফেন্স টিমের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনও বলেছেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষা করছি। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর রিভিউর উপাদান পাওয়া গেলে রিভিউ আবেদন করা হবে।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘রিভিউ শুনানিতে কারো ফাঁসি বা মৃত্যুদন্ড কমেছে বলে আমার জানা নেই। ইতিহাসে এমন নজির আছে বলেও আমার জানা নেই।
সে ক্ষেত্রে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাসেম আলীর রিভিউ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়েই জানা যাবে তার পরিণতি।
মীর কাসেম আলীর আপিলের রায়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে হত্যা-গণহত্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী থাকায় বেশ কয়েকটি অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
১১ নম্বর ছাড়াও ১২ নম্বর অভিযোগে রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজুকে হত্যার দায়েও কাসেমের মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তবে আপিলের চূড়ান্ত রায়ে তার প্রমাণ না পাওয়ায় এই অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেন আপিল বিভাগ।
রায়ে বলা হয়, মীর কাসেমের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ৪, ৬ ও ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আর ২, ৩, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে আপিল নাকচ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ই বহাল রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ নম্বর অভিযোগে হত্যার দায় থেকে এই জামায়াত নেতা অব্যাহতি পেলেও ১১ নম্বর অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজাই বহাল রাখা হয়েছে।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম আলী ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাৎ মজলিশে শুরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তিনি জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা।
চূড়ান্ত রায়েও তাঁর সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত বহাল রয়েছে। ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলের দিগন্ত মিডিয়া সেন্টার থেকে গ্রেফতার হন মীর কাসেম আলী। গ্রেফতারের পর থেকেই তিনি কারাগারে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের আগ পর্যন্ত তিনি ডিভিশনে ছিলেন। মৃত্যুদন্ড পাওয়ার পর তাঁকে ফাঁসির আসামিদের সেলে পাঠানো হয়।