নিজামীর বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২৮ মে অান্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১ এ তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। ১৬ টি অভিযোগ গঠন করা হয় নিজামীর বিরুদ্ধে। এর মধ্যে চারটি গণহত্যার এবং একটি বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
২০১২ সালের ২৮ মে পৃথক দুটি ট্রাইব্যুনালে একইসঙ্গে নিজামী ও কাদের মোল্লার বিচার কাজ শুরু হয়েছিল। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ওই মামলার অাপিল শুনানি শেষে রায় কার্যকরও হয় গত বছরের ১২ ডিসেম্বর।
নিজামীর মামলার দীর্ঘসূত্রীতার বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ মামলায় ৩০ জনের সাক্ষী নেওয়া হয়েছে প্রায় ১৭ মাস ধরে। অপরদিকে মতিউর রহমান নিজামী অালোচিত দশ ট্রাক অস্ত্র মামলারও অাসামি হওয়ায় তাকে গত বছরে সপ্তাহে দুই দিন চট্টগ্রামে নেওয়া হতো। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় নিজামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
গত বছরের ১৩ নভেম্বর বিচারপতি ফজলে কবির আসামী পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে ঘোষণা করে প্রথম বারের মতো রায় অপেক্ষমাণের তালিকায় (সিএভি) করেন। পরে অাসামী পক্ষের অাবেদনের প্রেক্ষিতে অাবার তাদের যুক্তি উপস্থাপনের সুযোগ দেন। যুক্তি উপস্থাপন শেষে ২০ নভেম্বর দ্বিতীয় বারের মতো এটি সিএভি হয়।
কিন্তু রায় ঘোষণা হবার অাগেই গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল ১ এর চেয়াম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় অবসরে যান। প্রায় দেড় মাসেরও বেশি সময় পর ২৩ ফেব্রুয়ারি সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম। তখনই চেয়ারম্যান নিয়োগে দীর্ঘসূত্রীতা নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সহ অন্যান্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তখন বিচার সংশ্লিষ্টরা এও বলেছিলেন যে, ট্রাইব্যুনাল নিয়ে সরকারের পূর্ব প্রস্তুতি না থাকাতেই এই সময় ক্ষেপণ হচ্ছে। বিচারপ্রক্রিয়ার গতিকে বাধাহীন রাখতে ট্রাইব্যুনালের এসব বিষয় সরকারের অাগেই পরিকল্পনায় থাকা উচিত ছিল।
এর আগে কখনও এত দিন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান পদ শূন্য থাকেনি। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান বিচারপতি নিজামুল হক। তবে বেলজিয়ামপ্রবাসী এক আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথিত স্কাইপ কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন। এর একদিন পরই ১৩ ডিসেম্বর বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরকে চেয়ারম্যান করে ট্রাইব্যুনাল-১ পুনর্গঠন করে সরকার।
নতুন চেয়ারম্যান ইনায়েতুর রহিম দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পুণর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে এ বছরের ১০ মার্চ দ্বিতীয় বারের মতো যুক্তি উপস্থাপন শুরু করে প্রসিকউশন শেষ করে ১২ মার্চ। ডিফেন্স টিম শেষ করে ২৩ মার্চ। এরপর তৃতীয়বারের মতো রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখা হয় গত ২৪ মার্চ।
নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতনসহ ১৬ টি অভিযোগ রয়েছে।
নিজামীর মামলার রায় প্রকাশে সময় লাগছে কেন জানতে চাইলে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রীতার অন্যতম কারণগুলোর একটি হলো প্রসিকিউটরদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা।
’অান্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অাইন ৭৩-এ বলা হয়েছে যেখানে একটি মামলার কার্যক্রম শেষ হবে পরবর্তীকালে সেখান থেকেই শুরু হবে’ জানিয়ে তিনি আরো বলেন,’ এটা প্রসিকিউটররা নজরে অানবেন,কিন্তু নিজামীর মামলায় অামরা দেখলাম নতুন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিয়োগ হবার পর একজন প্রসিকিউটরই নতুন করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য বলেছেন’।
তিনি আরো বলেন,’সরকারেরও ঢিলেমি রয়েছে এই বিচার নিয়ে। একজন বিচারক অবসরে যাবার পর অারেকজনের নিয়োগে এত সময় লাগার কথা নয়, যদিও সরকারের কাছে হয়তো এর জন্য অাইনি ব্যাখ্যা রয়েছে। তারপর অারেকটি বড় কারণ নিরাপত্তা। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। এখানকার সব বিচরকরা নিরাপত্তহীনতায় রয়েছে। ‘
শাহরিয়ার কবির জানান, ট্রাইব্যুনালে যতো গুলো মামলা হয়েছে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে নিজামীর মামলার সাক্ষীরা।
’অামি ব্যক্তিগতভাবে জানি, নিজামীর মামলার অনেক ভাইটাল সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে অাসেনি কেবলমাত্র নিরাপত্তার কারণে, জামায়াতের হুমকির কারণে।’ বলে তিনি প্রশ্ন রাখেন ‘যে প্রলোভন এবং যে ভয় জামায়াত দেখিয়েছে তাদের ,সরকার কী তার বিপরীতে সেই সব সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে পেরেছে? কেন এতোদিনেও তাদের বিশেষ নিরাপত্তার জন্য অাইন করা হয়নি? অাইন করতে তো কোন বাধা নেই?’
তিনি বলেন, অামি সরকারকে প্রশ্ন করতে চাই, সাক্ষী নিরাপত্তা অাইন কেন নেই? অামরা এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবার অাগ থেকে সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বলে অাসছি।
নিজামীর অপরাধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রসিকিউটর তুরিন অাফরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিজামী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে অপরাধের “রিং লিডার”। সার্কাসে রিং লিডাররা যেমন বিভিন্ন পশুদেরকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে তেমনি নিজামীও ছিলেন একজন রিং লিডার। তার উস্কানিমূলক বক্তব্যে অনেকে প্ররোচিত হতো।
তিনি ছিলেন ছাত্র সংঘের সভাপতি। তার বিভ্রান্তিমূলক কথায়, অাদেশ, নির্দেশে তখন অাল বদর, অাল শামস বাহিনী কাজ করতো, সুতরাং অাল বদর, অাল শামস বাহিনীর সব কর্মের দায় তার। এমনকি তিনি নিজেও অপরাধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
অাল বদর বাহিনীর প্রধানের মামলার রায় দিতে কেন দিতে হচ্ছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রসিকিউটর বলেন, রায় দিতে কেন দেরি হচ্ছে বলতে পারছি না, এটা অামারও প্রশ্ন। কিন্তু এটা এমন একটা বিষয় যে, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। একটা রায় লিখতে এতোদিন সময় লাগার কথা না।
নিজামীর মামলার রায় নিয়ে সময়ক্ষেপণ প্রসঙ্গে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে জাহিদ রেজা নূর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিজামীর অপরাধের বিচারের রায় নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা কাম্য নয়। ১৯৭১ সালে নিজামী যে অপরাধ করেছেন; তার কোন ক্ষমা নেই। নিজামীর বিচারের রায় ঝুলিয়ে রেখে কেউ যদি ফায়দা লুটতে চায়, তবে সে ভুল করবে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তিতে তরুণ প্রজন্ম বলীয়ান। তাদের যা ইচ্ছে তাই বলে প্রবোধ দেয়া যাবে না।
আলবদরদের শিরোমণি নিজামী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত। তার রক্তরঞ্জিত হাত থেকে রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। জাতি এই নরপশুর হাত থেকে নিস্কৃতি চায়। তার মামলার রায় যদি রাজনৈতিক কারণে পিছিয়ে যায়, তবে সবার জন্যই সেটা অশনি সংকেত।
বুদ্ধিজীবী হত্যামামলার অন্যতম অাসামি নিজামীর মামলার রায় দিতে সময়ক্ষেপণের ব্যাপারে শহীদ অালতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ওদের বিচার করতেই হবে। দরকার পড়লে বাংলাদেশের মানুষ এই কাজটি সমাধান করবে। একটা কথা অামি প্রথম থেকে বলে এসেছি, বাংলাদেশের মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অার ওখান থেকে সরানো যায় না। এখন প্রশ্ন হল ওনারা কি চায়? অামাদের পিঠ কিন্তু দেওয়াল থেকে বেশি দূরে নেই। কতদিন চোখ কান বন্ধ করে রাখবেন তারা।
শাওন অারও বলেন, বাকহারা হয়ে অাছি অামি। এই অপরাধীদের বিচারসহ অারও অনেক দাবির অাওয়াজ চারিদিকে উঠে অাসছে। কিন্তু অামার প্রশ্ন হল অামরা অাসলে কার কাছে এই কথাগুলো বলছি? যাদের বলছি তারা কি অাসলেই নিজেদের অবস্থানে অাছেন নাকি হারিয়ে গেছেন?
ট্রাইব্যুনাল-১ এর আগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলার রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে দুটি মামলা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন অার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর অাপিল শুনানি শেষ হয়ে রায়ের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে।
১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী নিজামী একাত্তরে নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন যার নাম বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) সভাপতি ছিলেন।
একাত্তরের ঘাতক বাহিনী অাল বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন বলে অভিযোগ প্রসিকিউশনের।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন নিজামীকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাংলাট্রিবিউন এ জাকিয়া আহমেদ হতে সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০১৪ সকাল ৯:৩১