কোন ফাঁকে যে হল! ঠাস করে আওয়াজ হওয়ার পর যেন অনুভব করলো গণ্ডারের মত, যে পকেটে একটি ফুটো আছে আর সেই ফুটো দিয়ে আস্তে নিরবে সেল ফোনটি তার শরীর গলিয়ে প্যান্টের পাটাকে টানেল বানিয়ে রাস্তায় থপাস। আরে! নকিয়ার ৩১১০ টর্চ লাইট সেটটাতো এতক্ষণে রাস্তায় তিন পার্ট হয়ে শুয়ে থাকার কথা।
এবার অভিক হাসানের নজর পড়লো পাশের ড্রেনের উপর। ড্রেনের উপরের গাড় ময়লার স্তর ভেদ করে টাইটানিকের মত ধিরে ধিরে ডুবে যাচ্ছে সেই পুরনো সেল ফোন সেটটি, খুব নিরবে, কোন বাঁচাও বাঁচাও হেল্প মি শব্দের বাহুল্য ছাড়াই।
এই সেটটি পুরনো কিন্তু তাতো হারানোর জন্য নয়। এটা যদি কম দামি আর খোয়া যেতেই পারে ঘরানার জিনিস হত, কবে এই সেটের বদলে নকিয়ার কোন একটা দামি সেট তার হাতে থাকতো।
এতক্ষনে ময়লার ঘন স্তরের যেখানে একটি ছোট দরজা কেটে সেটটি ডুব দিল সেই দরজাটি এখন মিলে যেতে শুরু করেছে। অভিক একবার ভাল মত তাকিয়ে যায়গাটা মার্ক করে, রাস্তায় চোখ বুলানো শুরু করতেই, পিছন থেকে কণ্ঠঃ
মামা কি খোয়া গেল,মোবাইল?
অভিকঃ হুম! মোবাইল... বলেই ঘাড় ফিরিয়ে অভিক দেখে, আরে! এইতো আমার মুশকিল আসান। অভিক গদগদ কণ্ঠে
‘মামা মোবাইলটা পুরানা কিন্তু অনেক জরুরী নাম্বার আছে, অভিক এই বলে সেটের মূল মারেফত এড়িয়ে সাধারন ডায়ালগ দেয়।
টোকাই কিছু বলে না বা ঝিম ধরে থাকে, গাঁজার দমের লাগামের টানে।
অভিকঃ মামা তোমারে এক শ টাকা দিমু।
টাকার কথায় টোকাইয়ের গাঁজার দমের লাগাম হালকা হয়।
টোকাইঃ নাহ মামা একে হইবো না।
অভিকঃ ক্যান মামা আজকের দিনের খরচ হইয়া যায় তোমার।
টোকাইঃ নাহ! দুই দিন ধইরা না খাইয়া, ‘ব্যবস্থা’ করতাছি। আজকে খাওন না পাইলে গাঁজার দম না আমার নিজের দম বাইর হইয়া যাইব মামা।
অভিকঃ আচ্ছা মামা তুমি তুলো তোমারে দুই শ দিমু।
টোকাই আর কথা না বাড়িয়ে হাতের ব্যাগটা এক পাশে রেখে হাত ঢুকিয়ে দেয় ড্রেনের গভীর অন্ধকারে। হাতটা নাড়া চারা দিয়েই প্রায় সাথে সাথেই সে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তমের মত উদ্ধার করে, মোবাইলের প্রানহীন দেহটি।
মোবাইলটা টোকাইয়ের হাতে দেখে অভিকের মুখে একটি ঈদের বাঁকানো চাঁদের মত হাসি ফুটে উঠে আবার ফোঁটা মাত্রই ধূমকেতুর মত হাসিটা হারিয়ে যায় নিমিষে। ড্রেনের ময়লাগুলো জোঁকের মত মোবাইলটার দেহ জড়িয়ে ঝাপটিয়ে আছে।
অভিকঃ মামা তুমি দুইশ টাকা নাও। আর শুনো আজকে আমার সাথেই দুপুরে খাও। এই ভাত ডাল ভর্তা আরিকি বুঝই তো ছাত্র মানুষ।
টোকাইঃ হ মামা ভাত ডাল ভর্তাই চলুক, দুই দিনের খালি পেটে এইই মোরগ পোলাও মনে হইব। আর মোরগ পোলাও আমার পেটে সইবো না। মাল পেটে গেলে মোরগ পোলাও আমার পিছন দিক না, সামনে দিয়া বাইর হইয়া আইব। কুত্তার পেটে কি আর ঘি সয় কন মামা?
অভিকঃ মামা তুমি মনে হয় ম্যালা গেয়ানি ইনসান। এক কাম কর এই দুই শ টাকা দিয়া একখান ভার্সিটি খুইলা ফেল।
অভিক হোটেল থেকে পানির জগ নিয়ে পানি ঢালতে থাকে। আর টোকাই হাত নেরে নেরে মোবাইল পরিষ্কার করে।
*
হ্যালো! হ্যালো! কিরে ফোন তো মনে হয় বন্ধ। তিন্নির মা এই তিন্নির মা!
দেখো তো তুমি একটা ফোন দাও। কেন কি হইছে? ফোন তো বন্ধ। এই তিন্নি তিন্নি তুই একটা ফোন দে।
মা ভাইয়ার ফোন তো বন্ধ। না তো ও কক্ষনো ফোন বন্ধ রাখে না। তাহলে মনে হয় চার্জ শেষ মা। উহু! আমার চারজার দিয়েই তো কাল রাতে ও ওর ফোন চার্জ দিল তাই না, তিন্নির মা? হা তাই তো। তাহলে?
ও কোথায় গেছে? বললো তো রাবেয়াদের বাসায়। রাবেয়াদের বাসা থেকে আসতে এতো সময় লাগে! রাবেয়াদের বাসায় একটা ফোন দে তো তিন্নি।
তিন্নিঃ হ্যালো রাবেয়াদি
রাবেয়াঃ হুম বল
তিন্নিঃ ভাইয়া কি তোমাদের বাসায়?
রাবেয়াঃ না তো। ও তো সেই কখন চলে গেছে। আমাদের বাসায় বড় জোর আধা ঘণ্টা ছিল। কত বললাম আরেকটু থাক ঢাকা থেকে সেই কবে না কবে আসিস আবার। কেন ও এখনো বাসায় যায় নাই?
তিন্নিঃ না। তোমাকে কিছু বলেছিল।
রাবেয়াঃ হুম্মম! বললো তো বাসায়ই যাবে।
কিরে রাবেয়া কার সাথে কথা বলিস?
রাবেয়াঃ এই তুই না চলে গেলি কখন। তুই বাসায় যাস নাই?এই তো তিন্নি অভিক তো আমাদের বাসায় আবার আসছে।
তিন্নিঃ ভাইয়াকে ফোন টা দাও তো দিদি
অভিকঃ রাবেয়া বল আমি বাসায় আসতাছি
রাবেয়াঃ ফোন তো ধর
অভিকঃ নাহ। খালা কোথায়?
রাবেয়াঃ কিরে কি হইছে তোর?
অভিকঃ খালা কোথায় গাধি তাড়াতাড়ি বল?
রাবেয়াঃ এই তো রেহানা ফুপুর বাড়ী গিয়েছে এই এসে যাবে। তোর ফোন কোথায়?
অভিকঃ তোর ঘরে চল। ধর।
রাবেয়াঃকি এটা
অভিকঃ দেখিস না?
রাবেয়াঃ টিস্যু!
অভিক হেসে দিয়ে বলে একের ভিতর দুই টিস্যু আবার চিঠিও আর চিঠি। পড়া শেষে টিস্যু মনে করে মুখে মুছিস না।
রাবেয়াঃ চিঠি! এই যুগে চিঠি! কে দিল?
অভিকঃ খুলে দেখ। সায়েম ভাই।
রাবেয়াঃ এই সায়েমের সাথেতো আমার কথা হয়েছিল।
অভিকঃ যেই কথাগুলো বলা হয় নাই তা এই চিঠিতে আছে।
রাবেয়াঃ মানে!!
আরেকটু থাক ঢাকা থেকে সেই কবে না কবে আসিস আবার। এখন কোথায় যাবি?
অভিকঃবাসায়।
অভিক রাবেয়াদের বাসা থেকে নিজের বাসার দিকে একটু যেয়ে কি ভেবে আবার উল্টো হাটা দেয়।
অভিক এই অভিক
অভিক চমকে যেয়ে পিছে তাকিয়ে দেখে সায়েম ভাই।
অভিকঃ সায়েম ভাই কেমন আছেন?
সায়েমঃ হা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
অভিকঃ ভালো
সায়েমঃ চল একটু ফেরি পাড়ে যাই।
অভিকঃচলেন
সায়েম অভিক ফেরি পাড়ে গেলে সায়েম বলেঃ
অভিক চল ফেরি করে ওপার থেকে একটু ঘুরে আসি।
অভিকঃ ভাই বাসায় দেড়ি হয়ে যাবে।
সায়েমঃ আরে ধুর মিয়া এতো দিন পর ঢাকা থেকে আসলে আমাদের একটু সময় দিবে না। বাসায় ফোন করে দাও সমস্যা কোথায়?
সায়েম অভিক ফেরীতে চড়ে বসে। সায়েম অভিক ফেরীর একেবারে সামনের রেলিংএর কাছে যেয়ে দাড়ায়।
সায়েমঃ তোমার ফোনটা একটু দাও তো ভাই
অভিক ফোনটা দিতেই সায়েম মুখস্ত একটা নাম্বার দ্রুত টিপে। ডায়াল করতেই দেখা যায় সেই নাম্বারটা সেইভ করাই আছে, যা স্বাভাবিক।
অন্য পাশে ফোন রিসিভ করতেই সায়েম হাটতে থাকে আর কথা বলতে থাকে। অভিক রেলিং ধরে দাড়িয়েই থাকে।
হাটতে হাটতে তাড়িয়ে তাড়িয়ে কথা বলছে সায়েম হটাত যেন ফোনের স্পিকারটা মাইকে পরিণত হয়ে এক চিৎকার দিল আর সেই চিৎকারে সায়েম আতংকিত হয়ে দিল একটি লাফ। সাথে সাথে আতঙ্কিত হল হাতে ধরা ফোন সেটটিI। ফোন সেটটি আতঙ্কিত হয়ে হাতের বাঁধন হালকা করে দিলো এক লম্বা ডাইভ। এক ডাইভে একদম নদীর বুকের গভীর অতলে।
হাটতে হাটতে তাড়িয়ে তাড়িয়ে কথা বলতে বলতে কোন ফাঁকে যে সায়েম ফেরীর হর্নের সামনে এসে দাঁড়ালো তা সে টের পেলো হারে হারে সাইরেনের আর্ত চিৎকারে।
সায়েমঃ অভিক তুমি আমার সেটটা নিয়ে ব্যবহার কর।
অভিকঃ না ভাই এমনিতেই আমার একটা নতুন সেট নেয়ার কথা ছিল। আমি আবার পুরনো সেট কিনিও না বেচিও না। অভিক হেসে দিয়ে বলে এখন শুধু আমি কেন কোন মানুস্য পুত্র বা পুত্রি আর আমার পুরনো সেটটা ক্রয় বিক্রয় করতে পারবে না। নাহ ভাই বাদ দেন যা হইছে তা জানের সদকা হইছে।
সায়েমঃ ভাই তুমি আমার সেটটা যখন মন চায় নিয়ে যেও। আর বাসায় যাওয়ার পথে...দাড়াও তোমার কাছে কাগজ আছে?
অভিকঃ না ভাই তবে মুখ হাত মোছার মোটা টিস্যু পেপার আছে।
সায়েমঃ কলম আছে?
অভিক লাজুক হাসি দিয়ে বলে, না তবে তিন্নি আমাকে একটা কাজল পেন্সিল দিয়েছিল রাবেয়াকে দেয়ার জন্য, ভুলে গিয়েছিলাম, চলবে?
সায়েমঃ চলবে মানে এই মুহূর্তে দৌড়বে। তুমি তাহলে রাবেয়াদের বাসায় যাচ্ছ আবার?
অভিকঃ জী!
সায়েমঃ কাজলটা দিতে?
অভিকঃ ও হ্যা যাচ্ছি।
মাঃ কিরে অভিক এতো দেড়ি হল কেন? তোর বাবা ফোন দিল তোকে ঔষধ আনার জন্য।
অভিকঃ সেটটা হারিয়ে গেল।
মাঃ কিভাবে?
বাবাঃ যাইহোক তুই আমার এই নোকিয়া সেটটা নিয়ে যা আপাতত। ঢাকায় যখন যাবি তখন তোর সাথে কথা তো বলতে হবে তবে ঢাকায় যেয়ে একটা ব্যাটারি কিনে নিস। ব্যাটারিটায় দম কম।
*
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৪ রাত ১০:১০