১.
তখন ক্লাস থ্রী কিংবা ফোরে পড়ি। আমাদের সিনেমাপাগল এক বন্ধু নাম জসিম; সিনেমার পোকা তার মাথায় সারাক্ষণ কিলবিল করে। বাসার পাশে সিনেমা হল থাকায় পোকার বংশবিস্তারেও সুবিধা হয়। কথায় কথায় সে সিনেমার গল্প শুনায় আমাদের। আমরা গল্পশুনি আর আফসোস করি, আহ! আমাদের বাবা যদি জসিমের বাবার মত এমন ভাল হত। সিনেমা দেখলেও যে ছেলেকে মোটেও গালমন্দ করেন না।
একদিন দেখি জসিম গুনগুনিয়ে মনের সব দরদ মিশয়ে গান গাচ্ছে, খবরের কাগজে নাম তো ছাপা হবে না।
জিজ্ঞেস করতে বলল- এটা তিন কন্যা সিনেমার গান। সুচন্দা, চম্পা ববিতা তিন বইন এক লগে অভিনয় করছে। ববিতারে যা মর্ডাণ লাগছে না এই সিনেমায়। শুনে আমাদের আফসোসের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল এতই মজবুত আর সাহসের শক্তি এতই দূর্বল যে নিষ্ঠুর বাবাকে মনে মনে অভিসম্পাত করা ছাড়া আর কোন উপায় খুজে পাই না। তবে একটা কাজ করি, মনে মনে পণ করি ভবিষতে যখন বাবা হব, বাবার মতো এমন নিষ্ঠুর, নির্দয় হব না; ছেলে যদি সিনেমা দেখতে চায় অবশ্যই দেখতে দেব; ভরদুপুরে ক্রিকেট খেলতে চাইলেও কোন আপত্তি নেই। এমনকি ভরা বর্ষায় ফুটবল খেলে সারা গায়ে কাদা মেখে এসে যদি বলে- আজকে আমরা চারটা গোল খেয়ে হেরে গেছি; একটুও না বকে শান্ত্বনা দিয়ে বলব- হেরে গেছো তো কি হয়েছে? তুমি অন্তঃত খেলতে তো পেরেছো; তোমার বাবাতো সেই সুযোগই পায়নি। শুধু দূর থেকে তাকিয়ে দেখেছে।
২.
একদিন বাংলা স্যার ক্লাসে এসে বলেন সবাই তার নিজ বাবাকে নিয়ে অল্প কথায় গুছিয়ে লিখবে। বই দেখা যাবে না। আমরা যথারীতি লিখে খাতা জমা দেই। স্যার আমাদের খাতা নিঃশব্দে পড়তে থাকেন আর আমরা সেই সুযোগে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করি। হঠাৎ টেবিলের উপর বেতের বাড়ির শব্দ শুনে স্যারের দিকে তাকাই। পুরো ক্লাস নিঃশব্দ। এক হাতে বেত আর অন্য হাতে একটা খাতা চোখের সামনে নিয়ে স্যার শব্দ করে পড়তে থাকেন-
'আমার বাবার নাম.........। উনি একজন সরকারী অফিসার। সড়ক ও জনপদ বিভাগে কাজ করেন। উনি একজন বড় ঘুষখোর। বরই গাছে ঝাকুনি দিলে যেমন ঝুরঝুর করে এক সাথে অনেকগুলো বরই পড়ে, তেমনি আমার বাবা প্রতিদিন অফিস থেক এসে যখন উনার প্যান্ট ঝাকুনি দেন, প্যান্টের দুই পকেট থেকে ঝুরঝুরিয়ে টাকার নোট মাটিতে পড়তে থাকে। আমার বাবার শাস্তি হওয়া উচিত।'
স্যার জসিমের দিকে তাকান, স্যারকে অনুসরন করে পুরো ক্লাস। আমরা ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করতে থাকি কখন স্যারের বেত শহীদ হবে জসিমের শরীরের উপর। ক্লাসে পিনপতন নিরবতা। আমাদের আবাক করে দিয়ে মারপিঠের ধারে কাছে না গিয়ে স্যার শুধু জসিমকে উদ্দশ্য করে বলেন- 'তোমার সৎ সাহস দেখে খুশী হইছি। তবে নিজের বাবা সর্ম্পকে এভাবে বলা ঠিক হয় নাই। আর কখনো বলবা না।'
জসিম আর কখনো কোন লেখায় এভাবে তার বাবা সর্ম্পকে লেখে কি না, আমরা জানি না। কারণ পরের বৎসর জসিমের বাবা সিলেট থেকে বদলী হয়ে অন্যত্র চলে যান। আর আমরা হারাই আমাদের এক সাহসী পাগলাটে বন্ধুকে যে গুন গুনিয়ে গান গাইত-খবরের কাগজে নাম তো ছাপা হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ৯:৩৮