somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুই বন্ধু

০৫ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শুক্রবার। তাই স্কুল বন্ধ আজ। রণি আর রমিম সাতসকালেই বাঁশবনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। দু’জনেরই চোখ বাঁশের মিনমিন করা আগডালের দিকে ঘুরতে থাকে। তারা পাখির বাসা খোঁজে। গত শুক্রবারও একসাথে পাখির বাসা খুঁজেছিল তারা। সেদিন একটি পাখির বাসা অবশ্য তারা পেয়েছিল কিন্তু সেটাতে না ছিল পাখির ডিম না ছিল ছা। তারা ভেবে নিয়েছিল যে হয়তো কয়েকদিন আগেই সে বাসা থেকে মা বক ছা বক সহ উড়াল দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। সেটা যে বকের বাসা ছিল রণি তা বাঁশঝাড়ের নীচে বিষ্ঠা দেখেই টের পেয়েছিল। কারণ রণির ধারণা পাখির মধ্যে বকই বেশি পায়খানা করে আর তা চুনের মত সাদা হয়। রণির এধারণার পেছনে অবশ্য আরও একটি কারণ আছে।

পাচ-ছয় মাস আগের কথা। রণি সেদিন একাই বাঁশবনে গিয়েছিল। একমনে পাখির বাসা খুঁজতে খুঁজতে বাঁশঝাড়ের নীচে একগাদা চুনসাদা পাখির বিষ্ঠা দেখতে পায় সে। উপরের দিকে তাকালে খড়কুটো দিয়ে তৈরি একটি পাখির বাসাও তার নজরে আসে। মুহূর্তের মধ্যে বাঁশের কঞ্চি বেয়ে উপরে উঠে দুটি বকের ছানাও আবিষ্কার করে ফেলে সে। সেদিন থেকে বাঁশঝাড়ের নীচে পাখির চুনসাদা বিষ্ঠা মানেই নিশ্চিত বকের বাসা।

না আজ আর পাখির বাসা পাওয়া গেল না। এবার তারা আমেনা বুড়ির দেশি পেয়ারা চুরি করে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বুড়ি একা মানুষ। আর অধিকাংশ সময় বেটির বাড়িতে থাকে। চুরি করে পেয়ারা খাওয়ার এইতো মোক্ষম সময়।

আশেপাশে জনমানুষ না থাকায় দুজনেই ঝুলন্ত ডাল বেয়ে গাছের একেবারে মগডালে উঠে পড়ে। সবুজ পেয়ারা পেকে সাদা হয়ে গেছে। বুড়ি এত উপরের পেয়ারা কখনো নাগাল পায় না। ওরা জানে মগডালের পেয়ারা শুধু ওদের দুজনেরই। পিলপিল করে কালো কালো পিঁপড়াগুলি দুজনের শরীরে উঠতে থাকে। ভ্যাগ্যিস কালো পিঁপড়াগুলি কামড়ায় না। ঝটপট তারা পাকা পেয়ারাগুলি প্যান্টের পকেটে ভরতে থাকে। কোন কোন পেয়ারা থেকে অর্ধেক অংশই গায়েব হয়ে পাখি কিংবা বাদুড়ের পেটে চলে গেছে। পাখি খাওয়া পেয়ারা রণির ভীষণ পছন্দ। গাছের মধ্যেই পিঁপড়াসহ কতক পেয়ারা তারা খেয়ে ফেলে। এরপর তড়িঘড়ি করে পকেটভর্তি পেয়ারা নিয়ে দুজনেই গাছ থেকে নেমে পড়ে। পাছে কেউ দেখে ফেলে। আশেপাশে মানুষ না থাকায় অগত্য তারা বুড়ির ঘরে ঢুকেই বাঁশের চাটাইয়ের খিড়কী আটকিয়ে দেয়। সাদা-সবুজ পেয়ারা কামর দিতেই পেকে লাল হয়ে যাওয়া খসখসে বিচিযুক্ত অংশ তাদের চোখে ঝিলিক খেলে যায়। পেয়ারা চিবাতে চিবাতে দুজনেরই দাঁতের মাড়ি অবশ হয়ে আসতে শুরু করে। এরপর দুপুর হলেই তারা পুকুরে ডুবতে থাকে। কচুরিপানার চাদর বিছানো পুকুরে ডুবতে ডুবতে তারা চোখ রক্ত লাল করে বাড়িতে ফেরে।অধিকাংশ সময়ই মায়ের হাতের বারি খেয়ে দুপুরের ভাত খাওয়ার আগেই কেঁদেকেটে ঘুমিয়ে পড়ে।বিকেলে খেলার মাঠে আবার দুজনের দেখা হয়।
একসাথে খেলাধুলা,লেখাপড়া,গোসল,পেয়ারা চুরি,পাখির বাসা খোঁজা তাই তারা বন্ধু। কোন কারণে কোথাও বেড়াতে গেলে বা আত্নীয়ের বাসায় গেলে, একজন আরেকজনকে একদিন না দেখলে দুজনেরই মনটা যেন কেমন কেমন করে।

রণির বয়স দশ বছর আর রমিমের নয়। রণির আর কোন ভাই-বোন নেই। বাবা অন্যের ক্ষেতে কাজ করে আর মা গরু-ছাগল দেখাশুনা করে। বাবা হাসমত আলী আর মা আম্বিয়ার দুঃখ অনেক। আট-দশ বছর সংসার করার পরও যখন কোন সন্তানের দেখা নাই তখন কোন দম্পতির মনে কি সুখ থাকতে পারে ? পাগলি মা জমিলার কাছ থেকে রণিকে তারা দত্তক নিয়েছিল। পাগলি মা সন্তানের দেখভাল করতে পারবে না আর এদিকে তাদেরও সন্তানের দরকার তাই এই পথের আশ্রয় নিয়েছিল তারা। শত হোক মা তো মা-ই। সে পাগলি হোক আর ভালোই হোক। মায়ের তুলনা কোনকিছুর সাথে হয় না। সেদিন নিয়তির কাছে অসহায় হয়ে চোখের সাগরে ভেসেছিল পাগলি মা। তখন রণির বয়স মাত্র সাত দিন। আম্বিয়া গরু-ছাগলের দুধ গরম করে খাওয়াতে থাকে ফুটফুটে রণিকে। রণি এখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। সে হাসমত-আম্বিয়াকেই আপন মা-বাপ হিসেবে জানে। রণির বাবা-মা অশিক্ষিত তাই তার পড়াশুনার তেমন চাপ নেই। সে একবেলা পড়ে তো বাকি সময় পইপই করে ঘুরে বেড়ায় আর সচেতনভাবে লক্ষ্য করে কার গাছে কোন ফল পাকলো,টুনটুনিটা কোন গাছে বাসা বাঁধলো, ঘরের চালের বাবুইটা কখন বাচ্চা দেবে, কখন মাকে ফাঁকি দিয়ে মায়ের বাক্স থেকে দুটি টাকা চুরি করে জমসেদ দোকানদারের কাছ থেকে সন্দেশ খাওয়া যাবে।

রমিমের বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মা বিয়ের আগে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল। বাবা-মা শিক্ষিত বিধায় পড়াশুনার একটু তাগিদ বেশি রমিমের প্রতি। সারাক্ষণ পড়াশুনার কথা কে শোনে? একটুখানি ফাঁক-ফোঁকর পেলেই রমিম-রণি দুজনেরই টিকিটা খুঁজে পাওয়া যায় না। রমিম রণির সাথেই পড়ে। একমাত্র ছোট বোনটির বুলি ফুটছে কেবল। রমিমকে অমি বলে ডাকে। সারাক্ষণ ভাইটির সাথে খেলতে চায় ছোট বোন রেমা।

আরো কিছুদিন পরের কথা। রণি –রমিম দুজনেই পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা দিলো। রমিম ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল কিন্তু রণির ভাগ্যে বৃত্তি জুটলো না। দুজনেই বড় হতে থাকলো কিন্তু দস্যিপনা কমে না। আজ এ বিচার দেয় আমার আনারস গাছে আনারস নেই ,কাল ও বিচার দেয় যে আমার শসা গাছে শসা নেই। বাধ্য হয়ে বাবা মা পাড়া-পড়শির কটু কথা হজম করে চলে। ছেলে দুষ্টু হলে অন্যের কটু কথা তো সহ্য করতে হবেই। এবার অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা হলো।ফলাফল আগের মতোই।অল্প কিছুদিন পরে রণির বাবা হঠাৎ প্যারালাইজড হলো আর রণির পড়াশুনার পাঠ এখানেই চুকলো।

দশ বছর পরের কথা। রণি প্রান্তিক কৃষক। জমিতে ভালো ফসলের আশায় কৃষি ব্যাংকে ঋণের জন্য রণি জেলা শহরে চলে আসে। ব্যাংক কর্মকর্তার দিকে তাকাতেই তার মনে হয় এই মুখটি তার কাছে খুবই পরিচিত। মনে মনে ভাবে এ যে তার বাল্য বন্ধু রমিম। আবার ভাবে না সে নাও হতে পারে । কত দিন হলো রমিমের বাবা-মা পরিবার সুদ্ধ শহরে চলে এসেছে । শহরে নাকি তার বাবা একটি স্কুলও তৈরি করেছিল। তাও লোকমুখে শোনা কথা। যোগাযোগই নেই তাদের সাথে কত বছর। অনেক লোকই তো কখনো কখনো দেখতে অনেকটা একইরকম হয়। তারপরও একটু সাহস সঞ্চয় করে ‘ স্লামালিকুম’-বলে সে তার কল্পিত বন্ধুটির দিকে চেয়ে থাকে।

রমিমের চিনতে কষ্ট হয় না সে যে তার বন্ধু রণি। দুজন দুজনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। আগের সেই রোগাপটকা রমিম আর তেমনটি নেই। তার শরীর স্ব্যাস্থ এখন অনেক সুঠাম। আগে চোখে চশমা পরতো না কিন্তু এখন সে চশমা পড়ে। অন্যদিকে রণির সে নাদুসনুদুস চেহারাও বদলে গেছে। অভাবের কারণে ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে গিয়ে যুবক বয়সেই বার্ধ্যক্যের ছাপ লেগে গেছে। দুজনেই কুশলাদি বিনিময় করতে থাকে। তারা ফিরে যায় সেই নীলকন্ঠ গ্রামে যেখানে তারা একসাথে পাখির বাসা খুঁজেছিল।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×