আচমকা ঘুমের ঘোরেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে বেলায়েত। কি দুঃস্বপ্নটাই না সে দেখেছে। এরকম স্বপ্ন দেখার পর কার চোখে না পানি আসবে ? কে হাসি-খুশি থাকতে পারবে ? এখনো ভয়ে,আতঙ্কে,স্বজন হারানোর বেদনায় বেলায়েতের বুকটা হাতুড়ি পেটানো ঘন্টার মত কাঁপছে। একটু আগে কাঁপুনিটা অনেক বেশি ছিল। তবে এখন কিছুটা কমতে শুরু করেছে। সম্বিত ফিরে পেয়েছে সে।
দুঃস্বপ্নটা দেখার পর থিতু হয়েই সে বাবার কাছে ফোন করেছে। মোবাইলে রিংটোনটা বেজে উঠতেই মা বুঝতে পেরেছে যে নিশ্চই বেলায়েতের ফোন। মোবাইলের শ্যামলা বাটনটি চাপ দিতেই বেলায়েতের আধকান্না সমেত কন্ঠ মায়ের কানে পৌঁছায়। ছেলের টাকায় কিনে দেয়া মোবাইলটার শ্যামলা বাটনটা চাপ দিয়ে রিসিভ করা আর লাল বাটনাটা দিয়ে কেটে দেয়া এটুকুই জানে অশিক্ষিত মা গুলনাহার। পরিবারের একমাত্র ছেলে বেলায়েত এই মূহুর্তে যতই হাসি-খুশিভাবে কথা বলার চেষ্টা করুক না কেন মা ঠিকই টের পায়। মা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে,”বাপ মোর কি হইছে তোর মোক তুই খুলি ক। “ প্রথমত কিছু হয়নি বললে মা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। পরে সে ঠিকই বলে যে সে একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সে বলেনি যে তার দুঃস্বপ্নের বিষয়টি ছিল তার বাবার মৃত্যু। বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে মা গুলনাহার বলে,”তোর বাপ তো ঐ সাত সকালে চরত গেইছে ,ওডে কালাইবাড়ি খেন নিড়বেইছে তিনদিন থাকি। আর দুইটে দিন নিড়েইলে শ্যাষ হবার পায়।“বেলায়েত মাকে ধমকের সুরে বলে বুড়ের বেটার কাজ না করলে হয় না। টাকা-পয়সা কি আমি বিদেশ থেকে পাঠাই না ?
বেলায়েতের মা ঠিকই ওর বাবাকে বলে,কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেই ছোটবেলা থেকে যার কাজ করার অভ্যাস সে কি কাজ না করে এক মূহুর্ত থাকতে পারে ?
বেলায়েতের বাবা বরকত আলী। বয়স পঁয়ষট্টি। তেল কালো শরীরটা রোদে বৃষ্টিতে কাজ করতে করতে তামাটে করে ফেলেছে। যতই দিন যাচ্ছে সারা শরীরের চামড়াগুলি কেমন যেন বস্তায় এলোমেলোভাবে রাখা কাপড়ের মত ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে। বরকত আলী টুথ পেস্ট কিনে অযথা টাকা-পয়সা নষ্ট করতে চায় না তাই সে নিম গাছের ডাল দিয়ে নিয়মিত মেছয়াক করে । চৌদ্দ পুরুষের পালিত রেওয়াজের বাইরে সে যেতে পারে না। বয়স হলে কি হবে একটা দাঁতও তার এখনো পড়েনি,এমনকি দাঁতের গোঁড়াও কখনো নড়চড় হয়নি। ব্রাশ আকৃতির নিমের ডাল শেষ হয়ে গেলে উঠানে ছেলের বয়সী গাছটি হতে ডাল কেটে ডজন দু’য়েক নিম ডালের মেছয়াকের ব্রাশ তৈরী করে একটি পলিথিনে করে মাচাঙ্গের উপর রেখে দেয় সে। মাচাংটা আলু,মাসকলাই,পেয়াজ,রসুন,শুকানো মরিচ,আদা,তিল,তিসি আর তোষা পাটে পরিপূর্ণ। মাচাংটাই বরকত আলীর গুদামের কাজ করে। আর আলাদা একটা ঘর তার শুধু ধান মজুদের কাজে ব্যাবহৃত হয়। বাজারে দাম ভালো থাকলে সে পাইকার ডেকে যতন করে রাখা এসব ফসল বিক্রি করে দেয়। নগদ টাকা পেয়ে তার মনে হয় যে কষ্টটুকু ওসুল হলো।
বরকত আলীর টাকা পয়সার অভাব নেই। তারপরও শখ করে একটি বেশি দামী লুঙ্গি কিনে না সে। সারাক্ষণ একটা চেকের পলিয়েস্টার লুঙ্গি আর হাফ হাতা সাদা গেঞ্জি পরে থাকে সে। হাটে-বাজারে বা আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে সাদা পাঞ্জাবিটা পরে যায় বরকত আলী। পাঞ্জাবিটা নতুন অবস্থায় সাদা ছিল কিন্তু এখন আর সাদা বলা যায় না। শরীরের ঘাম লাগতে লাগতে তেল চিটচিটে হয়ে গেছে। তারপরও এটাই তার প্রিয় পোশাক। নিজের ছেলে,স্ত্রী,পাড়া-পড়শি যে যাই বলুক না কেন সে নিজের মতই চলে। আর এরকম না হলে সে বছরে বছরে জমি কিনবে কি করে?
স্ত্রী গুলনাহার কত কথাই বলে-বয়স হয়েছে এখন একটু ভালো কাপড়টা পরেন, ভালোটা খান কিন্তু বরকত আলী তার নীতিতেই অটল। তার কষ্টের ফসল এই হাফ বিল্ডিং বাড়িটা,বিঘে পঁচিশেক জমি,ধান ভাঙার মিলটা ,সেচ মেশিনটা আর এই সংসারের সুখটুকু। সে বিশ্বাস করে যে টাকা-পয়সা না থাকলে সমাজে ব্যক্তি মানুষের কোন মূল্য নেই। তার এত সবকিছু আছে বলেই গ্রামে মিটিং সালিশে তার ডাক পড়ে,শিক্ষিত লোকের সাথে বসতে পারে সে। ছোটবেলায় অর্থাভাবে লেখাপড়া করতে পারেনি সে কিন্তু এখন তার আর কোন আক্ষেপ নেই। মান-সম্মান,টাকা-পয়সা এখন কি নেই তার।
কিন্তু বরকত আলী একদিনেই এই অবস্থানে আসতে পারেনি। এখন তার টাকা –পয়সার অভাব নেই কিন্তু একসময় তার তেমন কিছুই ছিল না বললেই চলে।
২০০৬ সালের কথা। সেবার তার জমি-জমা যা ছিল কিছু বিক্রি করে আর কিছু বন্ধক রেখে দুই লাখ টাকা ম্যানেজ করে সে। আত্নীয়-স্বজন আর পাড়া –পড়শির কাছ থেকে ঋণ করে সব মিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা তার এক আত্নীয়কে দিয়ে ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে সে। প্রথম বার বেলায়েতের কপাল সুপ্রসন্ন ছিল না। ভিসা জাল হওয়ার কারণে বিদেশে ছয় মাস জেল খাটার পর দেশে ফিরতে হয়েছিল একেবারে শূন্য হাতে।
তারপরও বাবা-ছেলে আসা ছাড়ার মানুষ নয়। এবার বন্ধক রাখা জমি ক’টা বিক্রি আর কড়া সুদে টাকা নেয়ার পর শেষমেশ বিদেশ যেতে পেরেছিল সে। তারপর মাস তিনেক পর থেকে টাকা পাঠাতে শুরু করে বেলায়েত। এরপর তার পরিবারকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সে টাকা পাঠিয়েছে আর বরকত আলী ঋণ পরিশোধ করেছে। ঋণের বোঝা মাথা থেকে নামলে সে হারানো জমি পুনরুদ্ধার করেছে। এরপর নতুন কিছু জমিও কিনেছে সে। বেলায়েত যে অস্ট্রেলিয়ায় নাপিতের কাজ করে তা বাবা,মা,স্ত্রী কাউকেই বলেনি । শুধু বলেছে যে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট সংক্রান্ত কোন অফিসে সে চাকরী করে। দীর্ঘ সাত বছরে তিনবার দেশে এসেছিল সে। এখন তার দুটি সন্তান,বাবা-মাকে নিয়ে সুখেই দিন পার করছে বেলায়েত।
ঘুম থেকে উঠে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিস্থ বাঙ্গালীপাড়া লাকেম্বায় বাংলাদেশের কুমিল্লার আমিনুল ভাইয়ের’ খুশবু’ রেস্তোরায় নাস্তা সেরে কর্মস্থলে গিয়ে তার দৈনন্দিনের কাজ শুরু করে বেলায়েত। দিনান্তে ক্লান্ত শরীর নিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফেরে সে। বাসায় ফেরার পথে আমিনুলের রেস্তোরায় রাতের খাবারটাও সেরে নেয় বেলায়েত। ছোট্ট একটি রুমে গাদাগাদি করে বারো জন বাংলাদেশী একত্রে থাকে । এতে করে সল্প খরচে চলতে পারে ওরা।
আবার সকাল হলে বেলায়েতকে বাঙ্গালীপাড়ায় আমিনুলের রেস্তোরায় নাস্তা করতে দেখা যায়। এই রেস্তোরাটি দেশের মানুষ দ্বারা পরিচালিত বিধায় খরচ একটু কমই পড়ে। তাছাড়া দেশি খাবার যেমনঃ ভর্তা, ভাজি,খিচুরি,তেহারি,মাছ ভাত,ডাল সবজি,মাংস,মিষ্টি সবকিছুই পাওয়া যায় এখানে। এখানে এলেই সে একটু পেট পুরে খেতে পারে। আর এখানে যতক্ষণ সে বাঙ্গালী ভাইদের সাথে থাকে ততোক্ষণ কেমন জানি সুখ সুখ লাগে বেলায়েতের। দেশের মানুষের খবরও নিতে পারে সে। কতক পরে কর্মব্যস্ত বেলায়েতকে আবার পরদেশিদের চুল কাটতে দেখা যায়। সে চুল কাটতে থাকে আর নিজ দেশের মানুষগুলির কথা ভাবতে থাকে। তখন তার চোখে ভাসে কলকলিয়ে চলে যাওয়া ব্রক্ষ্মপুত্রের ঢেউ,সবুজ ধানক্ষেত, প্রিয় গ্রামখানি,বাবা-মা,স্ত্রী-সন্তানদের সাথে কাটানো খন্ড খন্ড চিত্রগুলি।
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন