শেষ চৈত্রের রুক্ষতায় ঝড়া পাতার মত ঘুমিয়ে থাকা সকাল, অলস দুপুর আর নির্ঘুম রাত করে সময়গুলো কেটে যাচ্ছে। বসন্ত এসে গেছে, নিকশ অন্ধকারে ডুবে থাকাদের কাছে বসন্তের আগমন আনন্দের নয়, জীবন নামের বৃক্ষ থেকে কিছু পাতা হারানোর ভয় মাত্র। ভয়ংকর কাল বৈশাখীর সাথে প্রাণ-পণ লড়াই করে আমের মুকুলের মত করে বেঁচে থাকারা একগুচ্ছ কদম হয়ে বর্ষা নিয়ে আসে না। পড়ার টেবিল, অসময়ের আড্ডা, পেন্সিল কাটার, ফুলদানি, পুরনো দিনের গান, ছেঁড়া কাগজ কিংবা ধোয়া ওঠা এক কাপ চায়ের মত বৃষ্টি আমার ভীষণ প্রিয়। বিনা নোটিশে বৃষ্টির সন্ধ্যা নামে মনের জানালা বেয়ে। একটু পরে শোকের রং-এ ছেয়ে যাবে চারপাশ। বৃষ্টির জলে ধুয়ে ক্রমশ স্পষ্ট হওয়া ধুলোমাখা কিছু স্মৃতির সাথে সাপ-লুডু খেলার প্রেরণা পেপার রাইম এর ‘অন্ধকার ঘরে কাগজের টুকরো ছিঁড়ে কেটে যায় আমার সময়’ অন্ধকার নাকি আলোকস্বল্পতা? হোক আলো বা অন্ধকার তাতে কি? বেঁচেই আছি যে অন্ধকারে। হ্যাঁ, অন্ধকার। এটাকেই আমার আপন মনে হয়। অনেক কথা জমে গেছে, লিখতে গেলে অবলীলায় জন্ম নেবে নিদ্রাহীন রজনী। এরপর সকাল বলে মধ্য দুপুর করে ঘুম ভাঙবে বালিশের নিচে লুকিয়ে থাকা ভাইব্রেট করা সেলফোনের বোবা কান্নায়। আবার মনের দেয়ালজুড়ে ছড়িয়ে দেবে বিষন্ন তিক্ততা। এমন নির্লিপ্ত ছিলাম না। সময়ের প্রয়োজনে ক্ষয়ে যাচ্ছি। বদলে গেছি অনেক, সরু হয়ে আসছে আবেগের বহমান নদী। হতে পারে শূন্যতা। সত্যি কি তাই? গণিতের ভাষায় শূন্যের আবার আলাদা সংজ্ঞা আছে। শূন্যের মাঝেও কেউ আবার অসীমতার আশা নিয়ে বেঁচে থাকে, জীবনের হিসেব কষে সাদাকালো ক্যানভাসে। আজ কোচিং-এর শেষ ক্লাসটা হয় নি, দুর্মূল্যর বাজার থেকে কিছু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। ছুটির ঘণ্টা আজকাল খুব বিরক্ত লাগে, অবকাশের প্রয়োজনীয়তা অতীতের প্রচন্ড বাড়াবাড়িতে হেরে যাচ্ছে। কি আড্ডবাজ ছিলাম এক সময়- ইচ্ছে হলেই বেড়িয়ে পরতাম ঘড়ির কাটার সীমানা পেরিয়ে ছুটে বেড়াতাম চেনা অচেনা পথের বাকে, পাড়ার গলি, বর্ষার উপচে পড়া নদীর পার, ব্যস্ত রাস্ত, পুকুর ঘাট! কত দিন সেই টংঘরে চা খাওয়া হয় না, পরিচিত সেই চায়ের কাপ আর চামুচের ঠোকাঠুকি, ভাঙ্গা টোস্ট, নোন্তা বিস্কিট কেউ হয়তো চিনবে না এখন। পিঠ ঠেকে গেছে অদৃশ্য দেয়ালে। সময় কাউকে ছাড় দেয় না। আলসেমির সকাল, কর্মহীন দুরন্ত দুপুর,চায়ের কাপে শেষ বিকেল, জ্যোৎস্না ধোয়া কোন রাতের আকাশে তারার খোঁজে রাত জাগা কিংবা সময়-অসময় বেড়িয়ে পরা সব চেনা পথ এখন চির অচেনা। অঝর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জানালাটা বোধয় আর খোলা রাখা যাবে না। ভেজার ইচ্ছেটাকে গলাটিপে বসে আছি। বৃষ্টি এমনই, টেনেটুনে বার বার বাইরে নিতে চায়,এর হয় তো জ্বর বাধিয়ে দিয়ে একা রেখে চলে যাবে । অবাক হচ্ছ! সত্যি ইচ্ছের সাথেও এখন বিদ্রোহ করতে হয়। আজ বাসায় ফেরার সময় অটোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম। এরা যান্ত্রিক স্বার্থপর বৃষ্টি হলে আর গলির ভিতর আসতে চায় না। ভাবছিলাম রিকশাতে যাব অমনি এক বেরসিক স্বার্থপর অটো পেয়ে গেলাম। প্রায় কাক ভিজে হয়ে বাসায় ফিরলাম। রিকশা হলে হয়ত এতটা ভিজতাম না। ব্যস্ততা আর যান্ত্রিকতার ভীড়ে প্রিয় বাহন রিকশাতে আর ওঠা হয় না। এখন রিকশার পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া দেখি, হুড তোলা যাত্রী দেখি কিংবা হাতের ভিতর হাত লুকিয়ে রিকশায় পাশাপাশি কোন এক যুগলের বসে থাকা দেখি। তোমাকে নিয়ে বইমেলায় যাবার কথা ছিল সেদিন, কোচিং-এর সামনের রাস্তায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর বলেছিলাম-“আজ যেতে পারব না। আমার কোচিং শেষ হতে আরও এক ঘণ্টা বাকি, কাল যেতে পারব। শুক্রবার আমার ক্লাস নেই।” আমার দেয়া দুঃখবোধের মলাটে অবহেলার বই নিয়ে ফিরে গিয়েছিল। ঐটাই বইমেলার শেষ দিন ছিল আমাদের। আর বইমেলায় যাওয়া হয় নি, হয়তো আর কোন দিন যাওয়াও হবে না। তোমার জন্মদিনের তারিখ ভুলে যাওয়া সেই আমি এখন ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টাতে শিখে গেছি, চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি- তোমার সাথে কতদিন দেখা হয় নি, কথা হয় নি, এমন কি কাটায় কাটায় মিলিয়ে দিতে পারি ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের হিসেব। কফিশপের যে বাচ্চার কাছে কালো কফি চাইতাম, টেবিলবয় সেই ছেলেটা বড় হয়ে গেছে। এখন আর চিনি বেশি দিতে ভুল করে না।কয়েকদিন ভুল করে দুই কাপ কফি নিয়ে আসত এখন আর আনে না। হয়তো বুঝে গেছে তোমার খবর আমার ইথারে আর ধরা দেয় না। সময়ের টানে সবকিছু কেমন দিশেহারা হয়ে পাল্টে যায়। ভাবছ হয়ত তুমিও কর্মহীন, আড্ডাবাজ, বেখেয়ালি আমার আবার তোমায় নিয়ে ভাবার সময় কই! তবে বোধয় ভালই আছি। জানি না কেমন ভাল! ভাল-মন্দের পার্থক্য ঠিক বুঝতে পারছি না। আধাখানা বিস্কিট আর এক কাপ চায়ে সকাল পার করাদের কপালে মায়ের হাতে পরম মমতায় দুপুর না আসাদের, রাস্তার পাশের কোন এক হোটেলের পাতলা ডালে ডুবিয়ে রাখা চামুচের মত অবহেলায় পরে থাকাদের আর ভাল-মন্দের হিসেব করার সময় কই! হোক না এক এক রকম মন্দ কি! হয় তো ভালই আছি আমার সহজাত প্রবৃত্তি লুকিয়ে থাকা নিয়ে। নিত্যান্তই সাধারণ আমিও শামুকের মত লুকিয়ে থেকে চার দেয়ালে জীবনের অংক কষি পাটি গণিতে, বীজগণিতে, জ্যামিতিক অক্ষে অথবা সূক্ষ ক্যালকুলাসে। সাধারণ মানুষের জীবনের হিসেব-নিকেশের খাতাটা সবসময় কাঁটা-ছেঁড়ায় ভর্তি থাকে। প্রতিদিন যোগ বিয়োগের হিসাব মেলাই নতুন করে হিসেবের খাতায় কাটাছেঁড়ার অংশ বাড়ে। একাকী দুপুর, শেষ বিকালে, নিরব প্রহরে কিংবা সন্ধ্যায় তারা সবার জীবনে আসে কষ্ট হয়ে স্মৃতি তে থেকে যায়, মনে পড়ে যায় তা বেলা-অবেলায়। আমার ইন্টিগ্রেটেড সমীকরণের ধ্রুবক পদ তুমি, বলছি না আমার তোমাকে লাগবেই কিন্তু তুমিহীন অসম সমীকরণের ডান পক্ষ আর বামপক্ষের সমতা হয় না। বিরক্ত নাকি বিব্রত হচ্ছ? তুমি আমার সাদাকালো বোর্ডে তাকিয়ে থাকা বাধ্য ছাত্রী নয় জানি, ভয় নেই তোমার অপ্রিয় গণিতের ক্লাস শুরু করব না। নির্মম বাস্তবতা আর গাণিতিক যুক্তি আসলে একই রকম, অজুহাতের ধার ধারে না। অনেকটা পথ হেঁটেছি একসাথে দেখেছি কতগুলো বিকেল পাশাপাশি তারপর সব কিছু ফেলে দূরে একটু একটু করে হারিয়ে যাওয়া। চিরচেনা নিজেদের চিনতে না পারা। হয়ত কিছু করার নেই বিষণন্নতা জয় করেছে আমাদের তবু এভাবে সময় আমার কেটে যাবে তোমাকে ভেবে। তোমায় নিয়ে স্বপ্নগুলোর অপূর্ণতার সকাল হয়। স্মৃতিগুলো ডেকে যায় আজ আমায় কাঁদায়। বৃষ্টির দিনে ছাতা নিয়ে বেড়িয়ে পড়া কোন ছেলে মানুষের আবার সেটা নিয়ে বাড়ি ফেরা- যেমন বিশাল সার্থকতার, ছাতা হারিয়ে বাড়ি ফেরাও তেমন চরম ভাগ্যের দোষ। আমি ভাগ্যের দোহাই দেব না, জানি দোষগুলো কেবল শুধুই আমার। বৃষ্টির ছাতা চাই না। আজ এই মেঘে ঢাকা রাতে একগুচ্ছ কদম হাতে ভিজতে চাই তোমার সাথে , আসবে কি নিঝুম রাতের জানালায় ? কি অদ্ভূত এক আকাশের নিচে আমাদের ভিন্ন জানালার আলাদা বৃষ্টি, আলাদা পৃথিবী। সেই ছোটবেলাতে জানতাম পৃথিবীর আকৃতি নাকি গোল, তাতেই নাকি ঘুরেফিরে আবার সবার দেখা হত? একটু বড়বেলায় এসে জানলাম চাঁদের মত পৃথিবীও কলঙ্কিনী, পুরোটা গোল নয়। হয়তো তাই আসবে না, তবুও স্বপ্ন দেখি অন্ধকারাচ্ছন্ন একাকিত্বের এই বৃষ্টি থেমে যাবে, সকাল হবে। তুমি আসবে ফেসবুক দেয়ালের লাল নোটিফিকেশন হয়ে অথবা জানালার ফাঁক গলিয়ে সকালের মৃদু আলো হয়ে সকালের ঘুম ভাঙাতে। সৌখিন দামী ওয়্যারড্রোপে নয় ওয়াল হ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকা নিতান্ত সাধারণ আমি হয় তো বিলাসীতার আকাশ-কুসুম কল্পনায় বাড়াবাড়ির গল্প শোনাচ্ছি। অতিমানব হতে পারলাম না। রূপার হিমু নয়, সোহানার রানা নয় কিংবা বনলতার ভাল লাগায় তবুও আমার রাজ্যের আমি রাজা।
বালিকা, রংহীন এ রাজ্যের সম্পদ এক অদ্ভূত তুমিহীনতা।