যুদ্বটার নাম হুনায়ন। মুহাম্মদ(সঃ) এর প্রায় শেষ সময়ে এই যুদ্ব সংগঠিত হয়। এই যুদ্বে প্রচুর গনিমতের মাল পাওয়া যায়। ২২০০০ উট, ৪০০০০ ছাগল, ১১৩,৪০০ গ্রাম রোপ্য, ৬০০০ যুদ্ববন্ধী যাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশু ছিলো। গনিমত মাল বন্টনের সময় সবকিছুই মক্কার বেদুইনদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন। যুদ্ববন্ধী সবাইকে মুক্ত করে দিলেন। মদিনার সাহাবিদের কিছু না দেওয়ায় তারা বললো, রাসূল এখন তার লোকদের পেয়ে আমাদের ভুলে গেছেন। রাসূলের কানে এই কথাটি গেলে তিনি সকল মদিনার সাহাবীদের একত্রিত করে বললেন, হে মদিনার আনসার সাহাবীরা, তোমাদের কাছে কি এটা প্রিয় নয় যে, মানুষেরা গনীমতের সম্পদ সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরবে, আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে। এই কথাটা শুনার পর মদিনার আনসার সাহাবীরা কাদঁতে শুরু করলেন। আবু বকর,ওমর,উসমান, আলী এরা সহ মদিনার আনসার সাহাবী সবাই খালি হাতে শুধু রাসূলকে সাথে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলো, আর বললো হ্যাঁ রাসূল আমরা এতেই খুশি। এটাই রাসূলের শিক্ষা।হুয়ায়ন যুদ্ব নিয়ে বিস্তারিত বললে পোষ্টা বড় হয়ে যাবে।যুদ্বের শুরুতেই মুসলিমরা পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়, তখন এই মক্কার বেদুইনরা মুসলিমদের দলে থেকেও বলেছিলো আজ মুসলিমদের পরাজয় কেউই ঠেকাতে পারবে না। এরা পালিয়ে গিয়েছে। পরে উমর,আলি (রঃ) সহ মদিনার আনসার সাহাবীদের দ্বারা যুদ্বের গতিপথ পাল্টে বিজয় ঘটে। মুসলিমদের বিজয় দেখে বেদুইনরা ফিরে আসে রাসূলের কাছে এসে গনিমতের মাল চাইছে এবং রাসূল ওদের মাঝেই সব মাল বন্টন করে দেন। সুত্র
আবু বকর (রঃ) যখন ইসলাম কবুল করেন, তিনি তখন ব্যবসায়ী ছিলেন। শেষের দিকে তাবুক যুদ্বের সময় তার ঘরে আসবাবপত্র বলে কিছুই নাই, এমনি ঘরে কিছু হাড়ি পাতিল ছিলো তা বিক্রি করে তাবুক যুদ্বের ফান্ডে দিয়ে দেন। ইসলাম গ্রহনের আগের সাহাবীদের অবস্হা ইসলাম গ্রহনের পর অনেক খারাপ হয়ে যায়। এরা দুনিয়ার বদলৌতে আখিরাতকে কিনে নিয়েছে।
আমরা আমাদের নেতা নেত্রীদের বা সিনিয়র লোকদের দেখলে দাড়িয়ে সম্মান জানাই, কিন্তু যে সাহাবীরা রাসূলের জন্যে নিজেদের জান কোরবান করতে সধা প্রস্তুত ছিলেন তারা রাসূল আসলে দাড়াতেন না। কারন রাসূল এটার অনুমদোন দেন না।
তিরমিযী ০৪৬:৩১৮ হাদিসঃ ০০৬
আমরা ঘরের চাকর বাকর বা ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে কেমন আচরন করি। হযরত আনাস (রঃ) বলেন আমি রাসূলের খেদমতে ১০ বছর কাটিয়েছি, তিনি কখনোই আমার কোন কাজে বিরক্ত হয়ে উহ! শব্দটা বলেন নাই। কখনো বলে নাই তুমি এটা কেন করছো বা এটা কেন করো নাই। ১০ বছর রাসূলের খেদমতে থেকে আনাস (রঃ) বলছে মুহাম্মদ(সঃ) হচ্ছেন সবচেয়ে ওয়েল বিহেবড মানুষ।
আমাদের কেউ গালি দিলে আমরাও প্রতিউত্তরে গালি দেই। একবার কিছু ইহুদি রাসূলের ঘরের সামনে এসে তার সাথে দেখা করতে চাইলো এবং বলতে লাগলো মৃত্যু পতিতো তোমাদের উপর।(ঐ সময়ে ইহুদী যা বলে অভিবাধন জানাতো, সেই শব্দগুলো জিহবা দিয়ে একটু টুইস্ট করে দিলে হয়ে যেত, তোমাদের মৃত্যু হোক) প্রতিউত্তরে আয়েসা(রঃ) বললো, আমাদের উপর নয় বরং তোমাদের উপর মৃত্যু পতিত হোক। এসব শুনে রাসূল বললেন, হে আয়েশা, দয়ালু হওয়ার চেস্টা করো, খারাপ ভাষা ব্যবহার হতে নিজেকে সংযত রাখো। আয়েশা (রাঃ) বললেন, আপনি কি শোনেন নি, তারা কি বলেছে। রাসূল বললেন হে আয়েশা, আমি বরং তোমাকে সব সময় এটাই বলবো।
আমাদের এই গরীব দেশের প্রেসিডেন্ট/ প্রধান মন্ত্রীতো দূরের কথা, গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের বাড়িঘর রাসূলের চেয়েও উন্নত মানের থাকে। তার ঘর ছিলো পাথর, মাটি দিয়ে গড়া, উপরে খেজুর পাতার ছাদ। বুখারিঃ১/৭১,৫৫৫,৫৬০
আমাদের সবার ঘরে এবং সেই সময় মদিনায় লোকদের ঘরে কত কি আসবাব পত্র থাকে। চেয়ার টেবিল, খাট পালং, আলনা, দোলনা আরো কতো কি। রাসূলের ঘরে কি ছিলো,
একবার উমর (রঃ) রাসূলের ঘরে প্রবেশ করেন, তিনি দেখেন তার ঘরে শুধু একটা চামড়ার ব্যাগ, আর কিছুই নাই। রাসূল খেঁজুর পাতার মাদুরে শুয়েছেন, মাদুরের দাগ তার শরীরে লেগে আছে। আমার চোখে পানি এসে গেলো রাসূলের এই করুন অবস্হা দেখে। রাসূল বললেন, হে উমর তুমি কাঁদছ কেনো। উমর বললো, আমি কাদবো না কেন, আপনার ঘরে কোন আসবাবপত্রই দেখছি,মাদুরের দাগ আপনার শরীরে লেগে আছে। অথচ রোমের কায়সার আর পারস্যের খসরু রাজারা কতো বিলাসে থাকে প্রাসাদে। মুহাম্মদ(সঃ) বললেন হে উমর, আমার লক্ষ্যতো বিলাসিতা নয় বরং খোদার সন্তুস্টি সহীহ মুসলিমঃ বুক ০০৯ হাদিস নাম্বারঃ ৩৫০৭
রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে বালিশে শুতেন, সেই বালিশটা ছিলো খেজুর গাছের আঁশ দিয়ে বানানো। সহীহ মুসলিমঃ বুক নং ০২৪ হাদিস নং ৫১৮৫
কোন লোক মারা গেলে রাসূল জিজ্ঞাসা করতেন এই লোকটা কোন দেনা রেখে মারা গিয়েছে কিনা। যদি সে দেনা রেখে মারা যায় তাহলে রাসূল তার দেনা পরিশোধ করতেন। যদি সে সম্পত্তি রেখে মারা যায়, তাহলে ওটা স্রেফ তার উত্তরসূরীদের জন্যে।
সহীহ বোখারীঃ ভলিউম ৩ বুক নং ৩৭ হাদিস নং ৪৯৫
অনেকেই বলবে কোরান শরীফে বলা হয়েছে গনীমতের মালের ৫ ভাগের এক ভাগ রাসূলের জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে। সূরাঃ৮ আয়াত-১ ও ৪১ঐ সম্পদ কোন বিলাসিতার জন্যে ব্যয় করতেন না। সেই সম্পদ জনসাধারনের মাঝে বিলিয়ে দিতেন, যতক্ষন পর্যন্ত না ঐ সম্পদ শেষ না হয়।
বুখারী শরীফঃ ভলিউম ৪ হাদিস নং ৩২৬
আমরা বিভিন্ন ধরনের খাবার খেয়ে রসনা বিলাস, পেটপূজা করি। নিজে ভালো ভালো খাই এবং গরীব দুঃখীদের সাহায্যের কথা বলি, কিন্তু করিনা । আল্লাহর রাসূল যা বলতেন তাই করতেন। তিনি এখানে হিপোক্রিসী করতেন না। যেটা আমাদের সভ্য সমাজের লোকেরা করে থাকে। তিনি বলেছেন, ক্ষুদার্তকে খাবার দাও, অসুস্থকে দেখতে যাও এবং গোলাম/দাসকে টাকা দিয়ে মুক্ত করে দাও।
বুখারী শরীফ, ভলিউম ৭ বুক নং ৬৫ হাদিসস নং ২৮৬
রাসুলের পুরা পরিবারটা কখনো কখনো পুরা মাস কাটিয়েছে শুধু খেজুর এবং পানি খেয়ে। ওদের রান্না করার কোন খাবার ও ছিলোনা বলে একমাস কোন চুলাও জ্বলেনি।
সহিহ মুসলিম বুক নং০৪২ হাদিস নং ৭০৮৯
আপনার কাছে খাদ্য নেই বা কম খাদ্য আছে, আপনি খেয়ে না খেয়ে আছেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশী কস্টকর হলো, আপনার আছে এবং ছিলো কিন্তু তা নিজে না খেয়ে বিলিয়ে দিয়েছেন ক্ষুদার্তের মাঝে।
রাসূল এবং তার পরিবার সারাজীবন পরপর তিনদিন পেটপুরে খেতে পারেন নি। একদিন খেয়েছেনতো আরেকদিন না খেয়ে থেকেছেন। মহানবীর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এভাবেই চলেছিলো প্রতিদিন।
সহিহ বুখারীঃ ভলিউম ৭, বুক নং ৬৫, হাদিস নং ২৮৭
তৎকালীন সময়ে আরবে এবং গ্রিসে নারী শিশু হত্যার প্রচলন ছিলো প্রথার মতো। অনেকে কোন মেয়ে শিশুই নিতোনা। কেউ কেউ একটা মেয়ে শিশুর বেশী নিত না, একটা মেয়ে শিশু থাকলে বাকিগুলোকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিতো। একটা গর্ত করে ওখানে গর্ভবতী নারীর বাচ্ছা ডেলিভারি করা হতো। শিশুটি যদি মেয়ে হতো তাহলে গর্তের মধ্যেই মাটি চাপা দিতো। সেই সময়েও মা বাপ হারিয়ে বড় হওয়া নিরক্ষর লোকটি পরপর চারটি মেয়েশিশু জন্ম দেন এবং লালন পালন করে। এই সামাজিক ট্যাবু ভেঙ্গে দেন নবী হওয়ার আগেই। হযরত যয়নব (রঃ), রোকাইয়া(রঃ), কুলসুম(রঃ) এবং সবার ছোট ফাতিমা (রঃ) সবাইকে খুব ভালোবাসতেন, সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতেন সবার ছোট ফাতিমা (রঃ) কে। এর জন্য তার নবী হওয়ার দরকার পড়েনি। মূলত তারও প্রায় বিশ বছর পর কোরানে এই আয়াতটা নাজিল হয়, কন্যাশিশুটা বিচারের দিন খোদার কাছে প্রশ্ন করবে কি অপরাধে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হলো? সুরাঃ তাকয়ির আয়াতঃ ৮এবং ৯
কন্যাশিশু একে একে চার জন জন্মানোর পরেও মুখ কালো করেননি, খাদিজা(রঃ)কে দোষারুপ করেন নি, বংশের বাতি নিভে যাওয়া নিয়ে মাথা ঘামান নি। নিজের কন্যাদের এমন ভালোবাসতেন যে বলতেন, ফাতিমা আমার শরীরের অঙ্গের মতো। আমার মেয়ে ফাতিমাকে যে কস্ট দেয়, সে যেন আমাকেই কষ্ট দেয় । তারও প্রায় ২০ বছর পর কন্যাশিশু জন্মানোয় মুখ কালো রাখা বা পুত্রশিশু জন্মনিলে খুব খুশি হওয়ার উপর নিষেধাঙ্গা আরোপ করা হয় পবিত্র কোরানে, সূরা নাহোলঃ আয়াত ৫৮-৫৯।
দুই তিনটা কন্যাশিশু লালন পালন করে বড় করার মধ্যে অসংখ্য ফজিলতের কথা বর্ননা করে গেছেন।
বর্তমানে স্ত্রীদের কাছে কতজন স্বামী উত্তম হবেন? মুহাম্মদ(সঃ) বলে গেছেন, তোমাদের মাঝে সবচেয়ে ভালো যার উত্তম চরিত্র রয়েছে, এবং তাদের মাঝে সবচেয়ে উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম। তিরযিমী শরীফঃ বুক নাম্বার ১০ হাদিস নাম্বার ১১৬২।
কখনো বাইরে থকে ঘরে প্রবেশ করলে যদি দেখতেন তার স্ত্রী এখনো রান্না করছে, তাহলে তিনি তার স্ত্রীর পাশে থেকে রান্নার কাজে সাহায্য করতেন। তার স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা, কখনো একটা ধমক ও দেন নি তাদের। কখনো কথায় মনমালিন্য হলে ওখান হতে উঠে যেতেন শুধু। বিশ্বনবী হয়েও তিনি স্ত্রীদের থেকে পরামর্শ গ্রহন করতেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির কঠিন মূহূর্তেও তিনি তার স্ত্রী হযরত সালমা(রঃ) এর পরামর্শই গ্রহন করেন।
তিনি মায়ের কাছে কমই ছিলেন, মায়ের মমতা বুঝার আগেই তার মা আমেনা(রঃ) দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে। তবুও তিনি বলে গেছেন, বেহেশত হলো মায়ের পায়ের নিচে। সুনানে ইবনে মাজাহ হাদিস নাম্বার ২৭৭১
মাকে দিয়েছেন পিতার চেয়েও তিনগুন বেশী মর্যাদা ও অধিকার।
ইনিই সেই মহামানব, মক্কা জয় করার পর প্রতিশোধ নেওয়ার পূর্ন শক্তি থাকার পরও প্রতিশোধ নেন নি, ক্ষমার মহাত্ব দেখিয়েছেন। নবী হওয়ার আগেই আল-আমিন উপাধি পেয়েছেন। আরব বিশ্বে যুদ্ব হানাহানি বন্ধের জন্যে গড়ে তুলেছেন শান্তিসংঘ। নবুয়্যতের আগে ও পরে সর্বোপরী তিনি ছিলেন একজন আদর্শ কিশোর, আদর্শ তরুন, আদর্শ যুবক, আদর্শ সন্তান, আদর্শ স্বামী, আদর্শ বাবা, আদর্শ নানা, আদর্শ নেতা, আদর্শ প্রতিবেশী, আদর্শ দার্শনিক এবং আদর্শ বিপ্লবী। তিনি ছিলেন একজন নবী ও দার্শনিক। নিজ দর্শনে আহবান জানিয়েছেন সবাইকে, নিজেও চলেছেন সেই একি দর্শনে, সেই একি দর্শনে করে গিয়েছেন এক বিপ্লব। সাদা-কালো, আরব, অনারব, পূর্ব-পশ্চিম, উঁচুজাত-নিচুজাতের ভেদাবেদ গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। এজন্যেই বার্নার্ড লুইসে মতো লেখক, গত জর্জ বুশ সরকারের উপদেস্টাকেও স্বিকার করতে হয় ইসলাম হচ্ছে বিশ্বে প্রথম ইউনিভার্সাল সিভিলাইজেশান, যেখানে আরব, চীনা, তুর্কি, কুর্দী, ভারতীয়, ইউরোপীয়, আফ্রিকার লোকদের একটা সভ্যতা গড়ে উঠে। নিজস্ব দর্শনের পুথি রেখে পরবর্তি কারো উপর বিপ্লবের ভার দেন নি, তিনি নিজেই এই বিপ্লব সফল করে যান।
ব্লগার পাললিক মনের ছিলো বেঞ্চমার্ক মুহাম্মদ (স):। লাইফ ইজ বিউটিফুল। ট্রাই করেই দেখুন না। প্লিজ! এটা একই টপিকের দ্বিতীয় পোষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১২ রাত ১১:১০