আফগান নারী, কথাটা শুনলে আমাদের চোখে ভেসে উঠে এক অদ্ভুদ বোরকায় ঢাকা কিছু আফগান নারীদের কথা। যেই দেশে নারী হয়ে জন্ম নেওয়া অভিশাপ। যেখানে উপজাতিয় সংস্কৃতি দিয়ে, ধর্মের অপব্যবহার করে নারীকে করেছে বন্দী। তবুও সেই নারীদের মাঝে আজ কিছু দুঃসাহসী আফগান নারীদের কাহিনী শুনাবো আপনাদের।
দ্বিতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্বঃ আফগান নারীদের এখন যেভাবে দেখা যায় ঘরে বন্দী, আগে এমনটি ছিলো না। নারীরা যুদ্বেও যেতো তাদের পিতা বা স্বামীর সাথে। পুরুষ সৈন্যের ক্ষতস্হানে ব্যান্ডেজ, সেবা শুশ্রসা করা ও পানি খাওয়ানো ছাড়াও সক্রিয়ভাবে যুদ্বে অংশগ্রহন করতো। অন্যসব আফগান নারীর মতোই এক রাখালের মেয়ে মালালাই আনা দ্বিতীয় ব্রিটিস আফগান যুদ্বে অংশগ্রহন করে তার পিতা ও বাগদত্তার সাথে। যুদ্বের স্হান ছিলো মাইওয়ান্দ
১৮৮০ সালের ২৭ শে জুলাই মাইওয়ান্দে শুরু হয় ব্রিটিশ ও আফগানদের মাঝে তুমুল যুদ্ব। একদিকে তৎকালিন পরাশক্তি ব্রিটিশ অন্যদিকে গরীব আফগানরা। যুদ্বের প্রথম দিকে আফগান সেনাপতি আইয়ুব খানের লোকেরা ব্রিটিসদের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে পিছু হঠতে থাকে। আফগানদের পিছু হটা দেখে মালালাই আনা আফগান পতাকা হাতে তুলে নেন। এবং গেয়ে উঠেন,
হে প্রিয় যুবকেরা! যদি তুমি মাইওয়ান্দ যুদ্বে ঝাঁপিয়ে না পড়ো,
তাহলে খোদা সাক্ষী,
সবাই তোমাদের লজ্জার প্রতিক ভাববে!
Young love! If you do not fall in the battle of Maiwand,
By God, someone is saving you as a symbol of shame!
মালালাইয়ের এই কবিতা বলার পর আফগানদের মানসিক শক্তি বেড়ে যায়। পুনরায় আফগানরা ঝাপিয়ে পড়ে ব্রিটিসদের সাথে তুমুল যুদ্বে। এরি মধ্যে প্রথম সারির আফগান পতাকা বহনকারি শহীদ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। মালালাই এগিয়ে গিয়ে তার হাতে থাকা পতাকা উঁচু করে ধরে। কেউ কেউ বলছে মালালাই তার মাথার হিজাব খুলে পতাকা হিসেবে ব্যবহার করে। মালালাই আবার গেয়ে উঠে,
মাতৃভূমি রক্ষায় প্রিয়লোকদের প্রতিফোটা ঝরানো রক্ত, আমি কি কপালের টিপ হিসেবে ব্যবহার করবো,
যেটা বাগানের লাল গোলাপকেও লজ্জায় ফেলবে।
With a drop of my sweetheart's blood,
Shed in defense of the Motherland,
Will I put a beauty spot on my forehead,
Such as would put to shame the rose in the garden
মালালাইয়ের আহবান ছড়িয়ে পড়ে পুরো যুদ্বময়দানে। তার লোকেরা পূর্ণ উদ্দোমে যুদ্ব চালিয়ে যেতে থাকে। ব্রিটিসদের ছোড়া একটা বুলেট এসে এবার মালালাইকে লুটিয়ে দেয়, শহিদ হয়ে যায় মালালাই সেখানেই। মালালাই শহিদ হলেও তার আহবানে আফগানরা ছিলো অনুপ্রানিত, মনবলে ছিলো চাঙ্গা। অবশেষে বিজয় হয় আফগানদের মাইওয়ান্দ যুদ্বে।
কবি নজরুলের ভাষায়, পৃথিবীতে একা জয় হয়নি কখনো পুরুষের তরবারি,
প্রেরনা দিয়েছে, শক্তি যুগিয়েছে বিজয়ী লক্ষী নারী।
(ক্রুসেড যুদ্বের সময়েও সুলতান সালাহউদ্দিন রনাঙ্গনে নিয়ে আসা সমসাময়িক আরেক সমরনায়ক নুরুদ্দিন জঙ্গির স্ত্রী ইসমাত খাতুন এক বিশাল নারী বাহিনী গড়ে তুলেন। দামেস্ক শহর থেকে কায়রো পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্বে মুসলিম আহত সৈন্যদের ব্যান্ডেজ লাগানো, পানে পান করা সহ সক্রিয় যুদ্বেও অংশগ্রহন করতো নারীরা।)
ব্রিটিসররা এই যুদ্বের কথা বলতে গেলে মালালাইয়ের কথা বলেই না। ক্রেডিট দিতে চায় শুধু সেনাপতি আইয়ুব খান কে। তবে আফগানরা মালালাইয়ের মর্যাদা দিয়েছে। তার কবর আজো জিয়ারত করতে যায় আফগানরা। মালালাইয়ের নামে বহু স্কুল,কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তার নামকরন হয়েছে। আফগানিস্তানের প্রত্যেকটা ক্লাসের সিলেবাসে মালালাই অন্তর্ভুক্ত। মালালাইয়ের নামে নিজ মেয়ের নাম রেখে গর্ববোধ করে আফগানরা।
এবার কিছু দুঃসাহসী আফগান নারীর কথা
মীনাঃ স্বাধীনতা, গনতন্ত্র ও নারী অধিকারের জন্য রাওয়া প্রতিষ্ঠা করে মীনা আফগানিস্তানে ১৯৭৭ সালে। স্কুল জীবন হতেই মীনা বিভিন্ন সোস্যাল এক্টিভিস্টে কাজ করে। মীনা রাওয়া প্রতিষ্ঠা করে কন্ঠহীন আফগান নারীদের কন্ঠ দেওয়ার জন্যে। মীনা সেই সময় একিসাথে আফগানি মৌলবাদিদের ক্রিমিনাল কর্মকান্ড প্রকাশ করেন। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আফগানিস্তান দখল করলে মীনা সোভিয়েত ও কাবুলে তাদের পুতুল সরকারের বিরুদ্বে স্কুল, কলেজ ও কাবুল ভার্সিটিতে বিভিন্ন কর্মকান্ড ও সভা শুরু করেন।
১৯৮১ সালে ফ্রান্স সরকারের আমন্ত্রনে ফ্রান্স সোস্যালিস্ট কংগ্রেসে যোগদান করেন। সেই সভায় সোভিয়েত প্রতিনিধি বোরিস পোনামারিয়েভ ও যোগদান করে। মীনা বোরিসকে দুই আঙ্গুলের 'V' বিজয় চিহৃ পদর্শন করেন।
সোভিয়েত প্রতিনিধি সাথে সাথে সেই সভা ছেড়ে চলে যান। পরে ১৯৮৭ সালে কেজিবির স্হানীয় শাখা মিনাকে হত্যা করে। মীনা তার কর্মকান্ডে একই সাথে আফগান মৌলবাদিদের, সোভিয়েত দখলাদের এবং সোভিয়েত পুতুল আফগান কম্যুনিস্ট সরকারের শত্রুতে পরিনত হন। মীনা শহীদ হলেও তার গড়ে সংগঠন রাওয়া তার অসমাপ্ত কাজগুলো করে যাচ্ছে। তার সংগঠনের বহু নারী নারী অধিকারের জন্যে শহীদ হয়েছে, নির্যাতীত হয়েছে, তবে থেমে যায় নি। তাদের তত্বাবোধানে রয়েছে নির্যাতীত নারীদের জন্যে আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল, এতিমখানা। এই সংগঠনের সবচেয়ে দুঃসাহসী কাজ হলো এরা কাউকেই পরোয়া করেনা। আফগান মৌলবাদিদের বিরুদ্বে কাজ করতে গিয়ে আফগান বা সোভিয়েত কম্যুনিস্টদের পক্ষ নেয় না। বা তালেবানদের বিরুদ্বে বলতে গিয়ে আমেরিকানদের পক্ষ নেয় না এবং আমেরিকানদের বিরুদ্বে বলতে গিয়ে তালেবানের পক্ষ নেয় না।
বর্তমানে ওদের মূল স্লোগান হলো,
নয় তালিবান, নয় আমেরিকান,
আমরা চাই মুক্ত আফগানিস্টান।
শহীদ মীনার একটা কবিতাঃ
আমি নারী, আমি জেগেছি, পুরা লিরিকস এখানে।
মালালাই জয়াঃ ব্রিটিশ বিরুধী যুদ্বের বীরাঙ্গানা মালালাই আনার নামকরনে এই মালালাই জয়া নাম রাখেন তার পিতামাতা। শৈশব কাটে রিফিউজি ক্যম্পে। রিফিউজি ক্যাম্পে শৈশব হতেই বিভিন্ন সামাজিক সহায়তা কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন মালালাই জয়া। সোভিয়েত বিরুধী মুক্তিযুদ্বে পা হারানো এক যোদ্বা তার পিতা। শৈশব ফেরিয়ে কৈশোর, তারুন্য নারী অধিকারের পক্ষে বিভিন্ন কর্মকান্ড ও লেখালেখি করে যান। জয়া পার্লামেন্টে নির্বাচিতও হন। ২০০৩ সালে কারজাই সরকারের পার্লামেন্টে ভাষনে বলেন, এই পার্লামেন্ট পুরোটাই মৌলবাদি ও যুদ্ববাজদের দিয়ে ভরা। এদের হাত এখনো রন্জিত আফগানদের রক্তে। এই যুদ্ববাজগুলো কট্টর নারী বিদ্বেষী। এই যুদ্ববাজরা এখন পার্লামেন্টের সদস্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোর্টে এদের বিচার হওয়া দরকার।
ব্যাস! আর যায় কোথায়? যুদ্ববাজরা সাথে সাথে ঘোষনা দেয় মালালাই জয়া একজন কাফির, তাকে হত্যা করা হোক।
আফগান স্কুল ছাত্রীদের লেকচার দিচ্ছেন মালালাই জয়া।
মালালাই বিভিন্ন দেশে লেকচার দেওয়ার জন্যে গিয়েছেন, কিন্তু দেশ ছেড়ে যান নি। যুদ্ববাজরা তাকে কাফির ঘোষনা দেওয়ার পর এ পর্যন্ত চারবার আক্রমন করে তাকে হত্যার জন্যে। কিন্তু প্রতিবারই বেঁচে যান মালালাই জয়া। তবুও মালালাই কোন দেশে এ্যাসাইলাম নেন নি, দেশ ছেড়ে চলে যান নি। জয়া বলতো, আমি মরলে এই দেশেই মরবো, তারা আমাকে হত্যা করতে পারবে, কিন্তু আমার কন্ঠকে স্তব্দ করতে পারবে না।মালালাই জয়াও মীনার মতো একিসাথে তালিবানদের, কারজাইয়ের পার্লামেন্টের যুদ্ববাজদের এবং আমেরিকাও ন্যাটোর শত্রু। কিছুদিন আগে শিকাগোতে ন্যাটো সম্মেলনের সময় ন্যাটোর মার্ডারাস ক্রাইমের বিরুদ্বে গার্ডিয়ানে কলাম লিখেন।
মালালাই আনার স্পিরিটে অনুপ্রানিত সংগ্রামী এই সব নারীদের জয় হোক আফগানিস্তানে। নারীরাও বাচুঁক ওখানে মানুষ হয়ে এই কামনাই করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:০২