মুহম্মদ জাফর ইকবাল শুধুমাত্র আমার প্রিয় লেখকই নন, আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। তার লেখা বইগুলো ছোটবেলা থেকেই আমার মত অনেকেরই প্রিয় বইয়ের তালিকায় থাকে সবসময় । আর তাই তার যে কোন লেখা পেলেই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি । গত ৯ আগস্ট তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত তার ‘কারো মনে দিও না দুঃখ’ লেখাটি পড়লাম। লেখাটির মুল বিষয় আমাদের পাহাড়ী জনপদের মানুষদের মনে সরকার কষ্ট দিয়েছে তাদেরকে আদিবাসী না বলে ।
ডঃ জাফর ইকবাল , ‘আদিবাসী’ ডাক না শুনে তারা কতটা দুঃখ পেয়েছে তা আমি জানি না । কিন্তু আপনার মত একজন অনুকরণীয় মানুষের কাছ থেকে এ ধরনের লেখা পেয়ে আমার মত অনেকেই মনে কষ্ট পেয়েছে । কারণ কেউ যখন কোন কিছু না জেনে বলে তখন সেটা হয় তার অজ্ঞতা, কিন্তু যখন কেউ কোন কিছু জেনে ইচ্ছা করেই বিশেষ কোন স্বার্থে মিথ্যাচার করেন,তখন তা হয় intellectual corruption. আপনার মত মাণুষেরা খুব সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারেন আমার মত উঠতি বয়সী যুবক-তরুনদের। কাজেই আপনাদের যে কোন মতামতই অনেক দামি,বোধকরি টাকার অঙ্কেও।
আমি এখানে কেন আপনার লেখাটি আমাদের দেশের জন্য বিপদজনক তা সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করব । প্রথমত আপনি অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকার আদিবাসীদের উদাহরণ দিয়ে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার কথা বলেছেন। আপনার সাথে আমরা সম্পুণ একমত। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকার প্রেক্ষাপটের সাথে আমাদের এখানকার প্রেক্ষাপট কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ ?
আমদের দেশে বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস যে হাজার বছরের পুরনো এ ব্যাপারে আশা করি কারো ভিন্নমত নেই । চাকমা,মারমা, ত্রিপুরা, মং, চাক, মুরং ইত্যাদি প্রায় ১৩ টি উপজাতির বাস আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে । এদের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে কত বছরের পুরনো ? আপনি জানেন নিশ্চয়ই- এরা সবাই এসেছে মাত্র তিন-চার শত বছর আগে । এদের আগমন সিনলুন ও চীন ( লুসাই,পাংখু,মোরো ও খুমি গোত্র) , ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য (ত্রিপুরা,মুরং,তঞ্চঙ্গা,রিয়ং), আরকান (চাকমা,মগ ইত্যাদি গোত্র ) হতে ।
অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকার আদিবাসিদের ওপর উপনিবেশ কায়েমকারী বেনিয়ারা অপরিসীম নির্যাতন চালিয়ে তাদেরকে নিজ দেশে পরবাসীতে পরিণত করে। যে কারণে ওইসব দেশে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষনের বিষয়টি এত গুরুত্ববহ । আমাদের দেশে আদিবাসীদের অধিকার সংরক্ষণ যদি আলাদা ভাবে করতে হয় তাহলে আপনার আমার মত সাধারন মানুষের অধিকারই আলাদা করে রক্ষা করতে হবে । কারণ বাঙ্গালী জাতিই এদেশে আদিবাসি । আমার মত অভাজনের কথা অনেকের কাছেই হয়ত গুরুত্ব পাবে না,তাই এ ব্যাপারে কিছু রেফারেন্স দিচ্ছি ।
প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞান গবেষক, ড এবনে গোলাম সামাদ, পার্বত্য তিন জেলা নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখোঃ দেশবাসী সচেতন হও, শীর্ষক কলামে
“এখানে এমন অনেক উপজাতির বাস, যারা ইংরেজ আমলের আগে ছিল না। ইংরেজ আমলে প্রধানত আরাকান থেকে এখানে উপনিবিষ্ট হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে এখানে তাদের বলতে হয় পরদেশি। ওই অঞ্চলের ভুমিজ সন্তান তারা নয়। অনেকে না জেনে তাদের মনে করেন আদিবাসী। চাকমা, মারমা প্রভৃতিকে আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা খুবই বিভ্রান্তিকর।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর, বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন লিখেছেন,
“Most of the tribal people move into this land from areas now in Myanmar (former Burma) during the period from the 15th to the mid-nineteenth centuries. The tribes belonging to the Koki group were the earliest to settle, and the Chakmas came much later” (War and Peace in the Chittagong Hill Tracts, P.5, published by Agamee Prakashni Dhaka, 1999).
নৃতত্তবিদ T.H Lewin-এর মতে, “A great portion of the Hill tribes, at present living in the Chittagong Hills, undoubtedly came about two generations ago from Arakan. This is asserted both by their own traditions and by records in the Chittagong Collectroate (1869, P. 28)„
সম্প্রতি বোমাং সার্কেলের রাজা পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন যে,তারা মোটেও আদিবাসী নন । তারা এ অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছেন মাত্র কয়েকশত বছর আগে । যারা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন এবং টিভি পর্দায় চোখ রাখেন আশা করি বোমাং রাজার সাক্ষাতকার তাদের চোখ এড়িয়ে যায় নি ।
আশা করি আমি বুঝাতে পেরেছি কেন এদেরকে আদিবাসী বলা ঠিক হবে না । এখন জাফর ইকবাল সাহেবের মত অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এতে করে কি এইসব মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে ? অথবা এদেরকে আদিবাসী বললে কি এমন ক্ষতি হবে ? ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা উপজাতি শব্দের চেয়ে তো আদিবাসী শব্দটি শ্রুতিমধুর । তাহলে খামখা এই বিতর্ক টেনে তিক্ততা বাড়িয়ে কি লাভ?
এখন প্রথমত এই সকল মানুষ আপনার আমার মতই এদেশের নাগরিক । আপনার আমার যে অধিকার দেশ সংরক্ষণ করে ঠিক একই অধিকার এদের জন্য । এখানে কোন বৈষম্য কারও কাম্য নয় । তাহলে আদিবাসী নামের ধুঁয়া তুলে এদের লাভটা কি ???? আসুন দেখি আসলে আদিবাসী ইস্যুর আড়ালে আসলে কি লুকিয়ে আছে ।
প্রিয় জাফর ইকবাল স্যার, আপনি নিশ্চই জানেন যে আদিবাসীদের ব্যাপারে ইউ এন এর নীতিমালা কতটা স্পর্শকাতর । কোনভাবে যদি একবার প্রমাণ হয় যে বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে আদিবাসীদের বসবাস রয়েছে,সাথে সাথে এ অঞ্চলের ওপর বাংলাদেশ সরকারের কার্যত কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না । ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ইউ এন এর সাধারণ পরিষদ একটি রেজুলেশন পাস করে যার নম্বর ৬১/২৯৫ । ওই রেজুলেশনে মোট ৪৬ টি অনুচ্ছেদ আছে । চলুন দেখে নেই আদিবাসিদের ব্যাপারে সেখানে কি বলা হয়েছে ।
রেজুলেশনের চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে
“আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ বা স্থানীয় বিষয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন বা নিজ সরকার (self government) পরিচালনার অধিকার থাকবে ।”
রেজুলেশনের পঞ্চম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে
“ আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের আইনী ব্যাবস্থাসহ সতন্ত্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজস্ব অবকাঠামো তৈরি এবং উন্নয়নের অধিকার সংরক্ষন করে ।”
অতএব বুঝতেই পারছেন,ত্রিশ বছর সশস্ত্র সংগ্রাম করে শান্তি বাহিনী স্বাধীনতা অর্জন না করতে পারলেও বিগত কয়েক বছর ধরে আদিবাসী স্বীকৃতির জন্য কেন সবাই আদাজল খেয়ে লেগেছে । কোনভাবে একবার আন্তর্জাতিক মহলে যদি প্রতিষ্ঠা করা যায় যে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের বসবাস ,তাহলে পার্বত্য অঞ্চলে যে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে না থেকে একটি পৃথক সরকার ও রাষ্ট্র গঠিত হবে সেটা বুঝতে কি আপনাদের খুব কষ্ট হচ্ছে ???
এ তো গেল একটা দিক । মুদ্রার অপর পিঠে খেয়াল করলে আমরা দেখতে পাই যে, মুলত গত এক দশক ধরে ঢাক ডোল পিটিয়ে এদের বলা হচ্ছে আদিবাসী। তোলা হচ্ছে নানান সব দাবী দাওয়া। তাদের দিতে হবে আলাদা সংবিধান, আলাদা ভাষা । তার পর আলাদ রাষ্ট্র । এসব দাবীর উপর দেওয়া হচ্ছে ব্যাপক মিডিয়া কভারেজ । ভাবখানা দেখে মনে হয় এত দিন উপজাতিরা বাংলাদেশে সুখে শান্তিতে বসবাস করতো । হটাত করে কিছু দিন আগে বাংগালীরা বাংলাদেশে এসে তাদের (কথিত আদিবাসীদের ) বিতাড়ন করেছে, তাই আমেরিকা-ইউরোপ আসুক, দেখুক আর তাদের জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের ব্যাবস্থা করে দিক। বিদেশের টাকায় পরিচালিত কিছু এনজিও, মস্তিস্ক বিক্রি কারি কিছু মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের অবিরত প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি। আমরা অনেকে জেনে আর অনেকে না জেনে উদারমনে তাদেরকে আদিবাসী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে সম্বোধন করে আসছি।
মনে করা হয়, সন্তু লারমারা মুলত সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তাদের থিংক ট্যাংক বা গবেষনা প্রতিষ্টান গুলোর পরার্মশে। তারা বুঝে যায় সশস্ত্র সংগ্রাম করে পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে চাল দিতে হবে ধীরে ধীরে খ্রিষ্টানাইজেশান প্রক্রিয়া ও আদিবাসী কার্ড । এই দুটি বিষয়কে হাইলাইটস করলেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে এসে বাংলাদেশকে বাধ্য করবেন পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতা দিতে। ঠিক যেমন করা হলো পূর্ব তিমুরে । শুধু মাত্র খৃষ্টান অধ্যুষিত হওয়ার কারনেই দক্ষিণ সুদানকে পশ্চিমা শক্তি আলাদা করে এককালের আফ্রিকার বৃহত দেশ (আয়তনে) সুদান ভেজ্ঞে দুর্বল করে ফেললো। দক্ষিণ সুদানে অনেক খনিজ সম্পদ আছে যা নিয়ন্ত্রন করার জন্য দেশটিকে বহুবছর থেকে পশ্চি্মা খৃষ্টানরা নানা প্রচেষ্টার মাধ্যমে ধর্মান্তরিকরনের কাজটি করেছে ।
আপনি কি জানেন আজ অনেক বছর ধরেই এ ধরনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পারবত্য চট্টগ্রামে । এ সম্পর্কিত দৈনিক সমকালে আজ থেকে তিন বছর আগেই ১০ মার্চ ২০০৮ এ একটি রিপোর্ট ছাপা হয় ।
“পাবর্ত্য চট্টগ্রামে শত শত উপজাতীয় লোক ধর্মান্তরিত হচ্ছে। পাংখোয়া, লুসাই ও বোমাংসহ আরো অনেক উপজাতীয় মানুষের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা বেড়েছে। কিছুসংখ্যক চাকমাও আদি ধর্ম ছেড়ে গ্রহণ করেছে খ্রিষ্ট্রধর্ম। ভূমি সংক্রান্ত বিরোধে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্তিতিতে অস্থির রয়েছে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম। তার ওপর গহিন অরণ্যে পাহাড়িদের মধ্যে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন উপজাতি নেতারা। কারণ এতে পাহাড়িদের মধ্যেই সম্প্রীতিতে ফাটল ধরছে। উপজাতি নেতাদের অভিযোগ, গহিন অরণ্যের দরিদ্র লোকদের ধর্মান্তরিত হতে প্রলোভন দেখিয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এ কাজে জড়িত কিছু এনজিও, মিশনারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা।
খাগড়াছড়িতে পাহাড়িদের ধর্মান্তরের ঘটনা বেশি। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানেও আছে। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য রুইথি কারবারি সমকালকে বলেন, সেবার নামে এসে পাহাড়িদের ধর্মান্তরিত করতে প্রকাশ্যে কাজ করছে কিছু এনজিও, মিশনারি সংস্থা। ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে দরিদ্র মানুষদের দুবর্লতাকে। ইতিমধ্যে তাদের প্রলোভনের টোপ গিলেছে বহুসংখ্যক পাংখোয়া, লুসাই, বোমাং এবং কিছুসংখ্যক চাকমা ধর্মাবলম্বী অন্যান্য উপজাতিকে টাগের্ট করেও সংস্থা গুলো কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ পর্যন্ত কত লোক আদি ধর্ম ছেড়ে খিষ্ট্রান হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ হিসাব বলা মুশকিল। তবে ধর্ম পরিবর্তনের ঘটনা ঘন ঘন ঘটছে কোনো না কোনো পাহাড়ি জনপদে। সংখ্যাটা বড়ই হবে । ” - (সমকাল, ১০ মার্চ ২০০৮)
প্রিয় জাফর ইকবাল , আশা করি আমি পরিস্কার ভাবে বলতে পেরেছি আপনার প্রিয় আদিবাসী ইস্যু আমাদের দেশের অখন্ডতার জন্য কেন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে । যে দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে আপনার বাবার মত লক্ষ শহীদ প্রান দিল, সে দেশকে হুমকির মুখে ফেলে দেবেন ? আপনি একজন শহিদ পিতার গর্বিত সন্তান । আপনি কি এরপরও কি এদের আদিবাসী অধিকারের নামে যে অনৈতিক আন্দোলন চলছে, তার সাথে একাত্মা হয়ে চিল্লিয়ে গলা ফাটাবেন ??
লেখার এক অংশে আপনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে মন্তব্য করেছেন । পাহাড়ে এদের ভুমিকার সমালোচনা করেছেন । বাংলাদেশের ইতিহাসের রক্তাক্ত অধায়গুলোর ওপর সেনাবাহিনীর জলপাই রঙের ছাপ খুব তীব্র । সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চাভিলাসী ব্যাক্তি ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে বারবার রাস্ট্রযন্ত্রে অনধিকার প্রবেশ করেছে । কিন্তু একটা কথা কিন্তু সবারই মানতে হবে যে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কিন্তু আপনার আমার পরিবারেরই কেউ না কেউ । এরা হানাদার বাহিনীর মত পাকিস্তান থেকে এসে এদেশে জুড়ে বসেনি । সেনাবাহিনী নিয়ে সচরাচর ভালো মন্তব্য কোথাও শোনা যায়না । কারণ, তাদের কাজের ধরন টা ই আলাদা । এই কাজের জন্য তাকে ভিন্ন ছাঁচে প্রস্তুত করা হয় । যাহোক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’র কপাল তো আরো খারাপ । নানাবিধ কারণে সেনাবাহিনীকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে । যেকোন প্রতিষ্ঠানের অতীতে কলংক থাকতেই পারে । কিন্তু তাই বলে সেই প্রতিষ্ঠান “আজন্ম কলুষিত” এই ধারনা পোষন করা বোধহয় ঠিক হবে না ।
ইউ এন মিশন নিয়ে অনেক কথা শুনি । কৌতূহলী হয়ে এ বিষয়ে জানতে গিয়ে কিছু তথ্য আবিস্কার করলাম । ইউ এনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এত চাহিদার কারণের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু বিষয় । আমি একবার ভেবেছিলাম যে আমাদের সেনাবাহিনী এমন কি হয়ে গেল যে সারা দুনিয়ায় এত চাহিদা । এই গরীব দেশের আর্মির অস্ত্র সাজ সরঞ্জাম কিই বা আছে । দুনিয়ায় এত উন্নত দেশের আর্মি আর সাজ সরঞ্জাম থাকতে কেন বাংলাদেশ ইউ এনে সবোচ্চ সংখ্যক সেনা পাঠাচ্ছে । আসলে বাংলাদেশ আর্মির মত এত সস্তায় এত ভাল পারফরম্যান্স অন্য কোন আরমির কাছে ইউ এন পায় না বলেই এদের এত চাহিদা । ন্যাটো সহ অন্যান্য ফোস চৌকস হলেও ভীষণ ব্যয়বহুল । একই সাথে আছে ডিসিপ্লিনের ব্যাপার, বিশেষত আফ্রিকার দেশগুলোতে আবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত সেনা সদস্যদের এইডস আক্রান্ত হবার সম্ভবনা । সেদিক থেকে আমাদের দেশের সেনারা অনেক নিরাপদ ।
এখন আসি মিশন এলাকায় আমাদের সেনাদের কাজ প্রসঙ্গে । এ ব্যাপারে আমার জ্ঞান সীমিত । যতটুকু জানি, মিশনে যুদ্ধ করতে যে সরঞ্জামাদি লাগে, সেগুলো জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী না হলে তার ভাড়া পাওয়া যায়না । জাতিসংঘ কতৃক এই নিয়ম করা হয়েছে যাতে করে ভালো সরঞ্জামাদীর মাধ্যমে শান্তি রক্ষীদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। অথচ আমাদের সেনারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুরনো এবং ঝুঁকি-পূর্ণ সরঞ্জামাদি দিয়ে মিশন করে আসে । নইলে সরকারের মোটা অঙ্কের টাকা লাগতো এ সব সরঞ্জাম কিনতে । তারা পুরনো সরঞ্জাম নিয়ে যায় এই মোটিভেশনে যে, আমাদের দেশ গরীব, নতুন সরঞ্জাম কেনার পয়সা নেই । কষ্টটা না হয় আমরাই করি । যখন জাতিসংঘ থেকে যখন ইন্সপেকশনে আসে, তখন, সাধ্যের সব কিছু দিয়ে সেই পুরোনো জিনিষ গুলোকে “যুদ্ধোপযুক্ত” হিসেবে সার্টিফাই করায় তারা । কারণ, যুদ্ধোপযুক্ত না হলে রিম্বার্সমেন্টের টাকা পাওয়া যাবেনা। রিম্বার্সমেন্টের এই টাকা কিন্তু সেনারা নিজেরা পায়না। । পায় সরকার। মিশনে সেনাদের থাকার জন্য পাকা ঘর পাওয়ার কথা । জাতিসংঘ সেই ঘর না দিতে পারলে বিনিময়ে টাকা দেয় । আমাদের সেনারা বেশির ভাগ সময়েই তাবুতে থাকে। তাবুতে থাকার কারণে প্রাপ্ত মোটা অংকের পুরো টাকাটাই কিন্তু সরকারী কোষাগারে জমা হয় ।
আমরা গারমেন্টস সহ অন্যান্য অনেক শিল্পের মাধ্যমে রাজস্ব আয়ের ব্যাপারে অবগত আছি । একই সাথে এটাও সত্য যে এদেশেই শ্রমিকদের প্রাপ্য সামান্য বেতনের জন্য রাজপথে নামতে হয় । তেমনি বিপুল পরিমান রাজস্ব প্রদানকারী সেনাবাহিনির এই রূপটি কিন্তু আমাদের অগোচরেই থাকে । চোখের সামনে আমাদের শুধু ভাসে জলপাই রঙের নির্মমতা । দুর্ভাগা আমরা । কত ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করলে আফ্রিকার একটা দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে অধিষ্ঠিত করে দেশকে এমন বিরল সম্মান এনে দেয়া যায় কখনো ভেবেছেন কি ?
কিছু উচ্চাভিলাসী সেনানায়কের অতীতের কর্মফল সেনাবাহিনীর উপর না চাপিয়ে আসুন এদেরকে আমাদের নিজেদের সেনাবাহিনী ভাবতে শিখি । সেনাসদস্যদেরও সেনানিবাসের গণ্ডিতে বসে না থেকে পাকিস্তানি “ব্লাডী সিভিলিয়ান” মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রমাণ করতে হবে যে তারা আমাদের সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ । আপনার আমার ভাই,বোন,ছেলে,মেয়ে যে সেনাবাহিনীতে আছে,সেই সেনাবাহিনীকে আমাদের নিজের, আমাদের দেশের সেনাবাহিনী ভাবতে শিখতে হবে । পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদেরই নিশ্চিত করতে হবে যেন মনের ভুলেও আর কোন সেনানায়ক গনণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করার দুঃস্বপ্ন না দেখেন ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনি না থাকলে বহু আগেই পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে যেত । পারবত্য অঞ্চলে সেনাবাহিনির অত্যাচারের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে অনেক বুদ্ধিজীবিদের নাকি কান্না কাদতে দেখেছি । অথচ,ভারতীয় সেভেন সিস্টার্সে ৪০ বছর ধরে প্রায় ৪ লাখ সৈন্য মোতায়েন আছে। কাশ্মীরে গত দুই দশক ধরে পাচ লাখেরও বেশী ভারতীয় সেনা মোতায়েন আছে। এসবের বিরুদ্ধে কথিত কোন মানবাধিকার গ্রুপ টু শব্দ করতেও দেখা যায় না । তাহলে কেন পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে আপনারা উঠেপড়ে লেগেছেন ? আপনারা কি দেশের এক-দশমাংশ ভূমির নিরাপত্তা চান না? নাকি এ অঞ্চল কোন বিশেষ স্বার্থে অরক্ষিত রাখতে চান ? পাহাড়ি জনপদে বাঙ্গালীদের ওপর শান্তি বাহিনীর বা অধুনা ইউ পি ডি এফ ক্যাডারদের নির্মম অত্যাচারের কথা জানেন কয়জন ? আমাদের সেনাবাহিনী ফেরেশতা নয় । তারা ধোয়া তুলসী পাতাও নয়, দোষ ত্রুটি তাদের থাকবে এটাই স্বাভাবিক ।কিন্তু দেশের অখন্ডতা রক্ষার জন্য শান্তি বাহিনির সাথে লড়াইয়ে কত সেনা সদস্য যে জীবন বিসরজন দিয়েছেন তার খবর কি আমরা রাখি ? দয়া করে ঠাণ্ডা এসি রুমে বসে টক শোতে গরম গরম বুলি না ঝেড়ে একটু কষ্ট করে পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে দেখে আসুন সেখানে আসলে কি হচ্ছে ।
সত্য কথা বলতে কি পাহাড়ের বেশির ভাগ মানুষই অনেক সহজ সরল এবং সমতলের মানুষদের তুলনায় অনেক অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত । এদের চাহিদা খুবই কম । আদিবাসী ইস্যুতে তাদের কিছু আসে যায় না,এইসব মারপ্যাচ তারা বোঝেনা । তারা চায় দুবেলা দুমুঠো খেয়ে একটু শান্তিতে থাকতে । শান্তিবাহিনীর উত্তরসুরী ইউ পি ডি এফ কে চাঁদা না দিয়ে এরা বাচতে চায় । এরা চায় না ইউ পি ডি এফ - জে এস এস আর সেনাবাহিনীর দ্বৈরথের বলি হতে । এদের চাহিদা খুবই কম । সহজ সরল এইসব মানুষকে নিয়ে গুটি চালছে অল্প কিছু উচ্চাভিলাসী - ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি ।
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি । পার্বত্য অঞ্চলকে আরেকটি পূর্ব তিমূর তৈরির কাজে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, ইউরোপীয় কমিশন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও তার প্রচার মাধ্যম। বিপুল সার্কুলেশানের অধিকারী একটি পত্রিকা, তার ইংরেজী সহযোগীসহ প্রায় সব প্রিন্ট, ইলেট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়া । টেলিভিশন অনবরত বলছে, পাহাড়িরা নিগৃহীত। তাদের রক্ষা করতে হবে । ইউএনডিপি সেখানে পাহাড়িদের পক্ষে প্রকাশ্যে প্রচারণা চালাচ্ছে ।
খবরে প্রকাশ, দুটি প্রভাবশালী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা সেখানে এজেন্সি খুলে বসেছে । চরম বাংলাদেশ বিরোধী হিসেবে পরিচিত বৃটিশ লর্ড সভার মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান লর্ড এরিক এভেরি্র নেতৃতে গঠিত কথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ভূমি কমিশন সারা বিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ গুলোতে ব্যাপক প্রচারনা চালাচ্ছে যে, বাংলাদেশের আদিবাসী (?) দের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। সেখানে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে ইত্যাদি। আমার মত অনেকেই বিশ্বাস করবে না দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ না জেনে আদিবাসী ইস্যুকে উস্কে দিচ্ছে ।
লর্ড এরিক এভেরি্র নিজের ব্লগেই তার সম্পর্কে লেখা হয়েছে তিনি Founder, Parliamentarians for East Timor, 1988; এই এভেরী ১৯৮৮ সালে আন্তর্জাতিক ভূমি কমিশন গঠন করে পুর্ব তিমুর বিচ্ছিন্ন করার ক্ষেত্রে অন্যতম ভুমিকা পালন করেছিলেন।
এদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ভূমি কমিশানে লর্ড এরিক এভেরি্র সাথে একসাথে কাজ করে যাচ্ছেন এ্যাড সুলতানা কামাল চক্রবর্তী (স্বামী শ্রী রঞ্জন চক্রবর্তী) , ড. স্বপন আদনান (সিঙ্গাপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়), ব্যারিষ্টার সারা হোসেন (স্বামী ডেভিড বার্গমান), ড. মেঘনা গুহ ঠাকুরদা প্রমুখ ।
আর এদেরকে সাথে নিয়ে নীলনকশা বুনে যাচ্ছেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীস রায় । আমরা অনেকেই জানিনা এর বাবা রাজা ত্রিদিব রায় ৭১ সালে মহান মুক্তি সংগ্রামে পাকিস্তানের কট্টর সমর্থক ছিলেন এবং পাহাড়ী রাজাকারদের লীডার ছিলেন । বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে অদ্যাবধি তিনি তার সপ্নের দেশ ‘ফাকিস্তানে’ বসবাস করছেন । আর দেবাশীস রায় কে সেনাসমথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেস্টা নিয়োগ দেয়ার পর থেকেই তার পক্ষ থেকে এই আদিবাসী বিষয়ক বিভিন্ন উস্কানিমুলক বক্তব্য প্রদান শুরু হয় । স্বঘোষিত এক ঘৃণিত রাজাকারের ছেলেকে কেনই বা সেনাসমথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেস্টা নিয়োগ দেয়া হল আর কেনই বা আজকের সুশীল সমাজ একে এত মুল্যায়ন করে এই প্রশ্ন আপনাদের কাছে রেখে গেলাম ।
ড. জাফর ইকবাল ,তবে কি আমরা ধরে নেব আপনিও এদের সাথে যোগ দিয়েছেন ? সারা জীবন আপনার পিতার হন্তারক রাজাকার আলবদরদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে শেষ পর্যন্ত কি রাজাকার ত্রিদিব রায়ের ছেলে দেবাশীস রায়ের ভাব আদর্শে কাজ করে যাচ্ছেন ? আর কারো কথা জানিনা, তবে আমি আমার প্রিয় একজন লেখককে এই ভুমিকায় দেখলে খুবই কষ্ট পাব । প্রিয় জাফর ইকবাল, মনে বড় দিলেন কষ্ট ......
ডিস্ক্লেইমারঃ এই লেখাটি এমন একটি বিষয় নিয়ে যেটি নিয়ে ইতিমধেই অনেকগুলো লেখা প্রকাশিত হয়েছে । আমি শুধুমাত্র আমার চিন্তাগুলো যুক্তি দিয়ে সাজাতে চেয়েছি । এক্ষেত্রে অনেকের লেখা থেকেই রেফেরেন্স সংগ্রহ করেছি। হোসেন খিলজির একটি লেখা থেকে কিছু কিছু অংশ হুবুহু তুলে দিলাম । আর সবশেষে একটি কথা-ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি যে, এই দেশে আমার যতটুকু অধিকার,রাঙ্গামাটি বা খাগড়াছরির পাহাড়ে জন্ম নেয়া সব শিশুরই একই অধিকার । স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে কি আমরা সম অধিকার নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঁচতে পারি না ?