সকালে ফোনে মিসড কল দেখে দ্রুত ফোন ব্যাক করি।
-স্লামালিকুম স্যার!
-অলাইকুম সালাম। তোমাকে তো লক্ষ-কোটি বছর ধরে দেখিনা…
-স্যার, শীতকাল তো, একটু শীতনিদ্রায় গিয়েছিলাম।
-হা হা হা…শীতনিদ্রা?
-স্যার, আপনি কেমন আছেন? ঢাকা এসছেন?
-হ্যাঁ, ঢাকা এসেছি। বিকালে বাংলা একাডেমিতে একটা বক্তৃতা আছে।তুমি ফ্রি আছো? সময় পেলে এসো।
-জ্বী স্যার অবশ্যই আসবো।আপনার বক্তৃতা....
-না না, আমার বক্তৃতার জন্য না, তুমি আসলে একটু ঘুরবো আরকি!বক্তৃতা ৪টায়।তুমি কখন আসবা?
-স্যার, আপনি কখন যাবেন?
-আমি তো চলে যাবো সকালে।
-স্যার আমি কখন যাবো?
-তুমি কখন ফ্রি আছো? এখন ফ্রি আছো?নাকি হাতে কাজ আছে?
-না স্যার, আমি ফ্রি আছি।
-তাইলে তুমি তাজমহল রোডে বঙ্গবন্ধু স্কুলের দক্ষিণ গেটে চলে আসো, আমরা এখান থকে একসাথে চলে যাবো।
-জ্বী স্যার, আমি আসছি।
মাহবুব স্যার। বাংলা একাডেমির ইট-পাথর থেকে শুরু করে সব লেখক-প্রকাশকদের কাছে তিনি লেখক, গবেষক, ড।মাহবুবুল হক। জীবন উৎসর্গ করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায় ।অসংখ্য গবষণাধর্মী ও পান্ডিত্যপুর্ণ বইয়ের পরিশ্রমী লেখক।তাঁর ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ এখন আধুনিক বাংলা ভাষা চর্চায় ক্ল্যাসিক! দুই বাংলার সব রথি-মহারথীরাই এখন বানান নিয়ে কাজ করার সময় এই বইটিকে সামনে রাখেন। স্কুল-কলেজ়ে পাঠ্য প্রায় সব বাংলা বই তাঁর সম্পাদনায় করা। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিশু ষষ্ঠ শ্রেণী থেকেই তাঁর কাছে পাঠ নিতে শুরু করে; তাঁর কাছে পাঠ নিতে নিতেই পার করে তারুণ্যের প্রথম প্রহর!এদেশের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বিদেশের ম্যাক্সিম গোর্কির মত লেখকেরা তাঁর গবেষণায় নতুন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছেন; তৃষ্ণা মিটিয়েছেন বিশ্লেষণী ও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের। বাংলা একাডেমির ‘প্রমিত বাংলা বানান’ ও ‘প্রমিত বাংলা ব্যাকরণ’ প্রণয়ন প্রকল্পের তিনি অন্যতম পুরোধা। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের তুখোড় ছাত্র নেতা; মুক্তিযুদ্ধের সফল সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।
উদার, মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল চিন্তার ধারক এই বিরাট মানুষটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে্র কেন্দ্রীয় বিতর্ক সংগঠন- সিইউডিএস’ এ বিতর্ক করতে গিয়ে। তিনি এই সংগঠনের মডারেটর। দীর্ঘ ছয় বছর তাঁর সান্নিধ্যে থেকে বিতর্ক করে, বিতর্ক শিখে এবং অন্যদের বিতর্ক শেখানোর দায়িত্ত্ব পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করে যখন ঢাকা এলাম, তার এক বছর পর আজ স্যারের ফোন পেয়ে মনটা উদ্বেল হয়ে উঠলো! তাই বিকালের অপেক্ষা না করে সকালেই স্যারের সঙ্গ ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না। রিকশা করে, রিকশাওয়ালার মহিমায় পথ ভুল করতে করতে এবং একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে করতে, চলে গেলাম তাজমহল রোডে, স্যারের মেয়ের বাসায়। সেখান থেকে রিকশা করে নীলক্ষেত। বাংলা একাডেমি স্যারকে এবার আলাউদ্দিন আল আজাদের রচনা সমগ্র সংকলন ও সম্পাদনা করার ভার দিয়েছে, তাই আ।আ।আজাদের যেই বইগুলো সংগ্রহে নেই, সেগুলো কিনতে হবে। সিইউডিএস নিয়ে আলোচনা করতে করতে নীলক্ষেত চলে এলাম। স্যারের সাথে নীলক্ষেতের গলির দোকানে বসে সিঙ্গারা আর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দু কাপ রঙ চা। সকালটা স্মরণীয় হয়ে থাক!
পুরনো বইয়ের দোকানগুলো ঘেঁটে কোনো বই পাওয়া গেলো না। ফাঁকতালে আমি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটা বই পছন্দ করে বসলাম! স্যার দাম দিলেন। সেখান থেকে রাফিন প্লাজায় ফ্রেন্ডস লাইব্রেরি। ইংরেজি সাহিত্যের কিছু রেফারেন্স বই কিনে তখনই সেগুলো চট্টগ্রামে কুরিয়ার করা হলো! সেখান থেকে রিকশায় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এক্সিলেন্সের ডর্মিটরি। ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃপবিত্র সরকার সেখানে আছেন। দীর্ঘ সত্তর বছর পর বাংলাদেশে এসে জমজ বোনের সাক্ষাত পাওয়ার কথা প্রথম আলোতে লিখে দুবছর আগেই তিনি এদেশের সাধারন পাঠকের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন।মাহবুব স্যারের কল্যানে গত বছর তাঁর সাথে পরিচয়।আজ একসাথে দুপুরের খাবার খেলাম।সেখান থেকে বেরিয়ে চলে এলাম বাংলা একাডেমিতে।
বিকালে যে প্রবন্ধটি নিয়ে স্যার বক্তৃতা দিবেন, তার একটি কপি আনতে হবে।গেলাম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড।শামসুজ্জামান খান এর অফিসে। স্যার শামসুজ্জামান খান এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।শামসুজ্জামান খান উত্তরাধিকারের নতুন একটি সংখ্যার এক কপি স্যারকে আর এক কপি আমাকে উপহার দিলেন। কপিতে তাঁর অটোগ্রয়াফ নিয়ে নিলাম।শামসুজ্জামান খান এদেশের ফোকলোর চর্চা নিয়ে একটি সংকলন সম্পাদনা করেছেন। সেটিতে মাহবুব স্যারেরও একটা লেখা আছে; তিনি স্যারকে এরও একটা কপি দিলেন। (বইটা অনেক বড়; সভাবতই এর দাম অনেক বেশি হবে।এ কারণেই কি আমি এর কপি বরাদ্দ পেলাম না? মনে কিঞ্চিত বেদনা অনুভব করলাম।কিন্তু তা অব্যাক্তই রইলো!)বইটা ইংরেজীতে লেখা। মাহবুব স্যার বইটা আমার হাতে দিয়ে বললেন- তুমি ইংরেজির ছাত্র, ইংরেজি পড়ে দেখো কেমন হলো?আমি লজ্জা পেলাম। বললাম- স্যা্র, ইংরেজির হলেও,আমি ছাত্র, আপনারা শিক্ষক!
সূচী দেখে স্যারের লেখাটা বের করে পড়া শুরু করলাম। মাহবুব স্যার তাঁর ফোকলোর চর্চার শুরুর গল্প বলেন। শামসুজ্জামান স্যারই প্রথম মাহবুব স্যারকে ফোকলোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণে যুক্ত করেন। স্যার এই সুযোগে সেই কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললেন না। এখান থেকে বেরিয়ে আমরা ঢুকে গেলাম একাডেমির কনফারেন্স রুমে।সেখানে স্যার আলোচ্য প্রবন্ধটা পড়লেন। আমিও পড়লাম।‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নজরুল চর্চা প্রসঙ্গে’ লেখক -মুহম্মদ নুরুল হুদা। বক্তৃতায় কী বলা যায় তাই নিয়ে স্যার টুকটাক কথা বার্তা পাড়লেন। স্যারের স্বভাবসুলভ বিনয়-‘আমি কী বলবো?আমার বক্তৃতা কি ভালো হবে?’ ‘কী বলা যায় বলতো…?’ আমি তেমন কিছু বললাম না। স্যার কি প্রস্তুতি নেন নি? এর মধ্যে মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সাবেক প্রধান জনাব শফিউল আলম সাহেব এলেন। স্যারের সাথে দু একটা কথা বললেন; স্যারকে অভয় দিলেন- ‘Don’t take it seriously! এটা তেমন কোনো আলোচনা হবে না। স্বাভবিক কথাবার্তা বলে চালিয়ে দেবেন। আমি আপনার বক্তৃতাটা শুনে চলে যাবো। অন্যেরা কী বলবেন আমি জানি’। (তিনি তা’ই করেছেন। স্যারের বক্তৃতা শেষে চলে গেছেন।) চা- বিস্কুট খেয়ে আমরা সভাস্থলে এলাম। প্রোফেসর এমিরিটাস ড।রফিকুল ইসলাম আজকের সভাপতি; তিনি এসে বসে আছেন।বোঝা গেলো সময়জ্ঞানে উনি বাঙ্গালি নন।আজকের মূল প্রবন্ধকার কবি নুরুল হুদাও উপস্থিত।অন্য আলোচক ডঃ গুলশান আরা কাজী, অভিনেতা রামেন্দু মজুমদারসহ অনেকে বসে গল্প করছেন।স্যারকে বসিয়ে আমি চলে গেলাম সভামঞ্চের সামনে সারিবদ্ধ চেয়ারে।
একটু পর (ব্যতিক্রমভাবে যথাসময়ে) মঞ্চের পর্দা উঠলো। তখনো মঞ্চে একটি চেয়ার খালি! উপস্থাপিকার ঘোষণার মাধ্যমে কবি নূরুল হুদা তার প্রবন্ধ পাঠ শুরু করলেন।মিনিট দশেক পর আরেক আলোচক রশীদ হায়দার মঞ্চে উঠলেন।(তিনি কি আমাদের সময়জ্ঞানী বাঙ্গালীর উত্তরাধিকার ধারন করলেন?) নুরুল হুদা তার প্রবন্ধে বাংলাদেশের বাইরে কারা কোথায় কোন কোন ভাষায় নজরুল চর্চা করেছেন বা করছেন তার একটি সংবাদ পাঠককে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।নুরুল হুদার প্রবন্ধ পাঠের পর আলোচক গুলশান আরা কাজী আলোচনা করলেন।তিনি তাঁর নিজের কাজের কিছু খবর দিলেন।নজরুল চর্চার প্রেরণা হিসেবে খবরগুলো ভালোও ছিলো।তারপর এলেন মাহবুব স্যার। স্যার নাকি কী বলবেন , খুঁজে পান না? অথচ মনে মনে কামান দাগিয়ে নিয়ে এসেছেন!!!
মুগ্ধ হলাম! একটা সেমিনারের বক্তৃতা যেরকম হওয়া উচিত, ঠিক সেরকম। প্রথমেই মুল প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ দিলেন। লেখককে ধন্যবাদ দিলেন নজরুল চর্চার ওপর একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধ লেখার জন্য।তারপর সরাসরি নিজের বক্তব্যে চলে গেলেন; কিন্তু মুল প্রবন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন না।বরং একটি সেতু তিনি ধরে রাখলেন রেফারেন্স দিয়ে। তারপর বিদেশে নজরুল চর্চা নিয়ে এমন কিছু চমৎকার তথ্য দিলেন যা সভাপতিকেও চমৎকৃত করে ছাড়লো। কথার বাহুল্য নেই, অথচ বাদ পড়েনি কিছুই! যেন ভাস্করের গড়া সেই নারীমুর্তী- যার কোথাও মেদ নেই, অথচ প্রয়োজনিয় বাঁকগুলোও অদৃশ্য নয়।একেবারে ছাঁচে ঢেলে গড়া!বক্তৃতা শেষ করলেন ছোট গল্পের মতো- ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ!’ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমার হাত দুটি তালি দিতে লাগলো। দেখলাম অন্যদের বেলায়ও তাই! লেখক নুরুল হুদা স্যারের সাথে হাত মেলালেন। বোঝা গেলো প্রবন্ধকার এতক্ষণে তার যথাযথ আলোচনা পেয়েছেন! রশীদ হায়দারের সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর সভাপতির আলোচনায় ডঃরফিকুল ইসলামও মাহবুব স্যারের বক্তৃতার প্রশংসা করলেন।সভা শেষে আমরা আবার গেলাম একাডেমির কনফারেন্স রুমে। সেখানে আরেক পর্ব চা-বিস্কুট খেয়ে নেমে গেলাম ।
এবার মেলা ঘুরবো। সাথে আছেন স্যারের আরেক ছাত্র, এখন কলেজের অধ্যাপক, মিজান ভাই। তিনজন মিলে বিভিন্ন স্টল ঘুরবো। স্যারের অন্য আরেক ছাত্র একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আছেন। মেলায় এসেছেন কভার করতে। স্যারকে ধরলেন ২ মিনিট স্ক্রিনে কিছু বলতে।স্যার ছাত্রের আবদার রক্ষা করলেন।তারপর বেরিয়ে পড়লাম মেলা ঘুরতে। স্যার যে যে বই কেনেন আমি আর মিজান ভাই সে বই ব্যাগে ঢুকাই আর কাঁধে চড়াই।মিজান ভাইও কিছু বই কিনেন। কিনি না শুধু আমি। পকেটে যে টাকা নাই! বিভিন্ন স্টলে স্যার তার প্রকাশকদের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। প্রকাশকরা বাধ্য হয়ে এই ভীড়ের মধ্যেও আমাদের সাথে সৌজন্যের ‘হা-হু’ করেন। বেচারাদের কষ্ট দেখে মায়া লাগে!
সন্ধ্যার শেষে এসে একাডেমির ক্যান্টিনে বসে গরুর মাংসের চাপ দিয়ে স্যারের প্রি্য লুচি ভাজা! এরমধ্যে মেলায়’ই হাইস্কুলের ব্যাকরণ বইয়ের ফাইনাল পান্ডুলিপি নিয়ে হাজির একজন। স্যার মেলার মাঠে বসেই দু একটা কারেকশন দিলেন। সেই ভদ্রলোক আবার আবৃত্তিকারও। তার আছে আবৃত্তির এলবামের স্টল। সেখান থেকেও কেনা হলো কিছু। তারপর ভবিষ্যতের জন্য কিছু সুখস্মৃতি আর গল্প পুঁজি করে ট্যাক্সি করে বাসায়।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:১৮