সেদিনের দুপুরটা ছিল ভীষণ হলদে। মে মাসের দুপুর, নিষ্ঠুর ভাবে পুড়ছিল সব। বিকেলের দিকে একটু বাতাস ছাড়ল তবে সেও কি গরম! যেন এক হাড়ি গরম ভাতের ভাপ। সেই ভাপের দিনে একটা জলের ফোঁটার মত টলছিলাম আমি, কচু পাতায় জল যেমন টলে। কোন এক অভিমানে চোখের কোটর দুটো ভরে জলের ডোবা হচ্ছিল, সে লুকোতে স্নানঘরে ঢুকলাম। চোখ মুছেই বেরিয়েছি তবুও শ্বশুর কিছু বুঝলেন। বর্ষা নেমে গেলেও তার পলি দেখে লোকে যেমন পরিমাণটা বোঝে। বললেন, মা তুমি একদম কাঁদবে না। নিজের বাড়িতে কেউ কাঁদে না। এটাই তো তোমার বাড়ি। চোখের জল লুকোতে আমি দেয়ালের দিকে তাকালাম। এদের দেয়ালের রঙটি একেবারেই আধুনিক নয়। সোফাগুলোও বেশ পুরনো। তবে কবে কিনেছে এরা, কবে রঙ লাগিয়েছে এই দেয়ালে! সেদিন কি মিস্ত্রীদের কোন ফ্রিজে রাখা মিষ্টি দেওয়া হয়েছিল। মা যেমন দিত, ঘরে থাকলেই দিত। সেসব গল্পের কিছুই তো আমি জানি না। তবুও এরা বলছে এটাই নাকি আমার বাড়ি। এ বাড়ীর কিছু ইতিহাস অবশ্য আমি জানি। স্বামী বলেছিল ওর স্কুলে পড়ার সময় তৈরি হয়েছিল বাড়িটা কিন্তু এটুকু জানলেই কি ওটা আমার বাড়ী হয়ে যায়!
এ বাড়ীর কোথায় কি থাকে সেটিও আমি জানি না, যখন ইচ্ছে ফ্রিজ খুলে খেতে পারি না। একটা গাদা নেবার পর আরেকটা পেটির কথা বলতে পারি না। ভাত এক চামুচ বেশি খেতে ইচ্ছে করলেও একদলা খিদে নিয়ে ঊঠে পড়ি। তবুও এটাই আমার বাড়ি! স্বামীও তাই বলেছে। নিজেরই যদি বাড়ি তবে সংকোচরা কেন এত শিল নোড়ার মত পিষে মারে আমায়। আমার স্বামীর তো এরকম সংকোচ হয় না এ বাড়িতে। সে তো তার ইচ্ছে মতই খায়, মেন্যু ঠিক করে, চারপদ হলে পাঁচপদের বায়না করে। সে বায়নার খাবার আমার পাতেও যে পড়ে না তা নয়। তবে যতটুকু তুলে দিতে চায় ঠিক যেন ততটুকুই। অনেকবার তো নিতে ইচ্ছে করলেও না বলি। কারন আমি জানি এ বাড়িতে ইচ্ছে করলেই হ্যাঁ বলা যায় না। অথচ আমারও তো একটা বাড়ি ছিল যেখানে ইচ্ছের কথা বলতে পারতাম, একশো একটা বায়না ধরতে পারতাম। দশটা পর্যন্ত ঠ্যাং উল্টে ঘুমাতে পারতাম, মা ডাকতে এলে অহেতুক বিরক্তের জন্য রাগতে পারতাম। কিন্তু এ বাড়িতে তো কখনও রাগি না আমি, বরং ভাবি কেউ যেন আবার রেগে না যায়।
খুব সকালে শাশুড়ি ওঠার আগে এক চোখ ঘুম নিয়ে উঠি। শাশুড়ি আমায় কিছুই করতে দেন না, শুধু দাড়িয়ে থেকে দেখে শিখতে বলেন। রুটি বেলা শিখলে একদিনেই শেখা হয়ে যায়। তবু সে শিখতে রোজ আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি আমি। শাশুড়ির গায়েও একটা মা মা গন্ধ আছে। তবুও কিছুতেই সে মায়ের খুব কাছে ঘেঁষতে পারি না আমি। আমার সবসময় মনে হয় আমি যেন এক ইন্টার্ভিউ দিতে এসেছি, যেখানে আমার প্রতিটি কার্যক্রম সবাই পর্যবেক্ষণ করছে। কোন ভুল পেলেই ইন্টার্ভিউ বোর্ডের কর্তারা নাখোশ হতে পারে, পরীক্ষায় নম্বর কমে যেতে পারে। আমার শ্বশুর শাশুড়ি তো খুব ভাল। এরা তো আমাকে কোনোদিন বকেনি, মারেনি। তবুও কেন এমন মনে হয় আমার! শাশুড়িকে আমি খুব ভালবাসিও। সেও তো ভালবাসে আমাকে। কোথাও যাবার আগে শাড়ীর কুঁচি ধরে দেয়, কপালের টিপ মাঝখানে বসিয়ে দেয়, লিপিস্টিকের রং বলে দেয়, কোন শাড়ীটা আজ পরব সেই বলে দেয়। আর কেঊ আসলে কত বানিয়ে বানিয়ে প্রশংসা করে, খুব ভালো বউ হয়েছে আমাদের, আমার অনুমতি ছাড়া কিছুই করে না, এক চুলও নড়ে না। সবাই খুব সন্তুষ্ট হয় শাশুড়ির কথায়। আর আমি বুঝি ইচ্ছের বলিরা তাহলে সার্থক। মায়ের বাড়িতে তো কোন ইচ্ছে বলি দেইনি আমি। বরং রোজ কি সব আজগুবি ইচ্ছে হত আমার।
ফিরিনিতে মায়ের বাড়ি যাই। রোজকার মত শ্বাস নেই। তবে মনে হয় এ শ্বাস যেন অনেকটা দম বন্ধের পর নিয়েছি। প্রথমেই গিয়ে মায়ের ঘরে শুয়ে পড়ি। আমার জিনিষ কেন এলোমেলো বলে রাগ করি, ভাই-বোনের উপর খবরদারি করি, অনিয়মের জন্য বাবাকে বকি। অনেকদিন পর একটা ক্ষমতা হাতে পাই যেন। রান্নার মেন্যু ঠিক করি। কষা মাংস আমার জন্য আলাদা তুলে রাখতে বলি। ঘোমটা ফেলে স্কার্ট পরে বাবার সামনে ঘুরি। ব্যাল্কনিতে দাড়িয়ে ছেলেদের খেলা দেখি। কার্নিশে পা ঝুলিয়ে মীমদের জাম গাছের জাম পাড়ি। যেমন ইচ্ছে তেমন থাকতে পারি আমি আমার এ বাড়িতে। ইচ্ছেমত টিভি চ্যানেল বদলাতে পারি। বিছানার চাদরের রং অন্ধকার বলে মাকে মতামত দিতে পারি। বাবা-মা সব যে মানে তা নয়, তবুও আমার মতামতের ভারি এ মূল্য বাড়ীতে, ভীষণ স্বাধীনতা এ বাড়ীতে। ইচ্ছের ঘুড়ির সুতো এ বাড়ীতেও যে ছেড়ে না তা নয়, তবে সে ভীষণ কম। ছিঁড়লেও আর একটার বায়না দেওয়া যায় এ বাড়িতে। আমি বুঝি, নিয়ম না মানার জন্য খেয়াল খুশীর জন্য এ বাড়িটা আর নিয়ম মানার জন্য ঐ বাড়িটা।
ও বাড়ীতে কেঊ আমাকে শিকল পরায়নি, কেঊ অমর্যাদা করেনি তবুও কি ভীষণ পরাধীন অনুভব করি ও বাড়ীতে। আমাদের বাড়িটাকে এখন একটা ভীষণ মুক্ত আকাশ মনে হয় আমার, আর সবাই যেটিকে এখন আমার নিজের বাড়ি বলছে সেখানে মনে হয় নজরবন্দী। আমার খুব ইচ্ছে করে আমার মুক্ত আকাশ বাড়িটায় থাকতে। কত শৈশব, কৈশোর মেখে আছে এ বাড়িতে। এ বাড়িটাই আমার বাড়ি। আমাদের শহরে অনেক উঁচু বাড়ি আছে, তবুও যেন শহরে নামলেই আমি ঐ একটি বাড়ীই দেখি।
যাবার সময় সব গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। মা বলল, বাড়ির কাপড়ের সাথে তোর কাপড় মেশাসনি তো? শেষে আবার খুঁজে পাবিনে। মায়ের কথায় কিছুটা বোধোদয় হয় আমার। মা বলল, আমার কাপড় বাড়ির কাপড় নয়। তাহলে বাড়িটি, সেটিও তো আর আমার নয়। তাহলে কোনটি আমার বাড়ি! যে বাড়িতে খেয়ালের এত বিসর্জন, যে বাড়ীতে নজরবন্দী থাকি সেটিই কি আমার বাড়ি!!!