আমার এক জুনিয়র ভাই আছে। সে রোজ মসজিদে যায়, নামাজ পড়ে।
আমি যেহেতু তাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি, ফেসবুকে তার কর্মকাণ্ড দেখি, সেহেতু আমি জানি ঈশ্বর যে আছে এ কথা সে নিশ্চয়ই মানে না। একদিন তাকে ধরলুম, আচ্ছা তুই কার কাছে যেয়ে কপাল ঠুকিস বলত? তুই যদি জানিস ই সে নেই, তবে কার কাছে যাস? ভারী হিপক্রেট তো তুই।
ও বলল, “আপু কি করব”?
ওর রুমমেট একজন বড় ভাই। সেই বড় ভাই ছোট ভাইয়ের হেদায়াতের জন্য তাকে মসজিদে নেন। সেও সিনিয়র ভাইয়ের সাথে বেআদবি হবে বলে, অথবা তিনি কষ্ট পাবেন এই ভেবে কিছু বলে না। আমি আর আমার স্বামী দুজনেই সেখানে ছিলাম। তাকে বলেছি তুই যেটা বিশ্বাস করবি, সেটাই করবি, তাতে অন্তত ঈশ্বরকে ঠকাবি না কারণ সে আর এক পাপ। আর ঈশ্বর এত অবুঝ আর বিবেকহীন নন যে তুই নামাজ না পড়লে তোকে চাপাতি নিয়ে তাড়া করবে। তোর যেখানে যেখানে সংশয় সে অংশগুলো আবার পড়, আলোচনা কর, সংশয় কাটলে ঈশ্বরকে ডাকিস, আর যদি না কাটে ডাকার দরকার নেই।
আমার প্রার্থনাগুলো খুব নিয়ম ধরে কখনও ছিল না। সুখে থাকলে সেগুলো কমত, দুঃখে থাকলে, বিপদে পড়লে পরীক্ষা আসলে সেগুলো বাড়ত। তবে সে সব ছিল সময় আর অলসতার জন্য। তবে এক সময় আমার মনে হয়েছিল ঈশ্বর সত্যিই কি আছে? আমার স্বামীর সাথে এই নিয়ে প্রচুর ডিসকাশন হত। সে কিছুতেই আমাকে বিশ্বাস করাতে পারত না যেন। এক সময় রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়ে যে ঈশ্বরকে ডেকেছি তাকেই তখন মনে হত, সব যেন যুগে যুগে প্রচলিত মিথিক্যাল গল্প ।
আমি প্রচুর তসলিমা পড়েছি,তার সব বইই পড়েছি বলা যায়। স্বামী পড়েছে অভিজিৎ। স্বামী বলেছিল অভিজিৎ দা ভীষণ ভীষণ ভাল লেখে। আমি কুরানের অনুবাদ পড়িনি। স্বামী দেখতাম অবসরে গল্পের বইয়ের মত করে পড়ছে। সে রামায়ণ পড়েছে। আমি কিছুটা বাইবেল পড়েছি।
এইসব পড়াপড়ির পর যা হয়েছে ঈশ্বরকে ডাকতে এখন আমার ভারী ভাল লাগে। আমার দুঃখের দিনে ডেকে একমাত্র তাকেই পাশে পেয়েছি আমি। জীবনের একটা পরীক্ষায় আমি হেরে গিয়েছিলাম, আমার মনে হয়েছিল উনি নিশ্চয়ই চাননি বলে হয়নি। কারণ সত্যি আর তো কোন কারণ খুঁজে পাইনি আমি। আবার অনেক কিছু পেয়েছি, আমি জানি আই রিয়েলি ডোন্ট ডিজার্ভ ইট।
‘আমি ভাল নেই, তুমি ভাল থেকো প্রিয় দেশ’ যারা বইটি পড়েননি, পড়তে পারেন। এখানে লেখিকা তসলিমা কিছু অংশে লিখেছেন এস্যাইলাম পাওয়ার জন্য কে কিভাবে তাকে ব্যাবহার করেছে, পাওয়ার পর তারাই তসলিমা বিদ্বেষী হয়েছে। ইউরোপ আমেরিকা বড় আরামের জায়গা, শুধু ঈশ্বর নেই বলে যদি সেখানে চিরদিনের আস্তানা গাড়া যায় তবে কিছু মানুষ তো ভাবতেই পারে চলো সুযোগটা নেওয়া যাক।
অমুক বলছে অভিজিৎ আমার বন্ধু ছিল, আমার সাথে নিয়মিত কথা হত, তমুকে বলছে ওয়াশিকুর আমার ভাই ছিল, সমুকে বলছে অনন্ত আমার বন্ধুর বন্ধু ছিল। বইটি পড়ার পর আমার সত্যি বিশ্বাস হয়েছে মানুষ নামের প্রাণীটা যা করে এর বেশিরভাগই উদ্দেশ্য নিয়ে করে। কিছু ব্লগার এবং ফেসবুক লেখকের মধ্যে আমি এই প্রবণতা দেখেছি।
অভিজিৎ মরছে, ওয়াশিকুর মরছে, তসলিমা দেশ ছাড়ছে, এই সুবিধাবাদীদের তাতে কিন্তু কিছু হচ্ছে না বরং লাভের পাল্লায় ভারী হচ্ছে।
আজ নিলয় মরল। আচ্ছা নিলয় কি এমন লিখত যে তাতে ঈশ্বরের বিরাট সম্মানহানি হত, তেলে বেগুনে জ্বলে যেতেন তিনি, তাই চাপাতি দিয়ে খুন করে ঈশ্বরকে ঠাণ্ডা করতে হল। শুনুন হত্যাকারী ভাই ও বোনেরা ঈশ্বর ভারি ব্যস্ত, শুধু তো পৃথিবী নয়, মহাবিশ্বটারও পরিচালনা তো তার হাতে, কে কোথায় তার নিন্দে করল, এতে তার কিছু যায় আসে না।
কিন্তু আপনার তো যায় আসে! তাহলে আপনি পড়বেন না। না আপনার মনে হচ্ছে ঐ ব্যাক্তির লেখা দেশ দশের ক্ষতি করছে, তবে মামলা করুন তার নামে। আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। কারণ আপনি বিচার করার কেঊ নন? কটা আইনের বই পড়ে, কতটা আইন জেনে এই সিদ্ধান্ত নিতে হল আপনাকে? তাই দয়া করে, দয়া করে আবারো বলছি দয়া করে মূর্খ আস্তিক, মূর্খ নাস্তিক কোনটাই হয়েন না।
বেঁচে থাকতে হলে বই পড়ে বিদ্যাসাগর হতে হবে এ ধারনাই সত্যি আমি বিশ্বাসী নই। বাঁচা মানে ভালভাবে থাকা। একবারই পৃথিবীতে আসব, যা খুশি তাই করব, তবে অবশ্যই অন্যের ডিস্টারবেন্সের কারন না হয়ে। ইচ্ছে করলে সারাদিন ঘুমাবো, নেংটো হয়ে নাচবো। তবে অবশ্যই আমার নিজের ঘরে।
ধর্মটা আমার কাছে খুব ব্যাক্তিগত ব্যাপার মনে হয়। প্রাচীনযুগে সব ধর্মের পয়গম্বররা ধর্ম প্রচার করেছেন। কারন সেগুলো প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তবে কয়েক’শ বছর ধরেই এখন সেগুলো প্রতিষ্ঠিত। আমি আপনি কেউ আল্লাহ্ ভগবানের পয়গম্বর নই। তাই প্রতিষ্ঠিত কিছু নিয়ে এত ত্যানা প্যাঁচানোর দরকার নেই। লোকে সেগুলো ইচ্ছে হলে মানবে, ইচ্ছে না হলে নয়। এসব ত্যানা প্যাঁচা প্যাঁচি না করে সে সময়টাই আসুন ভালো কাজ করি। কাঊকে সাহায্য করা যায়, সামর্থ্য না থাকলে বাচ্চাদের পড়ানো যায়, ভালো ভালো চিন্তা করতে শেখানো যায় আর কিছুই করার না থাকলে কিছুটা ঘুমিয়ে নেওয়া যায়, গুণগুণ করে হেমন্ত ধরা যায়।
এ পৃথিবীটা সবার। আস্তিকদের পৃথিবীটা ঈশ্বর নিচে নেমে এসে লিখে দিয়ে যাননি, কারন তিনি অতটা নীচ নন বলে। আপনার আস্তিক হবার অধিকার থাকলে অবশ্যই অন্যজনের না হবার অধিকার আছে। তাই এই চাপাতি তোলা থেকে বন্ধ থাকুন। যদি সত্যি অন্যকে প্রভাবিত করতে চান। ভাল কাজ করুন, আপনার অজান্তেই সবাই প্রভাবিত হবে। এখন সেই আইয়্যামে জাহেলিয়া নেই, আর হেরা গুহায় আপনার উপর কোন বানীও প্রচার হয়নি যে বদর যুদ্ধ ওহুদ যুদ্ধ সব আপনাকেই করতে হবে।
ডাকোটাতে থেকে আসার আগে আমি সেখানে দুই মাস একা ছিলাম আমার বাসায়। এক আফ্রিক্যান আমেরিক্যান থাকতো আমার পাশে। বিকেলটা আমি বেরোতাম, একা একা হাঁটতাম। ওই সময়টা ওই লোকটি যেন কেমন করে তাকাতো। মনে হত আজই যেন ওর হাতে আমার শেষ দিন। দরজা ভাল করে লাগিয়ে ঘুমোতাম। তাও স্বস্তি হত না। কিচেনের সব নাইফ থাকত আমার কাছে, দরজা ভাঙলেই বসিয়ে দেব। কিন্তু তারপর মনে হত, কি করে করব, লোকটা যে ব্যাথা পাবে! আমি কিছুতেই ছুরি বসাতে পারব না।
আমাদের ব্রেইনে একটা সেল আছে, অন্যের কিছু হলে সেলটা এমনভাবে রেপ্লিকেট করে যে আমাদের মনে হয় ঘটনাটা নিজের ক্ষেত্রে ঘটছে। যারা রোজ রোজ চাপাতি মারেন তাদের ব্রেইনটা কেটে পানি দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করে দেখতে ইচ্ছে করে আপনাদের ঐ সেলটা আছে কিনা। যদি না থাকে আপনি খুনি, কেবল খুনি, খুনিদের ওটি থাকে না আর ঈশর বিশ্বাসী তো কিছুতেই নন।
উঠলাম। স্কুলে যেতে হবে। প্রফেসর লাঞ্চে নেবে উইদাঊট পে, ফ্রি খাবার কিছুতেই মিস করা ঠিক হবে না।
দুদিন পর পর এক একটা ঘটনা ঘটছে। আমি এসব নিয়ে লিখি না। আমি জানি লিখে কিছু হয় না, হয়ত তাতে নিজের কিছু পরিচিতি বাড়ে। আর তখনই নিজেকে ভারী হিপক্রেট লাগে। তবে আজ নিলয়ের খবরটা পড়ে রাগে গা এত বেশি জ্বলছিল আর কত!!!
আপনারাই হিসেব করুন আর কত!!!
আমি উঠলাম।