(বেকার মানুষদের উদ্দেশ্যে বলছি। নিজে পড়েন এবং অন্যদেরকেও সতর্ক করেন। পড়তে শুরু করার আগে বলি পড়তে একটু কষ্ট হবে, লেখাটা কিছুটা বড়। মূল কথপকথনের প্রায় পুরো অংশটাই এইখানে তুলে ধরা হল)।
আমি রাশেদ বলছি। ভাগ্যবিড়ম্বিত একজন মানুষ। স্থায়ী নিবাস নাটোর। বেশ অনেকদিন হয়ে গেল, লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছি। একটা চাকরির আশায় পড়ে আছি এখানে। এখানে সেখানে অনেক জায়গাতেই চেষ্টা করেছি কিন্তু আমাদের মত খুব সাধারন মানুষদের যা হয়! এক্সট্রা অর্ডিনারি ছিলাম না কোনকালেই আবার আমার জন্যে কেউ বলবে এমন মানুষও আমার নাই।
একজন বেকার মানুষের জন্যে ঢাকা শহর যে কি কঠিন জায়গা সেটা একজন বেকারের থেকে আর কে ভালো জানে।
আমার মতই অসংখ্য বেকার এই শহরে ঘুরাঘুরি করছে। অনেকেই আবার দীর্ঘদিন লজ্জায় বাড়ি ফিরতে পারেনা। প্রত্যেকটা বাবা-মায়ের অনেক বড় স্বপ্ন থাকে তাদের সন্তানদের নিয়ে। তাদের সেই স্বপ্ন আমরা সন্তানরা যখন পুরন করতে পারিনা তাদের সেই কষ্টভরা মুখের দিকে তাকাতেই সাহস হয়না। নিজেদের তখন কুসন্তান ভাবতে শুরু করি আমরা।
এই দেশের যা অবস্থা এখন তাতে বড় বড় সেই স্বপ্নগুলো এখন আর দেখিনা। তারপরেও অভিসপ্ত এই জীবনে আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন কাছের কিছু মানুষের দেয়া একমুঠো আশা। এত বিপদের মধ্যেও সেই আশাটুকুই আমাদেরকে টিকে থাকতে সাহায্যে করে।
০২-০১-২০১৫ রাত্রী আনুমানিক ৮:৩০ মিনিটে আমি মোবাইলের ০১৬২৫ ৪৪৮৩৫২ নম্বর থেকে একটা ফোন কল রিসিভ করি। (নাম্বারটা প্রয়োজনে সেভ করে রাখতে পারেন)।
কলার : হ্যালো রাশেদ সাহেব বলছেন?
আমি : জ্বি বলছি।
কলার : আমি পোল্যান্ড ফ্যাশন থেকে বলছি, আমার নাম আনোয়ার। আতাউর সাহেব আপনার সিভিটা আমার এখানে ফরোয়ার্ড করেছেন। আপনি এখন কোথায় আছেন?
আমি : ঢাকাতেই আছি।
কলার : ঢাকার কোথায় আছেন?
আমি : মিরপুর-১ থাকি।
কলার : আপনি কি এই মূহুর্তে কোথাও জব করছেন?
আমি : এই মূহুর্তে কোথাও করছিনা। ফিজিক্যাল একটা এক্সিডেন্টের কারনে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই আমি। বেশ অনেকদিন হতে যাচ্ছে আমি জবলেস অবস্থায় আছি।
কলার : আচ্ছা, আমাদের খুব জরুরি ভিত্তিতে একজন লোক দরকার এখানে। আপনার যদি আমাদের এখানে কাজের সুযোগ হয় ৩/৪ দিনের মধ্যে জয়েন করতে পারবেন?
আমি : (বিপদগ্রস্ত একজন মানুষ যে শুধু ব্যার্থ হতেই শিখেছে আমার গলাটা উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো)। সাথে সাথে উত্তর দিলাম যেদিন বলবেন সেইদিন থেকেই জয়েন করতে পারবো।
কলার : আমাদের এটা পোল্যান্ডের একটা বাইং হাউজ। এখানে ম্যানেজমেন্ট এ যে তিনজন সিনিয়র আছেন তাদের দুইজন ইন্ডিয়ান একজন বাংলাদেশি। আপনার কনফার্ম হলে আমার এসিসট্যান্ট হিসেবে আপনাকে কাজ করতে হবে। আমি সিনিয়রের সাথে কথা বলে পাঁচ মিনিট পর রিং দিচ্ছি আপনাকে। (পাঁচ মিনিট পর) আপনি আপনার সিভির সফট কপিটা [email protected] এই ঠিকানায় মেইল করে আমাকে একটা এসএমএস দেন।
সিভি পাঠানোর পরে তাকে মোবাইল মেসেজে কনফার্ম করলাম। এর ঠিক ১৫ মিনিট পর সে আমাকে ফোন দিয়ে বলল –
কলার : আপনার সিভিটা মার্চেনডাইজিং হেইড যিনি উনার কাছে ফরওয়ার্ড করা হয়েছে – আপনি আগামীকাল সকাল ৯:১৫ মিনিটে আমাকে রিং দিবেন।
০৩-০২-২০১৫ সকাল ৯:১৬ মিনিটে তার মোবাইলে রিং দিলে বলে, রাশেদ সাহেব একটা মিটিং-এ আছি। ১০ মিনিট পরে রিং দেন।
১০ মিনিট পর আবার রিং দিলে সে বলল, আমার মিটিং এখনও শেষ হয়নি আরও ২০ মিনিট লাগবে। মিটিং শেষে আমি রিং দিচ্ছি আপনাকে।
কলার : (মিনিট ২০ পরে) রাশেদ সাহেব আপনার অরিজিনাল সার্টিফিকেটগুলো কাছে আছে?
আমি : জ্বি না। দেশের বাড়িতে আছে। আমি ফটোকপি দেখাতে পারবো। আর ওগুলো চাইলে দুইদিন সময় দিতে হবে আমাকে।
কলার : ফরেনার মানুষতো ওগুলো ছাড়া সমস্যা করতে পারে। আমি কথা বলে পাঁচ মিনিট পর আপনাকে জানাচ্ছি।
কলার : (পাঁচ মিনিট পর) আমি সার্টিফিকেটের ব্যাপারে বললাম। অবরোধের মধ্যে তো যাওয়া আসাও সমস্যা। তবে আপনাকে এক সময় ওগুলো দেখাতে হবে। আর আপনার ব্যাপারটা অনেকখানি পজিটিভ। আমাদের অফিসে এই পোস্টে এখানে ১৮০০০ টাকা দেয় কিন্তু আপনাকে ১৭০০০ টাকা দেয়া হবে। আর পারমরমেন্স ভালো হলে ৬ মাস পর ২২৫০০ টাকা হবে। এখানে সাপ্তাহিক ছুটি শনিবার, শুক্রবার হাফ অফিস। দুই দিন ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে আর বাকি দিন এইখানে অফিস করবেন। আপনি আমাদের এখানে যখন আসবেন তখন সিভির হার্ডকপি সাথে ৩ কপি পাসপোর্ট, ২ কপি স্ট্যাম্প ছবি, আর ভোটার আইডির ফটোকপি নিয়ে আসবেন। আমাদের স্যালারি ক্যাশে হয়না, ব্যাংকে জমা হবে। আপনি আজকে ১১:০০ টায় আসতে পারবেন?
আমি : আরেকটু সময় পেলে ভালো হত। এই মূহুর্তে সবগুলো পেপার রেডি নাই।
কলার : তাহলে এক কাজ করেন আপনি কালকে সব পেপার নিয়ে লাঞ্চের পর ৩:৩০ মিনিটে আমাদের অফিসে চলে আসেন। এখন থেকে ১/২ ঘন্টার মধ্যেই এইচ আর ডিপার্টমেন্ট থেকে রিং দিবে।
আমি : আপনাদের অফিসটা কোথায়?
কলার : আমাদের অফিস গুলশান-১। আপনাকে মোবাইলে অফিসের ঠিকানাটা ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। আরেকটা কথা। রাহাত সাহেব কে হয় আপনার?
(রাহাত ভাই যার নাম সিভিতে রেফারেন্স হিসেবে ব্যাবহার করেছি তিনি একটা বাইং হাউজে জব করেন)
আমি : আমার কাজিন হয়।
কলার : আমি কিছু কথা বলতে চাচ্ছি আপনাকে। কথাগুলো শুনে খারাপ লাগতে পারে। যদিও একটা রিকোয়েস্টের মাধ্যমে আপনি এখানে আসছেন কিন্তু আপনি আমার এসিসট্যান্ট হিসেবেই কাজ করবেন। তাই এমন কিছু যাতে না হয় যেটাতে বোঝা-পড়ায় আমাদের মধ্যে সমস্যা হয়। আর এমনটা হলে আপনি আমার সাথে কাজ করতে পারবেন না। আর সবকিছু ঠিকমত চললে বছর শেষে আপনার ফাইলটার ব্যাপারেও আমি দেখবো। আরও একটা কথা বলছি আপনাকে সেটা রাহাত সাহেবের সাথে দয়া করে শেয়ার করবে না।
আমি : আপনি নিশ্চিন্তে বলেন আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?
কলার : আমাদের এখানে বাইরের যারা আছেন একজন কাপিল বর্মন, জিতেন্দ্র নাগরাজ ব্রেকফাস্ট করতে হোটেলে যেতে চাচ্ছেন। আমাকে এই খরচটা করতে বলা হচ্ছিল। আমি নাও করতে পারিনি, আপনার পক্ষে কি কিছুটা অনার করা সম্ভব হবে?
এমন প্রস্তাব পাবো এটাতো স্বপ্নেও ভাবিনি। এবং তখনই এই লোকটার ব্যাপারে একটা নেগেটিভ ধারনা তৈরি হয়ে গেল মনের মধ্যে। তবে তখনও কিন্তু ভাবিনি লোকটা ফ্রড হতে পারে, ভেবেছি একটা খারাপ লোকের অধিনে আমি চাকরী করতে যাচ্ছি।
আমি : বললাম, আমার অবস্থাও বিশেষ সুবিধার না। আমি বেশ কয়েকমাস হলো জবলেস অবস্থায় আছি। জবলেস একটা মানুষের ঢাকা শহরে থাকতে কেমন খরচ আপনি খুব ভালোই জানেন। তারপরেও কত দিতে হবে আমাকে?
কলার : আপনি যতটুকু পারেন। বাকিটা আমি দিচ্ছি। ৬০০০ টাকা দিলেই হবে। দেখেন আমি যে এইভাবে বলছি আমারই খুব লজ্জা লাগছে। এটা দয়া করে রাহাত সাহেবকে বলেন না। আমি খুব ছোট হয়ে যাব তাহলে।
আমি : আপনাকে আমি আমার হাতের অবস্থা দেখে পাঁচ মিনিট পর ফোন দিচ্ছি বলেই ফোনটা কেটে দিলাম।
রাহাত ভাইকে সাথে সাথে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আপনি এই নামের কোন লোককে কি সিভি দিয়েছেন? পুরো ঘটনার সংক্ষেপে বর্ননা দিলাম তাকে। তিনি একবাক্যে টাকা দিতে না করে দিলেন। আর বললেন আমি খুঁজে দেখছি এই নামে কারো কাছে সিভি পাঠিয়েছি কিনা।
আমি : পাঁচ মিনিট পর তাকে ফোন দিয়ে বললাম, আনোয়ার সাহেব এটা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। এই কাজটা আমার এথিকসের বাইরে যাচ্ছে। তবে যদি আমার চাকরিটা হয়, পরে মনে হলে আমি ফেব্রুয়ারী মাসের স্যালারি থেকে কিছুটা অনার করতে পারি। কিন্তু এখন আমার পক্ষে সম্ভব না।
কলার : ঠিক আছে রাশেদ সাহেব। আপনি এইচ আর ডিপার্টমেন্ট থেকে রিং দিলে কালকে সাড়ে তিনটার সময় আমাদের অফিসে চলে আসবেন। অফিস এড্রেসটা ম্যাসেজ করে দিচ্ছি আপনাকে।
গল্পটা এখানেই শেষ। এইচ আর থেকে কোন ফোন কল আসেনি। তিনি অফিসের ঠিকানাও আমার কাছে পাঠাননি। পরবর্তিতে তিনি আমার ফোনও রিসিভ করেননি এবং সেই নামে কারো কাছে সিভিও পাঠানো হয়নি।
তবে ঠিকভাবে নিশ্চিত না হয়ে তার দেয়া কোন ঠিকানায় যদি আমি যেতাম সেটা খুব বিপদজনকও হতে পারতো। মানুষ ঠাকানোর একেবারেই নতুন একটা কৌশল বের হয়েছে। এটা থেকে নিজে সাবধান হোন এবং অন্যকেও সাবধান করুন।