এই শিশুর নাম রাইসুল, সে মায়ের জন্য পানি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এই পানি নিয়ে তাকে প্রায় ২ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। নিশ্চয়ই তার মায়ের কাছে সে সোনার টুকরা হিরো একটা ছেলে..!
.
রাইসুল বলে,-‘আমার মা অসুস্থ। ওই পাহাড়ের উপরে থাকে। ঘর থেকে বের হতে পারে না ‘ রাইসুলের পাশে থাকা আরেকজন বয়স্ক মহিলা বললেন,
-‘ওর মা গর্ভবতী। ঝুপড়ি ঘরে খোলা আকাশের নিচে থাকে। একটু বৃষ্টি হলে পানি জমে যায়। এখন মায়ের সব কাজটি এই শিশু করে।’
.
শনিবার উখিয়ার বালুখালি ক্যাম্পে সাড়ে চার বছরের শিশু রাইসুল হককে দেখা গেলো ভিন্ন দৃশ্যে। কাঁধে দু’লিটার করে পানির বোতল, গায়ে নীল গেঞ্জি, পরনে কিছু নেই! তাকে মায়ের জন্য পানি নিয়ে আধা কিলোমিটার হেটে উপরে উঠতে হবে। ভাসমান একই ক্যাম্পে থাকা আয়েশা খাতুন বলেন, ‘মিয়ানমারের বুচিডং এলাকায় ছিল ওদের বাড়ি।’
বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা ওর বাবা ও বড় ভাইকে মেরে ফেলেছে। ওর মা আমাদের সাথে রাইসুল ও তার আরেক ভাই জামানকে নিয়ে ৫ দিনে দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এখন এই ক্যাম্পে উঠেছে।
ওই নারী আরো বলেন, গত তিন দিন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য খাবার সংগ্রহ, নিচে এসে পানি নিয়ে যাওয়া সবই শিশু রাইসুল করছে!
.
ওখানে কী বাচ্চা প্রসবের পরিবেশ আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
-‘খোলা আকাশের নিচে প্রতিদিনই এমন বহু মা সন্তান জন্ম দিচ্ছে। ওর মায়েরও তেমন হবে।’
.
রাইসুলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম,-‘তুমি কি তোমার আব্বুকে মেরে ফেলতে দেখেছো? ’ রাইসুল তখন বললো,-‘না! আম্মু বলেছে কে নাকি আব্বু ও ভাইকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে।’
[ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাহী রাজিউন]
**************************************************************************************************
**************************************************************************************************
দুই কিশোরীর সঙ্গে কথা হয় গতকাল টেকনাফের কাছের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। তারা বলছিল, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর প্রাণ মংডুর কাউয়ার বিলে সেনাবাহিনী হামলা চালালে দুই বোন নানাবাড়ি রাইম্যার বিলে চলে যায়। সেখান থেকে ১৩ থেকে ২০ বছরের ১৭টি মেয়েকে সেনাসদস্যরা তুলে নিয়ে যান। ওই দুই বোন পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবারও ওরা ফিরে যায় মিয়ানমারে। এবার আর রক্ষা পায়নি। মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা ওই দুই বোনসহ পাঁচজনকে তুলে নিয়ে যান। সেখানে গণধর্ষণের শিকার হয় তারা। বড় বোনটি ঘটনার পরপরই আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ছোট বোনের কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
টেকনাফের উন ছি প্রাং, বালুখালী অস্থায়ী ক্যাম্প, থাইংখালী ও লেদার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই বললেন, এই দফায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেসব নারীকে ক্যাম্পে নিয়ে গেছেন তাঁদের আর ছাড়েননি। অক্টোবর ২০১৬ তে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ধর্ষণের শিকার সেসব নারী বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠেছেন। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে তাঁরা নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এবার ধর্ষণের শিকার বহু নারীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সীমান্ত পার হতে দেয়নি।
উন ছি প্রাং আশ্রয়কেন্দ্রে কথা হচ্ছিল মো. সুলতানের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি বুচিডংয়ের সাহাব বাজারে। পেশায় কৃষক। সপ্তাহখানেক আগে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। তিনি বলছিলেন, সেনাসদস্যরা প্রথমে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে দা, বঁটি, ছুরি এসব নিয়ে যান। যারা বিত্তবান তাদের টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি, চাল লুটের পর নারীদের তুলে নিয়ে গেছেন। গ্রামের হুক্কাটার (চেয়ারম্যান) মেয়েকেও ছাড়েনি। পুরুষদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে নারীদের ওপর জুলুম করেছে। তারপর সবার চোখের ওপর দিয়ে নারীদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেছে। কোথায়, কীভাবে আছে কেউ জানে না।
টেকনাফের একটি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া অলি আহাদ ওরফে কালা বদা দুই ছেলে চার মেয়ের জনক। মংডুর গজরবিল থেকে এসেছেন। বলছিলেন, অবিবাহিত দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ি ছেড়েছিলেন ‘মেলেটারি’ আসছে সে খবর পেয়েই। তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, সেনাসদস্যরা কীভাবে পরিবারের অন্য সদস্যদের সামনে নারীদের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম মানুষের মুখে তিনি একই গল্প শুনেছেন। তিনিও পাগলের মতো মেয়েদের হাত ধরে পার হয়েছেন একটির পর একটি গ্রাম। শেষ পর্যন্ত মেয়েদের রক্ষা করতে পেরে পানের বরজ, ২০ হাঁড়ি ধান, পাঁচ কামরার বাড়ি আর গরু-ছাগলের শোক ভুলেছেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্মার মেলিটারি এত হরাপ (খারাপ) যে উগ্গা ফুয়া তার মা’র হতা, বাইয়ে বইনের হতা, বাপে মেলাফোয়ার কথা, জামাই-বউর হতা ক্যাঙ্গরি খইত?’ (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এত খারাপ যে তারা বাবার সামনে মেয়েকে, ছেলের সামনে মাকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে নির্যাতন করেছে। নির্যাতিতরা সে কথা কীভাবে বলবে?
এই পোস্ট লেখার উদ্দেশ্য আপনার সাহায্য পাওয়া, যত সামান্যই পারেন, আপনার দেয়া সামান্য ৫০-১০০ টাকাও তাদের জীবন বাচাবে। ক্লিক করুন এখানে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৩৯