কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে হাতের বাঁ পাশে উখিয়ার থাইংখালীতে পাহাড় কেটে ঘর তুলেছে শরণার্থীরা। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে স্রোতের মতো এসেছে রোহিঙ্গারা। এই শিবিরে কত নারী নির্যাতনের শিকার, এমন প্রশ্নে মুখ লুকাল অনেকে। শুধু শাফিউর রামান নামে এক ব্যক্তি তাঁকে অনুসরণের ইঙ্গিত দিলেন। বসিয়ে দিলেন তাঁর মা সোলেমা খাতুনের কাছে। মায়ের চোখের দৃষ্টি এখনো স্থির নয়। সারাক্ষণ দুলছেন আর মুখ থেকে অদ্ভুত শব্দ করছেন। বললেন, ‘ইউসুফ আলীর ফুতের বউ, শের মোহাম্মদের ম্যালা ফুয়াইন তুলি লইগিয়ই মেলেটারিয়ে। ইতারার খবর নাই।’
সোলেমা খাতুন তাঁর পাঁচ ছেলে আর ছেলের বউদের নিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিডংয়ের পন্ডেপ্রাংয়ে থাকতেন। থাইংখালীর হাকিমপুর শরণার্থী শিবিরে গাদাগাদি করে গড়ে ওঠা ত্রিপল ঢাকা ছাপরাগুলোর মধ্যে তাঁদের ছাপরাটিই বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সোলেমা খাতুনের মাথায় ধবধবে সাদা কাপড়ের ওড়না। নাকে সোনার নাকফুল।
গতকাল বৃহস্পতিবার সোলেমা বলছিলেন, ঈদের চার দিন আগে হঠাৎ তাঁদের গ্রামে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঢুকে পড়েন। প্রথমেই ঘর থেকে হিড় হিড় করে টেনে এনে পুরুষদের বাইরে এক জায়গায় এনে জড়ো করা হয়। তারপর বাড়ির নারী সদস্যদের বিবস্ত্র করে সেনাসদস্যরা যাচ্ছেতাই করেন। নারীদের ওড়না, থামি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা হয় তাঁদের ভাই, স্বামী ও বাবাদের। তারপর চালানো হয় গুলি। কাউকে কাউকে জবাইও করা হয়। বিবস্ত্র নারীদের নানাভাবে হেনস্তা করে তাঁদের কাছ থেকে সেনাসদস্যরা সোনার গয়না আর দামি জিনিসপত্র কেড়ে নেন। যাকে খুশি তাকেই ক্যাম্পেও তুলে নিয়ে যান তাঁরা। সোলেমা খাতুনের প্রতিবেশী দুই নারীকে সেনাসদস্যরা কী করেছেন, কোথায় রেখেছেন তাঁরা জানেন না। ওই পরিবারগুলো সেনাসদস্যদের মুক্তিপণ দিয়ে মেয়েদের ছাড়িয়ে আনতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি বলে জানান সোলেমা।
সোলেমা এই হামলায় তাঁর তিন ছেলে ও স্বামীকে হারিয়েছেন। ছেলের বউদের রক্ষা করতে নাতিদের শান্ত রাখতে তাঁকে বেগ পেতে হয়। এক নাতি পানির পিপাসায় কাতর হয়ে পড়লে তিনি মুখে তুলে দেন তরকারির এক চামচ ঝোল। শেষ পর্যন্ত পুত্রবধূদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন কি না, সে প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি সোলেমা।
গত ২৫ আগস্টের ঘটনার পর সেনাসদস্যরা বাংলাদেশ লাগোয়া রাথেডং, বুচিডং ও মংডুতে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছেন। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছেন। নারী নির্যাতন করেছেন। পুরো গ্রামের মানুষ একযোগে ঘরবাড়ি ছেড়েছে। নির্যাতনের শিকার নারীরা প্রতিবেশীদের কাছে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না। কেউ কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। এমন দুই কিশোরীর সঙ্গে কথা হয় গতকাল টেকনাফের কাছের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। তারা বলছিল, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবরের পর প্রাণ মংডুর কাউয়ার বিলে সেনাবাহিনী হামলা চালালে দুই বোন নানাবাড়ি রাইম্যার বিলে চলে যায়। সেখান থেকে ১৩ থেকে ২০ বছরের ১৭টি মেয়েকে সেনাসদস্যরা তুলে নিয়ে যান। ওই দুই বোন পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। পরিস্থিতি শান্ত হলে আবারও ওরা ফিরে যায় মিয়ানমারে। এবার আর রক্ষা পায়নি। মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা ওই দুই বোনসহ পাঁচজনকে তুলে নিয়ে যান। সেখানে গণধর্ষণের শিকার হয় তারা। বড় বোনটি ঘটনার পরপরই আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ছোট বোনের কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
টেকনাফের উন ছি প্রাং, বালুখালী অস্থায়ী ক্যাম্প, থাইংখালী ও লেদার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া অনেকেই বললেন, এই দফায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা যেসব নারীকে ক্যাম্পে নিয়ে গেছেন তাঁদের আর ছাড়েননি। অক্টোবর ২০১৬ তে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিপুলসংখ্যক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ধর্ষণের শিকার সেসব নারী বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে এসে উঠেছেন। দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে তাঁরা নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এবার ধর্ষণের শিকার বহু নারীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সীমান্ত পার হতে দেয়নি।
উন ছি প্রাং আশ্রয়কেন্দ্রে কথা হচ্ছিল মো. সুলতানের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি বুচিডংয়ের সাহাব বাজারে। পেশায় কৃষক। সপ্তাহখানেক আগে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। তিনি বলছিলেন, সেনাসদস্যরা প্রথমে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে দা, বঁটি, ছুরি এসব নিয়ে যান। যারা বিত্তবান তাদের টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি, চাল লুটের পর নারীদের তুলে নিয়ে গেছেন। গ্রামের হুক্কাটার (চেয়ারম্যান) মেয়েকেও ছাড়েনি। পুরুষদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে নারীদের ওপর জুলুম করেছে। তারপর সবার চোখের ওপর দিয়ে নারীদের ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেছে। কোথায়, কীভাবে আছে কেউ জানে না।
টেকনাফের একটি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া অলি আহাদ ওরফে কালা বদা দুই ছেলে চার মেয়ের জনক। মংডুর গজরবিল থেকে এসেছেন। বলছিলেন, অবিবাহিত দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ি ছেড়েছিলেন ‘মেলেটারি’ আসছে সে খবর পেয়েই। তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, সেনাসদস্যরা কীভাবে পরিবারের অন্য সদস্যদের সামনে নারীদের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম মানুষের মুখে তিনি একই গল্প শুনেছেন। তিনিও পাগলের মতো মেয়েদের হাত ধরে পার হয়েছেন একটির পর একটি গ্রাম। শেষ পর্যন্ত মেয়েদের রক্ষা করতে পেরে পানের বরজ, ২০ হাঁড়ি ধান, পাঁচ কামরার বাড়ি আর গরু-ছাগলের শোক ভুলেছেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্মার মেলিটারি এত হরাপ (খারাপ) যে উগ্গা ফুয়া তার মা’র হতা, বাইয়ে বইনের হতা, বাপে মেলাফোয়ার কথা, জামাই-বউর হতা ক্যাঙ্গরি খইত?’ (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এত খারাপ যে তারা বাবার সামনে মেয়েকে, ছেলের সামনে মাকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে নির্যাতন করেছে। নির্যাতিতরা সে কথা কীভাবে বলবে?)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৩১