মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রাষ্ট্রীয় খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার হয়ে প্রায় সোয়া চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরু হওয়ার পর পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা থাকা, খাওয়া, পোশাক, অপুষ্টিসহ অসংখ্য সমস্যার মধ্যে করছে মানবেতর জীবনযাপন।
তাদেরই একজন ৬০ বছর বয়সী নাসিমা খাতুন। তিনি কয়েক সপ্তাহ আগে কক্সবাজারে নতুন করে তৈরি করা একটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি দুর্বিষহ শরণার্থী জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন আলজাজিরার প্রতিবেদককে।
‘আমি নাসিমা খাতুন। বয়স ৬০ বছর। সহিংসতার আগে আমাদের একটি নির্বিঘ্ন জীবন ছিল। আমার স্বামী একজন জেলে। আমাদের তিন মেয়ে। রোহিঙ্গা হিসেবে আমরা ভালোই ছিলাম।
যদিও সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঝেমধ্যে আমাদের হুমকি-ধমকি দিত। তবে খাওয়া-পরা বা আশ্রয় নিয়ে আমাদের কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি।
যেদিন সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে আমাদের গ্রামে এলোপাতাড়ি গুলি করা শুরু করল, তখন আমরা দৌড়ে দিগ্বিদিক পালাতে থাকলাম। আমি দৌড়ে জঙ্গলে গিয়ে লুকালাম। তখন একজন বলল, আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তখন আমি খুব ভয় পেলাম এবং আমার খুব অসহায় লাগছিল।
নাসিমা বলেন, সেনাবাহিনী তখন সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আমি আর আমার স্বামীর লাশটা আনতে যেতে পারলাম না। শেষবারের মতো তার লাশটাও দেখতে পারলাম না। তাকে রেখেই আমি বাংলাদেশের দিকে পা বাড়াই। মেয়েদের নিয়ে আমি প্রতিবেশীদের সঙ্গে গ্রাম ছাড়ি।
সঙ্গে কিছু নিতেও পারলাম না। যে কারণে পথে পানি আর সামান্য যা পাওয়া গেছে, তাই খেয়েছি। একদিন একটা পরিত্যক্ত দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমাদের প্রচণ্ড ক্ষুধা। ক্ষুধার জ্বালায় আমরা সেই দোকান লুট করি। সেখানে কিছু খাবার আমরা পাই।
সত্যিকার অর্থে যাত্রাপথের ১০ দিনের মধ্যে সেদিনই শুধু কিছু খাবার খেতে পেরেছিলাম। যাত্রাপথে আমি শুধু অনবরত কেঁদেছি। আমার কাছে কোনো পয়সা ছিল না। প্রতিবেশীরাই পথে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, তারা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে নদী পার হওয়ার জন্য টাকাও দিয়েছে।
মিয়ানমার ছেড়ে আসা আমার জন্য খুবই যন্ত্রণার। সেখানে আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি, আমার বাড়িঘর-জমি সবকিছু হারিয়েছি।
আমরা এখানে থাকার মতো একটি অস্থায়ী ঘর পেয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের খাদ্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু আমার তো উপার্জন করার মতো সুযোগ নেই, এখানে আমাদের জন্য কোনো কাজ নেই।
আমাদের যদি অর্থই না থাকে, তাহলে আমাদের সামনে কেমন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? সবাই হয়তো মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে। কিন্তু আমি ভাবতে পারছি না যে এটা কখনও সম্ভব হবে কিনা।
সেখানে কখনোই নিরাপদে থাকা যাবে না। যদি আমরা মিয়ানমারে ফিরেও যাই, তাহলে আবারও আমাদের নির্যাতিত হতে হবে বা মরতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্ব আমাদের এ দুরবস্থা দেখছে। বিশ্ববাসীর কাছে আমার অনুরোধ, আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন। তারা আমাদের দুঃখের, মৃত্যুর গল্প শুনছে, কিন্তু একই অবস্থা তাদের হলে তারা কী করতেন!’
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৯