এটা বোঝা যাচ্ছে যে, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর এবং মহাজোট সরকারের তিন বছরের মধ্যে বর্তমানে বিএনপি তথা চার দলীয় জোট রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়েছে, তাদের প্রতি জনসমর্থন বাড়ছে। সরকারের অপশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ বিএনপির কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। ক্ষমতার পালাবদলও চাইছেন অনেকে। আসলে আমাদের যেহেতু বিএনপি আর আওয়ামীলীগ ছাড়া কোন বিকল্প নাই, সেহেতু এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী? অনেকে আশা করছেন, বিএনপি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাক। অনেকে চাইছেন, বিএনপি জামাতকে ত্যাগ করে এককভাবে আন্দোলন করুক। জনগণ এককভাবে বিএনপিকেই ক্ষমতায় আনবে বলে তারা বিশ্বাসও করেন। এমতাবস্থায় খালেদা জিয়ার জামাত নেতাদের মুক্তি দাবী করাটা অনেককে হতাশ করেছে। প্রশ্ন হল, বিএনপি কি ভুল করছে? বিএনপির সামনে সম্ভাব্য সবচেয়ে ভাল বিকল্প কী? এ বিষয়ে নানাজনের নানা মতামত রয়েছে। আমি আমার মতামত সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
আমার মতে, আওয়ামীলীগের কূট কৌশল এবং অপরাজনীতির কারণেই বিএনপির পক্ষে এই মুহুর্তে জামাতকে ছাড়া সম্ভব না। জামাতের পক্ষেও বিএনপিকে ছাড়া সম্ভব না। আমি জামাতের এক নেতার কাছে শুনেছি যে, সেফ হোমে জিজ্ঞাসাবাদের নামে জামাত নেতাদেরকে একটা ইস্যুতেই প্রতিনিয়ত রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। তাহলো, বিএনপির সাথে রাজনৈতিক জোট না করা। বিএনপি জামাতকে সাথে না রাখলে প্রকারান্তরে আওয়ামীলীগের এজেন্ডাই বাস্তবায়িত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে জামাত নেতাদেরকে নাকি বলা হচ্ছে, জামাত বিএনপিকে ছেড়ে বেড়িয়ে আসলে কেউ একজন আন্তর্জাতিক মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালের বৈধতা নিয়ে আদালতে রিট করবে। আর সঙ্গে সঙ্গে সামসুদ্দিন আর মানিকের বেঞ্চের মত কোন বেঞ্চ ট্রাইবুনালকে অবৈধ ঘোষণা করবে। আর গণতান্ত্রিক সরকার আদালতের রায় বাস্তবায়ন করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে জামাত নেতাদেরকে ছেড়ে দেবে আর ট্রাইবুনাল ভেঙ্গে দেবে। আওয়ামীলীগ তখন স্বভাবসুলভভাবে বলবে, আওয়ামীলীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চায় কিন্তু আদালতের রায়ের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না; সরকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। তবে এটা করলেও জামাত রক্ষা পাবে না। কারণ, জামাতের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো তুলে নেওয়া হবে না; যেমন তুলে নেওয়া হয়নি এরশাদের মামলাগুলো। এরশাদের মত জামাতকেও গৃহপালিত, কোণঠাসা করে রাখা হবে মামলার ভয় দেখিয়ে। জাতীয় পার্টি এবং জামাত যদি আওয়ামীলীগের সাথে নির্বাচনে যায়, সেক্ষেত্রে বিএনপি একা আন্দোলন করে বা নির্বাচন বর্জন করে কতটুকু সুবিধা করতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এ রকম সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে বিএনপি এবং জামাতের পক্ষে পরস্পরের সাথে থাকার চেয়ে ভাল কোন বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। অনেকে বিশ্বাসগত বা কৌশলগত কারণে জামাতের নামই শুনতে পারেন না। কিন্তু জামাত কোন নিষিদ্ধ দল নয় এবং যারা জামাতের রাজনীতির সাথে জড়িত তাড়াও এদেশেরই নাগরিক। সুতরাং জামাত মানেই খারাপ এই শ্লোগান দেশের জনগণের বড় একটা অংশ বিশ্বাস করেন না। এক সময় আওয়ামীলীগও জামাতের সাথে মিলে এক মঞ্চে আন্দোলন করেছে সে কথাটাও জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে।
খালেদা জিয়া যে প্রেক্ষাপটে জামাত নেতাদের মুক্তি চেয়েছেন তাহলো প্রথমত, তিনি গঠিত ট্রাইবুনালকে অবিশ্বাস করেছেন; দ্বিতীয়ত, তিনি ট্রাইবুনালের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, এটি আওয়ামী ট্রাইবুনাল এবং এর উদ্দেশ্য হলো বিরোধীদলকে দমন এবং নিশ্চিহ্ন করা। খালেদা জিয়ার এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে জামাত নেতাদের মুক্তি চাওয়াকে কতটা খারাপ বলা যাবে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ জামাত বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি না করলেই তারা মাফ পেয়ে যাবে, সরকারের এ রকম মনোভাবকে মানবতা বিরোধী অপরাধের চেয়ও খারাপ মনে করি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক তা আমরা সবাই চাই। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে প্রহসন এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা কোনমতেই সমর্থন করি না। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি বিশেষভাবে সমাজের শিক্ষিত এবং সুশীল সমাজের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সাধারণ জনগণের কাছে ইস্যুটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমাকে বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যারা অভিযুক্ত তাদেরকে কেন যুদ্ধের পরপরই বিচার করা হল না? তাদের বিচার এখনও চাই তবে মনে করি, যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে যেন নতুন কোন জটিলতা না তৈরি হয়। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত অনেকের সন্তান, আত্নীয়-স্বজন দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। অনেকে তাদের সাথে আত্নীয়তা করেছেন। অর্থাৎ তারা সমাজের মূল ধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এত বছর পর এ রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের বিচার করা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটু হলেও দ্বিধার জায়গা তৈরি হয়েছে। আবার যুদ্ধাপরাধীরা ভোট পেয়ে সাংসদও হয়েছিলেন, এটাওতো সত্যি। তার মানে পুরো ব্যাপারটি যতটা সহজ মনে করা হয়, ব্যাপারটা মোটেই অতো সহজ নয়।
আমি মনে করি, আমাদের তরুণদের একটি বড় অংশ প্রগতিশীল এবং তারা কোন গৎবাঁধা বিশ্বাসের চোরাবালিতে আটকে থাকতে চায় না। তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার যেমন চায়, তেমনি চায় কারোও প্রতি যেন কোন অবিচার না করা হয়। তারা সব দলের, সব মতের সহাবস্থান চায়। দেশের উন্নয়নে সামনের দিকে তাকাতে চায়। জনগণকে বিভক্ত করার পরিবর্তে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে চায়। ধীরে ধীরে হলেও এ রকম আধুনিক মতাবলম্বীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য হল, কোন রাজনৈতিক দলই তরুণ সমাজের এই মতামতকে ধারণ করে তাদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে এগিয়ে আসছে না।
সরকারের কিছু কর্মকান্ড অনেককে আতঙ্কগ্রস্থ করেছে এমন কী চরম আওয়ামী ভক্তরাও হতাশা এবং দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেছে। তাহলো, সরকারের স্বৈরাচারী এবং চরম অসহিষ্ণু মনোভাব। সংবিধান সংশোধনে জনমতের চরম উপেক্ষা, একতরফাভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা, ভারতের সাথে চুক্তিতে অস্বচ্ছতা এবং জালিয়াতি, শেয়ারবাজার কারসাজি, জনগণের সাথে মিথ্যা বলা, সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে দেশের জনগণ বর্তমানে একটি ভয়ানক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এমতাবস্থায় বিরোধী দল নিজেদের এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্ক প্রকাশ করেছে।
এ রকম একটা জটিল সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে বিএনপির বর্তমান অবস্থান ঠিক না ভুল তা জানার জন্য আরোও অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।