আমাকে নিয়ে ট্যাক্সি এসে থামল এক উঁচু দালানের সামনে। ‘আপনি, প্লিজ, মিটারটা বন্ধ করবেন না! আমি এক মিনিটের জন্য এই অফিসে যাব আর আসব। তারপর আমাকে আরেক জায়গায় যেতে হবে।’
ট্যাক্সিচালক কপাল কোঁচকাল। স্পষ্টতই অসন্তুষ্ট সে।
‘নাকি ভাড়াটা দিয়ে যাবেন?’ সে প্রস্তাব দিল।
‘আরে না, আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে তো,’ বললাম আমি, ‘নাকি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না? ভাবছেন, আমি পালিয়ে যাব?’
‘আমি কিছুই ভাবছি না,’ ট্যাক্সিচালক বলল, ‘যাত্রী তো নানান কিসিমের হয়, কেউ পালিয়ে যায়, কেউ যায় না...’
‘ওহ্, তার মানে আপনি ভাবছেন, আমি পালিয়ে যেতে পারি, তাই তো? ঠিক আছে, আমানত হিসেবে আমি আমার হ্যাটটা রেখে যাচ্ছি।’
‘আরে ধুর!’ আহত বোধ করল ট্যাক্সিচালক, ‘আপনার হ্যাট নিয়ে আমি কী করব? আমি আপনাকে বিশ্বাস করি... আপনি বরং আপনার ব্রিফকেসটা রেখে আপনার কাজে যান।’
‘ওহ্, এই ব্যাপার!’ আমার রাগ ধরে গেল, ‘ঠিক আছে, ব্রিফকেসটা রাখছি বটে, তবে আপনার গাড়ির নম্বরটাও লিখে নিচ্ছি।’
‘আশ্চর্য! আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না?’ কপাল কুঁচকে বলল ট্যাক্সিচালক, ‘ভাবছেন, আমি চলে যাব?’
‘আমি কিছুই ভাবছি না,’ আমি বললাম, ‘ট্যাক্সিচালক তো নানান কিসিমের হয়, কেউ হ্যাট পরতে পছন্দ করে, কেউ পছন্দ করে ব্রিফকেস...’
‘ওহ্, এই ব্যাপার!’ বলল ট্যাক্সিচালক, ‘ঠিক আছে, লিখে নিন গাড়ির নম্বর: এমটি ৪০-২০। তবে তার আগে আপনার ব্রিফকেসের ভেতরে কী আছে, দেখান।’
‘কেন?’
‘যাতে পরে কোনো অভিযোগ না থাকে।’
‘এই দেখুন,’ ক্ষুব্ধস্বরে বললাম আমি, ‘কিছু কাগজপত্র, কয়েকটা বই আর ইলেকট্রিক শেভিং রেজর।’
‘রেজরটা কাজ করে, নাকি নষ্ট?’
‘নষ্ট হবে কেন? শুধু এখন কাজ করছে না।’
‘এখন মানে? চেক করে দেখার কোনো খায়েস আমার নেই।’
‘বলা তো যায় না,’ বিদ্রূপের হাসি হেসে বললাম, ‘আপনি এখন আনশেভ্ড। মুখ ফোলাফোলা, চোখ বর্ণহীন, বাঁ গালে আঁচিল...’
‘চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে নিচ্ছেন?’ কর্কশভাবে বলল ট্যাক্সিচালক, ‘দেখুন, দেখুন। আপনাকে চিনতে আমার ভুল হবে না। আলুর মতো নাক, চোখ গোলাকার, কান দুটো দুই ধরনের...’
‘শুরু যখন হলোই,’ আমার রাগ উঠল চরমে, ‘তখন চলুন, সবকিছু অফিশিয়াল করে ফেলি। এই নিন আমার ডকুমেন্টগুলো: পাসপোর্ট, পাস, বিয়ের সার্টিফিকেট। নিন! এবং নিশ্চিত হোন, একজন সৎ মানুষের সঙ্গে আপনার ডিলিং হচ্ছে। এখন আপনার ডকুমেন্টগুলো দিন।’
‘এই নিন,’ বলল সে, ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স, ট্রেড ইউনিয়নের আইডি কার্ড...’
‘জন্মস্থানের সার্টিফিকেট নিশ্চয়ই নেই?’ বললাম আমি।
‘না,’ সে বলল, ‘তবে প্রয়োজন হলে আমাকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে না। প্রয়োজনে অবশ্য আপনার নাগালও পাওয়া যাবে।’
আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম রাগী চোখে।
‘শুনুন,’ একসময় আমি বললাম, ‘আপনার লজ্জা করছে না?’
‘আর আপনার?’
‘আমার লজ্জা হচ্ছে আমাদের দুজনের জন্য।’ আমি জানালাম।
‘আমারও,’ চোখ নামিয়ে বলল সে, ‘আপনার ডকুমেন্টগুলো নিয়ে যান।’
‘আপনিও নিন আপনারগুলো...’
‘ব্রিফকেসটাও নিয়ে যান...’
‘ধন্যবাদ,’ বললাম আমি, ‘আপনার গাড়ির নম্বরটাও ভুলে যাব।’
‘ঠিক।’ বলল সে।
আমরা পিঠ চাপড়ে দিলাম পরস্পরের।
‘কীভাবে যে আপনার সম্পর্কে খারাপ ধারণা করেছিলাম!’ বিস্ময় প্রকাশ করলাম আমি, ‘সুদর্শন চেহারা আপনার, ধূসর চোখ, গালে তিল।’
‘আপনার চেহারাও তো চমৎকার,’ বলল সে, ‘বড় বড় চোখ, পরিষ্কার কান...’
‘আমি যাব আর আসব।’ বললাম তাকে।
‘অবশ্যই,’ বলল সে, ‘আমি আপনাকে মিস করব...’
আমরা কোমল হাসি উপহার দিলাম পরস্পরকে। আমি ট্যাক্সি থেকে বের হলাম।
অফিসে ঢোকার মুখে আবিষ্কার করলাম, পাসটা নেই আমার সঙ্গে!
‘শালা!’ ভাবলাম আমি, ‘আমাকে বিশ্বাস করেনি বলেই পাসটা রেখে দিয়েছে নিজের কাছে। ব্যাপার না! যাবে কোথায় সে! সাবধানতার খাতিরে তার গাড়ির পেছনের চাকা ফুটো করে দিয়েছি না!’
রস+আলো সৌজন্যে
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:১৫