গণজাগরন মঞ্চের যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেশে নতুন করে দুটি জিনিস দৃশ্যমান হয়।
প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খায় তরুন সমাজ জাগ্রত হয় নতুন করে। দ্বিতীয়ত , প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ৭১ এর পর সবচাইতে নগ্নভাবে সামনে চলে আসে। গনজাগরন মঞ্চের আন্দোলনের সময়েই সরকারের প্রশ্রয়ে শক্তি প্রদর্শন করে হেফাজতে ইসলাম।এমনকি সমাজ , সভ্যতা, প্রগতির বুকের উপর দাঁড়িয়ে দম্ভ নিয়ে ১৩ দফা ঘোষনা করে তারা । গণজাগরন মঞ্চই চ্যালেঞ্জ জানায় জামাতের সাথে সকল রাজনৈতিক আঁতাতকে যার ফলশ্রুতিতে জামাত শিবিরের মতো আদিপতিত শক্তি এদেশের মাটিতে জায়গা হারায় নিশ্চিতভাবেই এবং তাদের প্রতিহত করতে এক্ষেত্রে সরকারের প্রথমদিককার ভূমিকা সাধুবাদ পাবার যোগ্য। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যায় অন্য জায়গায়- গনজাগরন মঞ্চ যখন তাঁর যুদ্ধাপরাধের বিচারের দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি নিয়ে অগ্রগামি ঠিক তাঁর পর পরই অব্যহতভাবে মঞ্চ সংশ্লিষ্ট অ্যান্টি রিলিজিয়াস কিছু ব্যাক্তিকে টার্গেট করে কিলিং শুরু হয়ে গেলো।
হেফাজত ইসলাম মাঠে নেমে এই ব্যাক্তিদের ব্লগার পরিচয়কে যেন যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে প্রতিহত করার ঘোষনা দিলো এবং এরপরই একে একে অভিজিৎ, নিলয়, ওয়াশিকুর, দীপন কে নির্মম ভাবে কুপিয়ে মারা হলো। নাজিমুদ্দিন সামাদ, রেজাউল করিম সিদ্দিকি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ মেরে এ মৃত্যুর মিছিল এখনো থামে নি। এই মানুষগুলোকে মারার পর কিছু প্রতিবাদ হয়েছিলো কিন্তু জনগণের অংশগ্রহণে যে প্রতিবাদ হয় সেরকম কিছু হয় নি । এর কারনটাও খুব পরিষ্কার ,জুনগনের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ব্লগার মানেই ইসলাম ধর্মবিরোধী, ব্লগার মানেই অযৌক্তিক গালাগালি। এর মাধ্যমে অভিজিৎ রায়ের মতো বিজ্ঞান লেখককেও ইসলাম ধর্মবিদ্বেষী বানানো হয়েছে। দীপন, টুটুলকেও আক্রমন করা হয়েছে কারন তারা অভিজিতের বই প্রকাশ করেছিলো।
এসকল অপরাধের বিচার, তদন্ত কি হয়েছে সেটা নতুন করে বলার অবকাশ নেই কিন্তু এসকল প্লানড কিলিং এ কারা জড়িত টা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জামাত আর হেফাজত নামের দুটি শক্তিকে আলাদা করে বিচার করি। অনেকে ভাবতে পছন্দ করেন যে এসব অপরাধে জামাত জড়িত , হেফাজত ইসলাম এসব অপরাধে জড়িত নয়। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে কেন্দ্র করেও জামাত বিএনপি সম্মিলিত শক্তি যেভাবে দাড়িয়েছে ঐ একই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলাম কি ভিন্ন কিছু করেছিলো ? মোটেই না, বরং শাপলা চত্ত্বরে বিএনপি , জামাত , জাতীয় পার্টি , চরমোনাই মিলে এদশের প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে দম্ভোক্তি করেছে সেইসাথে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের হুঙ্কার দিয়েছে। অথচ , আমাদের মধ্যে একটি শ্রেণি জামাতকে ঠেলে দিয়ে হেফাজতকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করি। কেন এই ফ্যানাটিজম ? হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে হেফাজত তাঁর আসল কাজটি সমাধা করেছে এবং করছে।
সাম্প্রতিক এসব হত্যাকাণ্ডে একটি কথা বলতে শোনা যায় উগ্র ধর্মবিরোধী লেখার কারনেই এই কিলিং গুলো হচ্ছে। কিন্তু আমার খুব সাদামাটা প্রশ্ন গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের আগে কি এই উগ্র লেখা গুলো ব্লগ, ইন্টারনেট এ ছিলো না? শাহবাগ আন্দোলনের আগে কেউ এদেশে নাস্তিক ছিলো না? নিশ্চয়ই ছিলো, অভিজিৎ রায় তো অনেক দিন ধরেই লিখছিলেন মুক্তমনায়।অন্যরাও তো অনেক আগে থেকেই লেখালেখি করছিলেন তাহলে কেন আগে তারা হুমিকি , হত্যার শিকার হলেন না?
এই গনজাগনের উত্থান এবং ব্লগার , লেখক, প্রকাশক, সংখ্যালঘু হত্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সময় এই দুটি দিককে বিশ্লেষণ করলে সহজেই বুঝা যায় যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং এ ইস্যুর আন্দোলন হলো হত্যাকারীদের মূল মাথা ব্যাথা। এই বিচার বন্ধ করে দেয়া হোক এসব নাস্তিক অপবাদ দিয়ে মেরে ফেলা, সংখ্যালঘু আক্রমন কিছুই থাকবে না।
হেফাজত ইসলাম যখন মাঠে নামে তখন হেফাজত বলতো ,” আমরাও যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই”।
এটি ছিল সবচাইতে বড় প্রতারনা তাদের। বিচার চেয়ে আবার তারাই জামাত, বিএনপি নেতাদের নিয়ে ১৩ দফা দিয়েছে । যুদ্ধাপরাধের বিচার চেয়ে জামাতের সাথে আতাত করে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন কিছুদিন পরই মানুষ জানতে পেরেছে। শিবিরের পেজ থেকে , আমার দেশ থেকে ,ইনকিলাব থেকে প্রতিনিয়ত শাহবাগ কে ঘিরে এবং ব্লগারদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ প্রচারনা চলেছে অন্যদিকে আল্লামা শফির দল নাস্তিক মারা ওয়াজিব বলে ফতোয়া দিয়েছে। দুই দিক থেকে এমন অপপ্রচার বলে দেয় এসব সকল কিছুর তৎপরতা জামাত – হেফাজত সংঘবদ্ধভাবেই করছিলো। জামাত শিবির তাদের যে নীতি নিয়ে চলে হেফাজতের নীতির সাথে তাঁর কি তফাৎ তা উল্লেখ না করে আবাগাশ্রয়ী হয়ে হেফাজতকে ইতিবাচক শক্তি কল্পনা করা প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করা । মূলত হেফাজতের যা কর্মকাণ্ড তা জামাতের সাথে মোটেই আলাদা নয় কারন জামাত রাজনীতির মাঠে আধিপত্যের জন্য লড়ছে আর হেফাজত ঘরে বসেই তাঁর সেনানি তৈরি করছে। মূলত তারা তাদের মধ্যকার যে পার্থক্য দেখায় তা বড় কিছু নয় বরং এ কথায় সত্য যে অনুকূল পরিবেশ পেলে তাঁরা ৫ জুনের মতো একই মঞ্চে উঠতে দ্বিধা করবে না।