২০১১-১২ সালে মালালা ইউসুফজাই ছিল কেবলই একজন টিনেজ ব্লগার। বিবিসি নিউসের ব্লগসাইটে সে ‘গুল মাকাই’ নামে ব্লগিং করতো। ২০০৯ সালের শুরুতে মাত্র ১২ বছর বয়সে মালালা ব্লগিং শুরু করে এবং তার ‘উদ্দেশ্য-প্রণোদিত’ ব্লগিং দিয়ে গুল মাকাই নামটি একটি শক্তিশালী ব্রান্ডনেইম-এ প্রতিষ্ঠিত করে। নামটি এতই বিখ্যাত হয় যে, তার মা-বাবা গুল মাকাই নামেই তাকে পরিচিত করাতে রাজি হয়েছিলেন। তার বাবা যখন সাংবাদিকদের সামনে পরিচিত করালেন যে, মালালাই ‘গুল মাকাই’, তখন আরও দু’তিন মাস কেটে যায় সেটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে।
কী ছিল মালালার লেখনীতে?
এতো প্রেরণা কোথায় পেলো সে? মাত্র ৪ বছরের ব্লগিং ক্যারিয়ারে কী লিখেছিলো, যাতে সারা পৃথিবী কেঁপে ওঠে? ২০১২ সালের অক্টোবরের তালিবান আক্রমণ শুধুই কি একদিনের ঘটনা? চার বছরের ব্লগিং দিয়ে মালালা নারীশিক্ষা এবং নারী অধিকারের পক্ষে যে বাস্তবধর্মী চেতনা সৃষ্টি করেছে, তার বদৌলতেই দু’বছর আগের ‘ইন্টারনেট সেলিব্রিটি’ মালালা আজ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। মাত্র ১৭ বছর বয়সে নারী বা পুরুষ কেউ এ পুরস্কার পায় নি। এর পেছনে অনেক রাজনৈতিক, ভূ-রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক বিষয় আছে, কিন্তু মালালা ব্লগিং না করলে কিছুই তাকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করাতে পারতো না। ব্লগার পরিচয় ছাড়া, সে ছিল নিতান্তই একজন স্কুলছাত্রী।
গুল মাকাই নামের আড়ালে থেকে মালালা নিজের অবস্থান এবং তালিবানী দখলে থাকাকালীন সকল অন্যায় ও নির্যাতনের খবর তুলে ধরতে পেরেছিল। প্রথমত নিজের পরিস্থিতিকেই সে তুলে ধরেছিল তার লেখনীতে। ‘আমি ভয় পেয়েছি’ শিরোনামে মালালা তার ভয়ংকর স্বপ্নের কথা বলেছিল। সে জানিয়েছিল কীভাবে তালিবানদের নিষেধাজ্ঞার কারণে তার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ২৭ থেকে ১১তে নেমে গেছে এবং কীভাবে একের পর এক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ব্লগিং মানে নিজেকে প্রকাশ করা।
ব্লগিং মানে নিজেকে প্রকাশ করা। এখানেই ব্লগারের সাথে লেখক এবং সাংবাদিকদের মূল পার্থক্য। যুগে যুগে ওয়েব-লগের (ইন্টারনেটভিত্তিক খেরোখাতা) অর্থ জার্নাল থেকে সাংবাদিকতায় অথবা আরও কোন ভূমিকায় বিস্তৃত হবে, কিন্তু মৌলিক উদ্দেশ্য থেকে যাবে নামের মতই অপরিবর্তিত। ‘আমি হয়তো আর স্কুলে যেতে পারবো না’ শিরোনামে একটি রক্ষণশীল সমাজের কোন মেয়ে যখন ব্লগ পোস্ট দেয়, তখন সেটি আর তার সমস্যা হয়ে থাকে না। সকলের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। মালালা নিজের সমস্যার মধ্যে তার সমাজের সকল স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিল কিনা জানি না, তবে নিজেকে প্রকাশে সে ছিল অকুণ্ঠ। একজন ব্লগারের জন্য এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ আর কী হতে পারে!
মালালা একটি উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছিল
মালালা একটি উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছিল: সেটি হলো মেয়েদের শিক্ষা। ব্লগিং মানে শুধুই নাগরিক সাংবাদিকতা নয়, উদ্দেশ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে হয়। সেটি হতে পারে রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা ধর্মীয়। এলোপাতাড়ি সংবাদ পরিবেশন করলে তা এলোপাতাড়ি ফল নিয়ে আসবে। উদ্দেশ্য এক না হলে ফলাফলও এক থাকে না। একটি উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে এবং একটি ‘কজ’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যা-কিছু করা হোক, সেটি যদি মহৎ হয়, তবে সুফল আসবেই। নোবেল বিজয়ী মালালা তার দৃষ্টান্ত।
বন্যেরা বনে সুন্দর – আর ব্লগাররা ব্লগে!
বন্যেরা বনে সুন্দর – আর ব্লগাররা ব্লগে! ব্লগেই যাদের পরিচিতি এবং ব্লগেই যাদের বেড়ে ওঠা, তাদেরকে ব্লগে থেকেই সংগ্রাম করতে হয়। রাস্তায় নামলে তারা হয় অস্ত্রহীন, কারণ তাদের অস্ত্র কীবোর্ড। রাস্তার লোকদের অস্ত্র আবার অন্যরকম। মালালা তালিবানীদেরকে শারিরীকভাবে প্রতিরোধ করতে পারে নি, এমনকি নিজেকেও রক্ষা করতে পারে নি। এটি তার ক্ষমতার বাইরে, কেননা এটি তার অস্ত্র নয়। তার অস্ত্র ছিল ব্লগিং।
ব্লগার মালালা
মালালার ‘গুল মাকাই’ হয়ে ওঠার পেছনে পারিবারিক আনুকূল্য ছিল, এটা সত্যি। মা-বাবার সাহচর্য্য ছিল। তাদের অন্য মেয়েদেরকে শিক্ষা অর্জনের পর্যাপ্ত সুযোগ দিলেও, তারা মালালাকে তা দিয়েছিলেন অকাতরে। কিন্তু যা কিছু করা হোক, তালিবানি বিধি-নিষেধ থেকে তারা মালালাকে রক্ষা করতে পারেন নি। তারা বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছিল, বন্ধ করে দিয়েছিল মেয়েদের চলাফেরা। ভিসিডি’র দোকান, মেয়েদের পারলার ইত্যাদি বন্ধ করে দিয়েছিল। ২০০৮ সালের শেষে ৪০০ বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেলো। সেরকম এক পরিস্থিতিতে মেধাবী ছাত্রী মালালা, পড়াশুনার পাশাপাশি ব্লগিং করার প্রেরণা পেয়েছিলেন। এটি তার মা-বাবা বা সমাজ দেয় নি – সে নিজে থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছিল। অন্যান্য বোনগুলোর শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ না পাওয়ার বিষয়টিও তাকে ইতিবাচক প্রেরণা দিয়েছে।
ভূ-রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করলে, দেখা যাবে আমাদের অনেককিছুই মালালার সমাজের মতো নয়। মালালা’র মতো সামাজিক পরিস্থিতি আমাদের দেশে কখনও হবে না। তাছাড়া, নারীশিক্ষায় দেশের পারম্পরিক সরকারগুলো রাজনৈতিক ঐক্যতার পরিচয় দিয়ে যে অসামান্য সুফল এনেছে, তা আজ সমগ্র বিশ্বের জন্য বিস্ময়কর একটি বিষয়। ব্লগার মালালাকে বিশ্লেষণ করে, তার ব্লগীয় গুনাবলীতে আলোকপাত করাই ছিল এই লেখার উদ্দেশ্য। কোন বিশাল পুরস্কার না জিততে পারলেও ব্লগারা এতে অনুপ্রেরণার কিছু বিষয় পেতে পারেন।
[প্রথম ছবিটি lotenna.wordpress.com থেকে এবং মালালা’র ব্লগ অংশটি ’টাইমস’ থেকে]