(ছবি: গুগল)
আমার একটা একুরিয়াম আছে। যখন ছোট ছিলাম এক ঈদের দিন আব্বা তার পরিচিত কারমাইকেল কলেজের এক শিক্ষকের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে প্রথম একুরিয়াম দেখি। ছোট ছোট রঙিন মাছ একটি চারকোনা কাঁচের বাক্সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই বয়সে আমি একুরিয়ামের রঙিন মাছ দেখে খুব অভিভুত হয়ে গিয়েছিলাম। যতক্ষন সেই বাসাতে অবস্থান করছিলাম আমি রঙিন মাছ গুলোর শোভা উপভোগ করছিলাম। বড় বড় ঝাকড়া লেজের গোল্ড ফিস, কালো এঞ্জেল, টাইগার শার্ক গুলো আমার কল্পনার জগতে নতুন একটা পালক যোগ করলো। বাসায় এসেও মাছ গুলোর কথা ভাবতে লাগলাম। সেই বারের ঈদের আনন্দের পূর্নতা পেয়েছিল বাহারি রঙিন মাছ দেখে। মনের মাঝে একটা স্বপ্ন পুষে রেখেছিলাম যখন বড় হব আমিও এমন করে মাছ পালন করবো।
অনার্স, মাস্টার্স, থিসিস এবং পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা (আই.টি) ছাত্র জীবনের একটা দীর্ঘ্য সময় মেসে কাটিয়েছি। এইচ.এস.সি পরীক্ষা দেয়ার আগ পর্যন্ত আব্বা আম্মার কাছ থেকে হাত খরচের যে টাকা পেতাম তা ছিল খুবই সামান্য। তবে আমাদের দুই ভাই এর কোন অভাব তারা রাখেন নাই, সাধ্য মত সবই পূরন করেছেন।
আমি অনার্স পড়াকালীন সময় থেকে ছাত্র/ ছাত্রী পড়াতাম। সেখান থেকে আমার হাত খরচের টাকা সুন্দর উঠে আসতো। আর বিকাল বা সন্ধ্যাকালীন নাস্তা খরচ থেকে ও রেহাই পেতাম। আমি যে বাসা গুলোতে পড়াতাম কোন এক আশ্চর্য কারনে অভিভাবকরা আমাকে খুব পছন্দ করতো। যেন কিছু দিনের মাঝেই তাদের পরিবারের অংশ হয়ে যেতাম। যদিও আমি জানি অন্যের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নাই। এই অক্ষমতার ব্যাপেরে আমি খুবই সচেতন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার খুব বেশী বন্ধু ছিল না। তবে যারা ছিল তাদের কাছে আমি এবং আমার কাছে তারা ছিল অতি আপন। সবচেয়ে মজার বিষয়, সেই বন্ধুদের ৯০% এর সাথে আমার এখনো যোগাযোগ রয়েছে। তারা ঢাকায় আসলে আমার বাসায় উঠে অথবা বেড়াতে আসে। আমার বন্ধুর সংখ্যা কম কিন্তু তাদের নিয়ে আমি গর্ববোধ করতে পারি।
মনের মাঝে লুকায়িত ছোট বেলার সেই শখ বছর তিনেক আগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। একটা একুরিয়াম কিনবো। আমার মিসেস কখনো আমার শখকে নিরুৎসাহিত করে নাই। আমি আসলে মানুষ হিসাবে যতটা সফলতা পেয়েছি, আমার ভাগ্য তার চাইতে বেশী আমাকে সহায়তা করেছে। আমি খুব লক্ষী একটা বউ পেয়েছি। সে দেখতে যতটা সাধারন কিন্তু মানুষ হিসাবে ঠিক ততটাই অসাধারন। আমার সমস্ত দোষ-ত্রুটি তার উদারতা দিয়ে মুছে দিয়েছে। আমি বুঝি, অসাধারন সেই মানুষটাকে তার প্রাপ্য মূল্যায়ন আমি এখনো করতে পারি নাই। যা হোক ম্যডাম বললো, কোথায় রাখবা? প্রতি মাসে পানি পাল্টাতে হবে, এতো ধৈর্য তোমার থাকবে কি না? অবশেষে ওকে বুঝিয়ে আমার এক মাত্র ছেলে সহ দোকানে গেলাম। দোকানের সব চেয়ে বড় ট্যাঙ্কটা (৮০ লিটার পানি ধারন ক্ষমতার) পছন্দ করলাম। মাছ ও আনুসাঙ্গীক অন্যান্য কিছুর মূল্য পরিশোধ করে বাসায় চলে আসলাম। দোকানের ছেলেটা বললো ভাই আমি রাতে আপনার বাসায় যেয়ে সব সেট করে দিয়ে আসবো। সেদিন রাতেই ১:৩০ মিনিটে একটা শব্দ করে ট্যাংকের তলার কাঁচ ভেঙ্গে গিয়ে সব পানি পরে গেল। ঘরটা পানিতে ভেসে গেল। খাটের নীচের জিনিষ পত্র সব ভিজে গেল। সেই রাতে একুরিয়াম রাখা ঘরে ছিল আমার জ্যাঠাত ভাই আর তার নব পরিনিতা স্ত্রী। আমি মাছ গুলো একটা আলাদা বালতি তুলে রাখলাম আর সবাই মিলে ঘরের পানি পরিষ্কারে লেগে গেলাম, সবার প্রচেষ্টায় পানি পরিষ্কার করে ঘন্টা খানিক পর ঘুমাতে গেলাম।
ম্যাডাম আর ঘরে একুরিয়াম রাখতে দিতে নারাজ। অবশেষে বড় ট্যাংকটা পাল্টিয়ে এটা ছোট একুরিয়াম রাখবো সেই শর্তে রাজি হলেন। পরের দিন ছোট একুরিয়াম আসলো। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে রঙিন মাছের খেলা দেখতাম। এমনও হতো আমি মাছ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তাম। অফিস থেকে এসে আমার প্রথম কাজ ছিল মাছের খাবার দেওয়া আর কিছুটা সময় তাদের সাথে কাটানো। প্রথম দিকে ৩/৪ টা মাছ মরে গিয়ে ছিল। আমার খুব কষ্ট হতো। আমার স্ত্রী আবার ঐ রকম মাছ কিনে নিয়ে আসতো। আমার কাছে মনে হতো যেটা মরে গেছে সেটা তো এইটা না।
গতকাল ও ছেলেকে সাথে নিয়ে পানির ট্যাংক, পাথর পরিষ্কার করেছি। আজ পানিটা খুব ঝকঝকে পরিষ্কার। এখানে ২ টা টাইগার শার্ক আছে যার বয়স ৩ বছরের বেশী। আমি আমার পূর্বের কর্মস্থল টঙ্গী অফিসও একটা একুরিয়াম দিয়ে সাজিয়ে ছিলাম। আমি নিজে ওটার যত্ন করতাম। সহকর্মীরা বেশ খুশী হয়েছিল একুরিয়ামটি দেখে। মনে আছে একদিন ৪ বছরের এক বাচ্চা তার মায়ের সাথে এসেছিল , তাকে মাছের সামনে থেকে নিয়ে যেতে মা-কে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। টঙ্গী থেকে বদলী হয়ে গুলশান অফিসে এসেছি এক বছর তিন মাস আগে। এই সময়ে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আমিও খানিকটা বদলে গেছি।
আমি আমার জীবন এবং কাছের মানুষ গুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কিছু পেয়েছি, তারপর ও মাঝে মাঝে কেন জানিনা নিজেকে একুরিয়ামে বন্দি রঙিন মাছের মত মনে হয়।