বাংলাদেশের কোন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হ্যালোউইন উদযাপন করে জানতাম না। জানাল আমারই এক আদিবাসী বন্ধু, উচ্ছ্বাস ম্রং তার নাম। ময়মনসিংহের গারো পাহাড় ঘেঁষে তার বাড়ি। তারা গারো, তবে অন্য গারোদের চেয়ে একটু আলাদা। ক্ষুদ্র উপজাতি বিভক্তিকরণের কিছু অজানা নিয়ম কানুনে তারা অন্যান্য গারোদের মতো নয়, নিয়ম কানুনগুলো কি, উচ্ছ্বাস নিজেও ভাল জানে না, স্বীকার করে নিল। মোট কথা, অন্যদের চেয়ে আলাদা বলেই তারা হ্যালোউইন উদযাপন করে।
মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হতো একবার ভূতের সাঁজে সেজেগুজে হ্যালোউইন করতে যেতে, বন্ধুদের আড্ডায় কথাটা বলেই ফেললাম একবার। আমি, ইতি, উচ্ছ্বাস আর দীপ্ত ছিলাম সেদিন আড্ডায়। ইউনিভার্সিটি সবে শেষ হয়েছে আমাদের। চাকরীর জন্য সবাই টুকটাক ঘোরাঘুরি করছি, ইন্টারভিউ দিচ্ছি, বাদবাকি সময়ে আড্ডা দেওয়া ছাড়া তেমন কাজ নেই।
উচ্ছ্বাস কথাটা মাটিতে ফেলতে দিল না। বলল- “তোরা চাইলে যেতে পারিস তো আমাদের গ্রামে, ছোটবেলা থেকে দেখছি হ্যালোউইন উদযাপিত হয় সেখানে।”
প্রথমেই আমরা অবাক হলাম। আদিবাসী গ্রামে শহুরে বিলাসিতা? উহু, উচ্ছ্বাস ভুলটা ধরে দিল। হ্যালোউইন আমাদের জন্য একটা বিলাসী উৎসব হলেও ওদের জন্য একটা ধার্মিক উৎসবও বটে। ময়মনসিংহ পেরিয়ে শেরপুর, তার কোল ঘেঁষে গারো পাহাড়। সেখানে থাকে গারো সম্প্রদায়। পুরো এলাকায় ক্যাথলিকদের প্রভাব। আদিবাসীরা সবাই খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত। উচ্ছ্বাসদের সম্প্রদায় এই উৎসবটা ঘটা করেই পালন করে প্রতি বছর, তবে অন্য গারোরা করে কিনা, সে নিশ্চিত হয়ে বলতে পারল না।
উচ্ছ্বাস বলেছিল-“চল তোরা। ঢাকা থেকে কয়েক ঘণ্টার পথ মাত্র। গান হবে, নাচ হবে, আগুনের ধারে বসে ক্যাম্পফায়ারের মতো মজা করা যাবে, ছাগলের মাংস দিয়ে বারবি কিউ মতো খাবার, সেই সাথে ভূতুরে সাঁজ আর অভিনয় তো আছেই, তোদের খারাপ লাগবে না নিশ্চয়তা দিচ্ছি। না, বিদেশীদের মতো ট্রিক অর ট্রিট হয় না, একটু দেশি ধাঁচে হয় ব্যাপারটা, প্রায় রিচুয়ালের মতো। অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা হবে।”
দীপ্ত আর ইতি তো একপায়ে খাড়া। আমিও অমত করলাম না। দীপ্তদের টয়োটায় চেপে এক রাতে রওয়ানা হলাম আমরা গারো পাহাড়ের উদ্দেশে।
ময়মনসিংহ পেরিয়ে কুয়াশা ঢাকা, দীর্ঘ, নির্জন একটা রাস্তা ধরে শেরপুর, সেখান থেকে কয়েকটা বাঁক নিয়ে নালিতাবাড়ি হয়ে আরও গভীরের একটা পাহাড়ি গ্রামে গেলাম। একসময় গাড়ি থামাতে হলো। সামনে গাড়ি চালানোর মতো রাস্তা নেই, হেটে যেতে হবে। উচ্ছ্বাসের পরিচিত এক গ্যারাজে গাড়িটা রেখে হাটা ধরলাম আমি। কুয়াশা আর আলো আধারিতে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল আমাদের নিজেদের।
দীপ্ত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজেছে, শরীরের এখানে ওখানে রঙ দিয়ে আঁকা সুতোর সেলাই, যেন সারা শরীরে কাটাকুটি করে জোড়া লাগানো হয়েছে আবার। তার রঙের কাজ বেশ নিখুঁত হয়েছে। মনে হচ্ছে সেলাই ভেদ করে দুয়েকফোঁটা রক্তও বের হয়ে আসবে এখন। ইতি সেজেছে ভাম্পায়ার। ঠোঁটগুলো উঁচু হয়ে ভেতরে লাগানো নকল ভাম্পায়ার দাঁত দেখা যাচ্ছে। মুখে দুধের মাতা সাদা মেক আপ, চোখের নিচে কালশিটে। যেন বহুদিন রক্ত খেতে না পেরে ভাম্পায়ার আজ হন্য হয়ে উঠেছে, শিকারে বেরিয়েছে আজ রাতে। আমি মাথায় ছুড়ি ঢোকানো মৃত মানুষ সেজেছি। কোন মেক আপ টেক আপ নয়, শুধু মাথার একপাশ থেকে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, এমন একটা ছুরি লাগিয়েছি মাথায়। অনেকটা হেডব্যান্ডের মতো ছুরিটা। শুধু এপাশ আর ওপাশ দেখা যায়, মাঝখানের অংশ নেই। হেডসেটের মতো করে পরলে মনে হবে সত্যিই বোধহয় ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ আমার মাথায়। উচ্ছ্বাস এসব সাঁজে সাজেনি। সে এমনিই এসেছে। আমাদের ভূতেদের দলে একমাত্র মানুষ।
মেঠো পথ আর জঙ্গল পেরিয়ে যখন আমরা দেখলাম গ্রামটা, মনটা ভাল হয়ে গেল। ঠিক যেমন বর্ণনা দিয়েছিল উচ্ছ্বাস, তেমনই একটা গ্রাম। এখানে ওখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে, আগুনের উপর ঝলসানো হচ্ছে ছাগলের মস্ত মস্ত হাড়সহ মাংস, কোথাও কোথাও আস্ত ছাগল। একদল আদিবাসী মেয়ে নেচে বেড়াচ্ছে কেমন অদ্ভুত ছন্দে, আদিবাসী ছেলেরা কেউ কেউ আমাদের মতো ভূত সেজেছে বটে, তবে তাদের মেক আপ তেমন ভালো হয়নি। ভূতের চেয়ে জংলী জংলী লাগছিল বেশি। অবশ্য, আদিবাসীদের প্রচলিত ভূতের কাহিনী অনুযায়ী হয়তো কোন ভূত সেজেছে তারা, তাই চিনতে পারছি না এমনও হতে পারে। যাক, দেশীয় সংস্কৃতি, দেশীয় ভূত, বেশ ভাল; আমাদের মতো বিদেশী ভূত তারা নয়।
উচ্ছ্বাসের আদিবাসী বন্ধুরা আমাদের বরণ করে নিলেও ওদের দলপতি গোছের একজন এসে একটু বাঁধ সাধল। এসে গম্ভীর গলায়, বাংলাতেই বলল-“উচ্ছ্বাস, ওদের যে নিয়ে এসেছ, ওরা এখানকার হ্যালোউইনের সেই নিয়মটা জানে তো?”
উচ্ছ্বাস মাথা চুলকাল, ওর চেহারা দেখে হাসি চাপলাম আমি। বুঝতে পারছি এমন কোন নিয়মের কথা সে নিজেও জানে না। বলল, “কি যেন ছিল সেটা দাদা, একটু মনে করিয়ে দিন না!”
দলপতি বাংলা বললেও তার উচ্চারণ ভাঙা ভাঙা, অস্পষ্ট। একটু ইতস্তত করে সে বলল, “এখানে হ্যালোউইনে চু খাওয়া নিষেধ।”
চু একটা আদিবাসী মদ। গারোদের এখানে বেশ জনপ্রিয়। সাদা-ধূসর রঙের, অনেকটা বোরহানির মতো দেখতে একটা মদ। সত্যি বলতে, আমার ইচ্ছে ছিল অল্প বিস্তর চু খাওয়া। কিন্তু দলপতির নিষেধের পর বোধহয় সেটা আর সম্ভব নয়।
উচ্ছ্বাস বলল, “ঠিক আছে দাদা, এ নিয়ে চিন্তা করবেন না।”
ফিরে এসে আমাদের কানে কানে বলল, “তোরাও চিন্তা করিস না! দাদা একটু পুরনো আমলের লোক। এখানে অন্যরা এসব নিয়ম টিয়মের কোন তোয়াক্কা করে না। তোরা চাইলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি।”
আমি বললাম, “না থাক, নিষেধ লঙ্ঘন করতে চাই না একদিনের অতিথি হয়ে। বরং এক কাজ কর, চু ছাড়া অন্য কিছু থাকলে নিয়ে আয়।”
উচ্ছ্বাস চোখ টিপ মেরে বলল, “তাড়ি আছে, খাবি?”
তাড়ি আরেক রকমের মদ, তাল দিয়ে বানায়। সত্যি বলতে, মদ বলতে আমরা যেমন এলকোহল বুঝি, এরা তেমন ভাবে না। তাড়িকে তালের রস হিসেবেই খায় অনেকে। আমরা রাজি হলাম তাড়ি খেতে।
ইতি আর দীপ্ত বসে নেই, ওরা ঘুরে ঘুরে গ্রামটা দেখছে, আদিবাসীদের সাথে কথা বলছে, আমি আগুনের ধারে উচ্ছ্বাসের সাথে বসে আছি হাতে তাড়ির বোতল নিয়ে। শীতের মধ্যে বেশ ওম ওম লাগছে আগুনের ধারে। ইতি আর দীপ্তর মধ্যে কিছু একটা চলছে, ওরা প্রেম ট্রেম করতে পারে গোপনে সোপনে, আমাদের কিছু না জানালেও বুঝতে পারি। হাতে হাত রাখার ধরণ, কাছে থাকার ধরণ, কথা বলার ধরণ...কত কত সিম্পটম থাকে প্রেমের। তবে কিছু বলি না ওদের। আজও বিরক্ত করলাম না, ঘুরুক, করুক প্রেম। বিয়ে টিয়ে করার বয়স ঘনিয়ে এসেছে, এখন না করলে কখন!
তাড়ি খেতে খেতে হালকা নেশা ধরে গিয়েছিল বোধহয়। আগুনটাকে বেশ জ্ব্যান্ত মনে হলো। উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বললাম, “দেখতে পাচ্ছিস ওই দিকে কয়েকটা ছেলে মেয়ে বসে বসে চু খাচ্ছে? সাদাটে বোতল দেখতে পাচ্ছি ওদের হাতে।”
উচ্ছ্বাস বলল, “হ্যা, যা বলেছিলাম তোদের। এসব নিয়ে কেউ এখন মাথা ঘামায় না। ছোটবেলায় শুনেছিলাম, হ্যালোউইনে নিয়ম কানুন না মানলে নাকি ভূত প্রেতের অভিশাপ নেমে আসে। এসব বিষয় নিয়ে সেভাবে গা করি না এখন আর।”
“বাহ, বেশ!”
কনুই দিয়ে আমাকে গুঁতো দিল উচ্ছ্বাস। বলল-“দেখতে পাচ্ছিস, দীপ্ত আর ইতিকে? আগুনের ওপাশে বসে নাচছে দু’জন? কিছু চলছে নাকি দু’জনের ভেতর?”
দেখলাম, ইতির কোমরে দীপ্তর হাত, দীপ্তর গলায় ইতির। খুব ধীর লয়ে নাচছে তারা, যেন গ্রামোফোনে জাজের সংগীত বাজছে পেছনে।
বললাম, “চলছে তো দেখতেই পাচ্ছি। ব্যাপারটা হলো আমাদের সামনে স্বীকার করবে কখন ওরা।”
উচ্ছ্বাস হাসল, তাড়ির গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াল আরেকবার। দীপ্ত আর আর ইতির ঠোঁট দু’টোও অনেক কাছে চলে এসেছে, আলতো ভাবে ছুঁয়ে গেল একজনের ঠোঁট আরেকজনের সঙ্গে। হাসলাম আমি, ভাম্পায়ার আর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের প্রেম; তবে আজকের পর ব্যাপারটা অস্বীকার করার সুযোগ দেব না ওদের।
হঠাৎ উচ্ছ্বাস চিৎকার করে টান দিল আমার হাত। ভয়ংকর ঘটনাগুলো ঘটতে লাগল খুব দ্রুত।
আগুনের শিখাগুলো যেন লাফ দিয়ে হঠাৎ আকাশ ছুঁলো। জ্বলতে থাকা আস্ত আস্ত ছাগলগুলো পুড়তে পুড়তে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল, রক্ত মাংসের পিন্ড হয়ে হাটতে হাটতে চলে গেল মাঠের দিকে। একটা আস্ত রানও আগুনে পুড়তে থাকা শিক সহ একপায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠের দিকে ছুটতে লাগল।
ইতির নকল দাঁতগুলো যেন জ্ব্যান্ত হয়ে উঠল, গলা দিয়ে ঘর ঘর শব্দ করতে করতে কামড় বসিয়ে দিল দীপ্তর গলায়। ভয়ংকর জান্তব হুংকার দিয়ে ইতির চুল ধরে দীপ্ত ওকে ছুড়ে দিল দূরে। হাতের ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের সেলাইগুলো থেকে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল তার। আদিবাসীদের মধ্যেও ভীষণ ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। যারা যে ভূত সেজেছিল, হুরমুর করে জলজ্যান্ত ভূতে পরিণত হতে লাগল তারা।
অস্ফুট স্বরে উচ্ছ্বাস বলল, “অভিশাপ নেমেছে আমাদের উপর!”
আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, “তোদেরই দোষ, তোদের ছেলেরাই চু খাচ্ছিল এই উৎসবে। এই উৎসবে এটা নিষিদ্ধ জেনেও...”
“সে তো ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি খাচ্ছে সবাই...”
“তবে?”
জিজ্ঞেস করতেই মনে পড়ল দলপতির কথাটা...এখানে হ্যালোউইনে চু খাওয়া নিষেধ...তার বাংলা উচ্চারণ ভাঙা ভাঙা, সে আসলে চু নয়, চুমু বোঝাচ্ছিল। নিয়মের লঙ্ঘন আসলে করেছে দীপ্ত আর ইতি।
প্রচন্ড যন্ত্রণায় মাথাটা চেপে ধরলাম হঠাৎ। দেখে লাফ দিয়ে আমার থেকে দূরে সরে গেল উচ্ছ্বাস। বলল, “তোর মাথার ছুরি...”
হ্যা, ছুরিটা বোধহয় জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। ভীষণ ব্যথা...চেতনা লুপ্ত হতে থাকল আমার ধীরে ধীরে...
(গারো সম্প্রদায় খ্রিস্টান বটে। তাদের গ্রামে গিয়ে শুনেছি, তারা বড়দিন, ইস্টার সানডে, ওয়াঙ্গালা এসব পালন করে। হ্যালোউইন করে কিনা জানি না। সম্ভবত করে না। এই অংশটুকু পুরোপুরি কাল্পনিক, ঘটনাগুলোও তাই।)