কিছুদিন আগে শেরপুর গিয়েছিলাম, উঠেছিলাম হোটেল সম্রাটে। ছিমছাম গোছালো রুম। আমার সঙ্গে দু’জন বন্ধু ছিল; টুটুল এবং মনির। তিনজন ভাগাভাগি করে নিলাম নিজেদের বিছানা। হোটেলে উঠে জামা কাপড় ছেড়ে গোসল করব, তখন বিষয়টা চোখে পড়ল। বাথরুমে আমাদের টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, শেভিং রেজর এসব রাখা ছিল। অদ্ভুত বিষয় হলো, টুথব্রাশ রাখা আছে চারটে, অথচ মানুষ আমরা তিন জন।
আমি গোসল সেরে বেরিয়ে এলাম। টুটুল ফোনে কথা বলছিল। সারাক্ষণই বলে, নতুন কিছু নয়। ভাগ্যবান প্রেমিক সে। মনির বসে বসে ফেসবুকে চ্যাট করছিল কার সাথে যেন।
আমি মনিরকে বললাম-“বাথরুমে টুথব্রাশ চারটে কেন? তুমি কি এক্সট্রা টুথব্রাশ নিয়ে এসেছ?” মনির ভৈরবের ছেলে, তাকে তুমি করে ডাকি। টুটুল বরিশালের ছেলে, জাতভাই, তাকে ডাকি তুই তুই করে।
মনির মাথা নাড়ল, “নাহ, আমি তো একটাই এনেছি টুথব্রাশ।”
“তাহলে চার নম্বরটা কার, তোর নাকি টুটুলের?”
টুটুল ফোনে কথা বলতে বলেই মাথা দোলাল, তার নয়। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আমি মাঝে মধ্যে চিন্তায় পড়ে যাই। এখনও তাই ঘটল। আমি ভাবতে লাগলাম টুথব্রাশটা কার। মনির সেটা লক্ষ্য করল। বলল- “হবে হয়তো আমাদের আগে যারা উঠেছিল, তাদের কারো।”
হ্যা, সে সম্ভাবনা আমার মাথায়ও এসেছে বটে, তবুও খুঁতখুঁত করছিল মনটা। কারণ হোটেলের রেজিস্টারে সাইন করার সময় আমাদের কামরার লাস্ট এন্ট্রি দেখেছিলাম ৬ দিন আগে। গত ৬ দিনে এই কামরায় কেউ ওঠেনি। হোটেল কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার করে ফেলেছে রুমটা। সিগারেটের ছাই নেই, পুরনো পত্রিকা নেই, জুতো থেকে খসে পরা বালি নেই, বাথরুমও ঝকঝকে তকতকে, এতকিছুর মধ্যে একটা টুথব্রাশের কথা বেমালুম ভুলে গেল তারা! অসম্ভব তা নয়, তবে কিছুটা অদ্ভুত ঠেকল আমার কাছে। তবে একটা অসহায় টুথব্রাশকে নিয়ে এতটা ভাবারও বা কি আছে!
পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে গেলাম, যে কাজে এসেছিলাম সে কাজে ডুবে রইলাম সারাদিন। সন্ধ্যার দিকে ফিরলাম ক্লান্ত হয়ে। আমি চা-নাস্তা করতে গিয়ে আধাঘণ্টা দেরিতে ফিরেছি। টুটুল-মনির গোসল-টোসল সেরে ফেলেছে আমি আসার আগেই।
জুতো মুজো খুলে, শার্টটা ছেড়েই বাথরুমে গেলাম। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজলাম ৫ মিনিট চোখ বন্ধ করে। রেজরটা হাতে নিয়ে দ্রুত হাতে শেভ করলাম। তারপর সময় নিয়ে দাঁত ব্রাশ করলাম আস্তে আস্তে। রাতে ডিনারের প্রোগ্রাম রয়েছে আমাদের, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার। বাথরুম থেকে বেরোতে যাব, তখনই চোখে পড়ল ব্যাপারটা। চারটা টুথব্রাশই ভেজা! তার মানে ৪ টা টুথব্রাশই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ তো আমরা তিনজন! চতুর্থ জনটা কে? ভূতুরে গল্পের মতো হোটেলে লুকিয়ে থাকা অশরীরী আত্মা?
আমি টুথব্রাশগুলো নিয়ে ঝড়ের গতিতে বাইরে বেরোলাম। আমার ফ্যাকাসে চেহারা দেখে মনির-টুটুল দু’জনেই উঠে দাড়াল অবাক হয়ে। টুটুল ফোনে কথা বলছিল তখনও, আমার চেহারা দেখে ফোনের ওপাশে থাকা মানুষের উদ্দেশে বলল, “একটু দাড়াও, কল ব্যাক করছি একটু পর।”
আমি ওদেরকে বললাম-“৪ টা টুথব্রাশই কেউ ব্যবহার করেছে। এই দেখ, সবগুলো টুথব্রাশ ভেজা, দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যবহার করেছে কেউ এগুলো কিছুক্ষণ আগে। চতুর্থ জনটা কে?”
মনির বলল-“এমন হতে পারে না যে আমরা কেউ ভুলে চার নম্বরটা দিয়ে দাঁত মাজা শুরু করেছি, পরে ভুল বোঝার পর রেখে দিয়ে নিজেরটা দিয়ে শেষ করেছি বাকী কাজ? সম্ভব নয়?”
“সম্ভব। কিন্তু এই কাজটা কে করেছে? আমি করিনি! মনির করেছ? নাকি টুটুল তুই?”
দু’জনেই মাথা দোলাল। আমি একটু ভয় পেলাম। “তাহলে ৪ নম্বর লোকটা কে! এই রুমে কি আমরা ৩ জন ছাড়া অতিরিক্ত কেউ আছে?”
মনিরের চেহারায় একটু ভয়ের ছায়া দেখলাম। তবে টুটুল ভয় পেল না। সে তুলনামূলকভাবে বেশ স্মার্ট। হেসে উঠল সে হো হো করে। বলল-“আরে ভাই, একটা টুথব্রাশই তো। এতো সিরিয়াস হবার কি আছে! এমনিতেই হয়তো ভিজে গেছে পানির ছিটায়!!”
“উহু, পানির ছিটা লেগে এভাবে ভিজতে পারে না ব্রাশগুলো। টুথব্রাশের টাফটগুলো বেঁকে গেছে দাঁতের চাপে। কেউ কিছুক্ষণ আগেই ব্যবহার করেছে বোঝা যাচ্ছে।”
“তাহলে স্টাফরা কেউ এসে দাঁত ব্রাশ করে গেছে বোধহয় আমাদের আগেই। বাদ দে!”
এটা সম্ভব। আমার মন তবুও খুঁতখুঁত করতেই লাগল।
রাতে ডিনার সেরে এসে ক্রিকেট ম্যাচ দেখলাম আমরা কিছুক্ষণ। তারপর ঘুমিয়ে গেলাম। ক্লান্ত ছিলাম, নিরেট একটা ঘুম হলো। তবে ভেঙে গেল বেশ ভোরে। বাইরে এখনও ভালোমতো আলো ফোটেনি। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে অল্প অল্প। শহরতলীর পাখি, ডাকের মধ্যেও যেন জড়তা। না আছে শহুরে ভাব, না আছে গ্রামের বন্য সুর।
আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, মনির এখনও ঘুমোচ্ছে, তবে টুটুল তার বিছানায় নেই। হয় ফোনে কথা বলছে না হলে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হচ্ছে। আমি চোখ কচলে হাটতে হাটতে বারান্দার দিকে গেলাম। বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সকাল হতে দেখব ভাবলাম।
বারান্দার সাথে লাগোয়া বাথরুম। বাথরুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলাম, দরজা হালকা খোলা। টুটুল দাঁত ব্রাশ করছে। কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম দাঁত ব্রাশ শেষ হলো টুটুলের। গার্গল করে চোখেমুখে পানির ছিটা দিল সে। বাইরে দাড়ানো আমাকে খেয়াল করেনি তখনও। ওকে গুড মর্নিং বলার জন্য মুখ খুলতেই আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যটা দেখলাম।
দেখলাম, টুটুল আয়নার দিকে পাশ ফিরল। নিজের গালের দিকটা দেখছে বোধহয় কোন কারণে। কিন্তু না, আমার ধারণা ভুল। সে ৪ নম্বর টুথব্রাশটা হাতে তুলে নিল। টুথব্রাশ ধরা হাতটা ঘুরিয়ে নিয়ে গেল মাথার পেছনে। মাথার পেছনের চুলগুলো সরে যেতে লাগল ওর। মাথাটা একটু সামনের দিকে ঝোঁকাল সে, মাথার পেছনে বেরিয়ে পড়ল তার এক সারি ধবধবে সাদা দাঁত। তবে সেগুলো মানুষের দাঁতের মতো নয়। কুমিরের মতো সারি সারি উঁচু নিচু এবড়ো-থেবড়ো দাঁত। ওগুলো মাজতে লাগল সে।
আমার পা দু’টো ভয়ে দুর্বল হয়ে এলো। পরেই যাচ্ছিলাম আরেকটু হলে। মুখ থেকে হালকা অস্ফুট আর্তনাদ বেরোল আমার। অমনি আমাকে দেখে ফেলল টুটুল। দেখতেই পেছনের দাঁতগুলো দিয়ে মস্ত হা করল সে। সামনের মুখটাও হা হয়ে গেলো। সামনে পেছনে দু’দুটো মুখ তার। একটা মুখ দিয়ে মানুষের মতো হুংকার দিয়ে উঠল, আরেকটা মুখ দিয়ে গুঙিয়ে উঠল জন্তুর মতো! তারপর সে লাফ দিয়ে পড়ল আমার গায়ের উপর! অন্ধকার হয়ে এলো আমার পৃথিবী!
এই সিরিজের অন্যান্য গল্পঃ
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ রনিদের বাড়ি
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ ব্যাঙমানবী
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ শয়তানবিদ্যা
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ অবসেশন
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ আয়না-ভীতি
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ কুকুরের ডাক