এক
রুজী আক্তার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেজাল্ট কার্ডের দিকে। তার ফর্সা গালের লাল লাল ছোপগুলো এক ধরনের চাপা রাগ প্রকাশ করছে। ইন্টারভিউ বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরা বিষয়টা লক্ষ্য করে হাসছে মুখ টিপে। রুজী আক্তারের রাগের কারণ সবার কাছে পরিষ্কার। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করার জন্য কমিটি গঠন করা, সহজ প্রশ্নকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জটিল করা, জটিল প্রশ্নকে আরও জটিল করে তোলা- ইউনিভার্সিটির হয়ে এই কাজগুলো সে গত ১০ বছর ধরে করে আসছে। তার তৈরি প্রশ্নপত্র এতই কঠিন হয় যে গত ১০ বছরে কোন পরীক্ষার্থী ৮০-র ঘরে নাম্বার তুলতে পারেনি। কিন্তু এ বছর সব রেকর্ড ভেঙে-চুরে একটা ছেলে ৯৭ নম্বর পেয়েছে। রুজী আক্তারের ক্ষোভের বিষয় সেটাই।
ইন্টারভিউ বোর্ডের বাকী সদস্যদের দিকে মুখ তুলে তাকাল রুজী। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল-
“আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এ বছর। তা না হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন যেভাবে তৈরি হয়, তাতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা কোন ছাত্রের পক্ষে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর তোলা সম্ভব নয়।”
জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন আফসার উদ্দিন রেজাল্টের একটা শিট হাতে নিয়ে দেখছিলেন মনোযোগ দিয়ে। তিনি বললেন-“আমার তা মনে হয় না রুজী। এমন কিছু হলে অনেকের রেজাল্টই ৮০-৯০ হতো। কিন্তু সেকেন্ড হাইয়েস্ট নম্বর হচ্ছে ৭৯। পুরো ১৮ নম্বরের ফারাক। এই ছেলেটা একা নিশ্চয়ই প্রশ্নপত্র হাতে পায়নি।”
“তাহলে হতে পারে সে চিট করেছে কোনভাবে।”
“হতে পারে। আবার হয়তো এমনও হতে পারে যে আমরা এক্সট্রা অর্ডিনারি একটা ছাত্র পেয়েছি।”
রুজী আক্তার অসন্তুষ্ট হলো আফসার উদ্দিনের কথায়। কিন্তু তার সাথে তর্ক করল না। আফসার উদ্দিন তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। রুজী যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, আফসার উদ্দিন তখন বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের এসোসিয়েট প্রফেসর। এত সিনিয়র কারো সাথে ভরা সভায় তর্ক করা চলে না।
তাদের দু’জনের অন্তর্দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করে আরেকজন শিক্ষক বললেন- “তাহলে আমরা ইন্টারভিউ শুরু করি, কি বলেন আপনারা? আব্দুল, ক্যান্ডিডেটদের ডাকা শুরু করো।”
পিয়ন আব্দুল বাইরে গেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের ডাকতে। ৯৭ পাওয়া ছেলেটা যেহেতু প্রথম হয়েছে, সেই সবার আগে আসল কক্ষে। রুজী একটু অবাক হলো ছেলেটাকে দেখে। গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি তার, ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত। এক ধরনের উগ্র ভাব রয়েছে চেহারায়। ছাত্র সংগঠনগুলোর কোন উঠতি নেতার মতো দেখাচ্ছে। ছেলেটা রুমে এসে কারো দিকে না তাকিয়ে রুজী আক্তারের চোখের দিকে তাকাল। মিষ্টি পুরুষালী কন্ঠে বলল-“ম্যাম, বসতে পারি?”
রুজী আক্তার এবার একটু বিস্মিত হলো। ইন্টারভিউ বোর্ডে পাঁচ জন শিক্ষক থাকতে ছেলেটা তার কাছেই অনুমতি চাইল বসার! সে কি জানে তার উপর রুজীর অসন্তুষ্টির কথা? নাকি বিষয়টা স্রেফ কাকতালীয়? গম্ভীর গলায় রুজী বলল-“বসো।”
ছেলেটা বসল। বসেও রুজীর দিকে তাকিয়ে রইল। যেন সে টের পেয়েছে সামনে বসা ম্যাডাম তাকে যাচাই বাছাই করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।
রুজী জিজ্ঞেস করল-“নাম কি তোমার?”
“আবু সাঈদ।”
“রিটেন পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
“ভালো হয়েছে ম্যাম।”
“তুমি আমাদের ইউনিভার্সিটির অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৯৭ শতাংশ নম্বর পেয়েছ। কাজেই তোমার পরীক্ষা শুধু ভালো নয়, ইক্সট্রিমলি এক্সিলেন্ট হবার কথা।”
ছেলেটার মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি দেখতে পেল রুজী। একটু মাথা চুলকে সে বলল-“আমি চিট করিনি ম্যাম। প্রশ্ন কমন পড়েছিল সব।”
ইন্টারভিউ বোর্ডের সবাই চমকে উঠল তার কথায়। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা একটা ছেলে এতগুলো প্রফেসরের সামনে বসে অবলীলায় অপ্রাসঙ্গিক কিন্তু মোক্ষম একটা উত্তর দিয়েছে, এমন ঘটনা সচারচর দেখা যায় না।
আফসার উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন-“তুমি চিট করেছ এমন কথা তো আমরা বলিনি সাঈদ! এটা কেন বললে?”
“না মানে বাইরে আব্দুল চাচা বলছিল আপনারা ভাবছেন আমি চিট করেছি।”
মনে মনে আব্দুলের উপর রেগে গেলেন আফসার উদ্দিন। ইন্টারভিউ বোর্ডে কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল সেটা শিক্ষার্থীদের জানানো কোন ধরনের কান্ডজ্ঞানের মধ্যে পড়ে না।
রুজী আক্তার আবু সাঈদকে জিজ্ঞেস করল-“আচ্ছা আবু সাঈদ, একটা বিষয় আমি বুঝতে পারছি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্রে অন্তত ৭-৮ টা এমন প্রশ্ন থাকে, যেগুলো এইচএসসির সিলেবাস থেকে পরোক্ষভাবে নেয়া হয় বটে, তবে এইচএসসি পাশ করা কারো পক্ষে সেগুলোর উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। জানি এমসিকিউ প্রশ্নে অনুমান করে দাগালে অনেক সময় মিলে যায়, তুমি কি তেমন কিছু করেছ? নাকি জেনেশুনে উত্তর দিয়েছ?”
“জেনেশুনেই উত্তর দিয়েছি ম্যাম।”
“আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি পদার্থবিজ্ঞান অংশে ফুল মার্কস পেয়েছ। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে আমরা এমন দু’টো অংক দিয়েছিলাম যেগুলো আসলে মেকানিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর বই থেকে নেয়া। কাজেই এগুলোর উত্তর দেয়া প্রায় অসম্ভব। তোমাদের সিলেবাসের সাথে সামান্যই মিল আছে অংক দু’টোর।”
“জানি ম্যাম, অংক দু’টো ভি পি ভাসানদানির হিট ইঞ্জিনিয়ারিং বইটা থেকে নেওয়া হয়েছে। আমার বড় ভাই মেকানিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ছে। আমি তার বইগুলো মাঝে মধ্যে উল্টে পাল্টে দেখি।”
রুজীর মনে হলো, ছেলেটা কিছু লুকচ্ছে। সত্যি কথা বলছে না। কিন্তু তার আসলে কিছু করারও নেই। অংক দু’টো আসলেই ভাসানদানির বই থেকে নেয়া।
আফসার উদ্দিন জিজ্ঞেস করল-“তো আবু সাঈদ, তুমি তো ফার্স্ট হয়েছ। যে কোন সাবজেক্ট নিতে পারো। কি নিতে চাও?”
“ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি স্যার।”
“হোয়াট? ফার্স্ট সেকেন্ড হয়ে সবাই ফার্মেসি, এপ্লাইড ফিজিক্স, এপ্লাইড কেমিস্ট্রি, কম্পিউটার সায়েন্স এসব নিতে চায়, আর তুমি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিতে চাইছ? এত অসাধারণ রেজাল্ট করে? বলছি না এটা ভ্যালুলেস সাবজেক্ট কিন্তু খুব আনইউজুয়াল চয়েস নিঃসন্দেহে।”
“আমার জন্য এই সাবজেক্ট পড়া খুব জরুরী স্যার।”
আফসার উদ্দিন আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। রুজী আক্তার বলল-“ঠিক আছে, তুমি পাচ্ছ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি। এখন আসতে পারো।”
আবু সাঈদ ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো ইন্টারভিউ রুম থেকে। রুজী আক্তার ভ্রু কুঁচকে তার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। তার জীবনে দেখা সবচেয়ে অদ্ভুত ক্যান্ডিডেট ছিল ছেলেটা।
তবে কেউ জানল না যে আবু সাঈদ মিথ্যে বলেছিল। তার কোন বড় ভাই নেই যে মেকানিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ে। পিয়ন আব্দুলের সাথে পরীক্ষায় চিট করা নিয়ে কোন কথা হয়নি তার। সে আসলে সব জানত আগে থেকে, যে ভাবে জানত ভর্তি পরীক্ষায় কি কি প্রশ্ন আসবে, কোন কোন বই থেকে প্রশ্ন আসবে, সব।
দুই
বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটে গেছে তিনটে বছর। আবু সাঈদ আগের চেয়ে অনেক পরিণত এখন। পড়াশোনার চেয়ে সে আজকাল গবেষণা ধর্মী কাজ অনেক বেশি করে। তার আগ্রহ দেখে প্রফেসররা তাদের যে কোন ধরনের গবেষণার কাজে আবু সাঈদকে সঙ্গে রাখে। আবু সাঈদের জানার ইচ্ছে যেন অফুরন্ত। বইতে যা আছে, তা জেনেও আশ মেটে না তার। আরও জানার জন্য নিজেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বেড়ায়, তথ্য-উপাত্ত খুঁজে বেড়ায়। শিক্ষকরা প্রায়ই আবু সাঈদকে জিজ্ঞেস করে তার এই অনুসন্ধিৎসার কারণ কি। সে শুধু বলে, মানুষের মস্তিষ্কের একটি বিশেষ দিক সে জানতে চায়। কি জানতে চায় সেটা সে কখনো বলেনি।
এরই মধ্যে একদিন প্রেমে পড়ে সে। মেয়েটার নাম তিথি, তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্রী, তার দু’ বছর জুনিয়র। একদিন বলা নেই, কওয়া নেই, রাত সারে চারটায় তিথিকে ফোন করে আবু সাঈদ। বলে-
“খুব জরুরী কিছু বলতে চাই তোমাকে।”
তিথি ঘুম ভেঙে ভীত কণ্ঠে বলে, “কি হয়েছে তোমার? শরীর ঠিক আছে?”
“হ্যা, ঠিক থাকতে থাকতেই সব জানিয়ে যেতে চাই তোমাকে। আমার কিছু হলে আমার অসমাপ্ত গবেষণা তুমি শেষ করবে।”
“মানে কি বলতে চাইছ? কি হবে তোমার? কিসের গবেষণা?”
“কাল সকালে বলব সব। ইউনিভার্সিটির ক্যাফেতে দেখা করো যত সকালে পারো।”
দিনের আলো ফুটতেই তিথি বেরিয়ে পড়ল ইউনিভার্সিটির উদ্দেশে। সকাল সকাল ক্যাম্পাসে এখনো ছাত্র ছাত্রী তেমন আসেনি। ক্যাফে প্রায় ফাঁকা। এক কোণায় বসে একটা ছেলে সিগারেট খাচ্ছে, আরেক কোণায় বসে আছে আবু সাঈদ, তার সামনে আধখাওয়া চায়ের কাপ আর কিছু কাগজপত্র ছড়ানো ছিটানো।
ক্যাফেটা সারারাত খোলা থাকে। চালায় মন্টু মিয়া। সে তিথি-সাঈদকে ভালোভাবেই চেনে। তিথিকে দেখতেই চাপা এবং উদ্বিগ্ন কন্ঠে সে বলল- “আফা, রাত ৩ টা থেইকা ভাই বইসা আছে এইখানে। ডজন খানেক সিগারেট আর আট কাপ চা খাইছে এখন পর্যন্ত!”
তিথি কিছুটা উৎকণ্ঠিত হলো। বলল-“ঠিক আছে মন্টু ভাই, দেখছি। আমাকে এক কাপ চিনি ছাড়া চা দিও।”
তিথি গিয়ে আবু সাঈদের সামনের চেয়ারে বসে পড়ল। তিথির উপস্থিতি টের পেয়েও মুখ তুলে তাকাল না আবু সাঈদ। ছড়ানো ছিটানো কাগজের দিকে তাকিয়েই বলল-“আমাকে একটা জিনিস দিতে পারো তিথি?”
“কি জিনিস? বলো। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই দেব।”
“এন এন ডাইমিথাইল ট্রিপ্ট্যামিন।”
“সে কি! এটা তো বলতে গেলে এক ধরনের ড্রাগস।”
“নিঃসন্দেহে। তবে ল্যাবে তৈরি করা সম্ভব, কম্পাউন্ডগুলো ঠিকঠাকমতো জোগাড় করতে পারলে।”
“সেটা দিয়ে কি করবে তুমি?”
তিথির দিকে কিছু কাগজ বাড়িয়ে দিল আবু সাঈদ। “এই সমীকরণটা দেখছ? এটা হলো ভ্রমের সমীকরণ। এই সমীকরণের সমাধান এখনো আমি পাইনি। যেদিন পাব, সেদিন থেকে পৃথিবীর নতুন যুগ শুরু হবে। বুলিয়ান আলজেব্রার কিছু...”
“থিওরিটিক্যাল কথা শুনতে চাই না এখন সাঈদ। তোমাকে অপ্রকৃতস্থ দেখাছে আজ। কি হয়েছে খুলে বলবে?”
আবু সাঈদ কাগজগুলো সরিয়ে রাখল এক পাশে। প্রায় ঠান্ডা হয়ে আসা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভূমিকা ছাড়াই বলল-“আমার বয়স যখন ১৬ বছর, তখন একদিন চিটাগাং যাবার পথে ট্রেন থেকে পড়ে যাই আমি। চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাড়িয়ে প্রকৃতি দেখছিলাম, খেয়ালই করিনি পা একদম কিনারে চলে গেছে কখন। পড়ে গিয়ে ট্রেনের চাকা ঘেঁষে গড়াগড়ি খেতে খেতে কিছু দূর এগিয়ে যায় আমার শরীর। কোন ভাবে চাকার নিচে চলে গেলে কাটা পড়তাম! বয়স কম ছিল, প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। ভেবেছিলাম আজ ট্রেনে কাটা পড়ে মারাই যাব। কিন্তু গেলাম না। ঠিক তখনই অদ্ভুত কিছু দৃশ্য দেখি আমি। দেখি যে আমি আর আমিতে নেই, হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষের চেতনায় ঘুরপাক খাচ্ছি। দেখতে পাই, পৃথিবী ঘুরছে বন বন করে, আমি দু’হাতে আঁকড়ে ধরে আছি পৃথিবীটাকে। অল্প সময়ের কিছু হ্যালুসিনেশন, তারপর ঠিক হয়ে যায় সবকিছু। বাবা চেইন টেনে ট্রেন থামিয়েছিল। নেমে এসে আমাকে দাড় করায়। আমার তেমন কিছু হয়নি, কিছু ছোটখাটো কাটা ছেড়া ছাড়া। ধীরে ধীরে ঘটনাটা ভুলেই যাই আমি এবং সেই থেকেই শুরু হয় সবকিছুর।”
“সবকিছু বলতে?”
“বলছি। ঐ ঘটনার কয়েক মাস পরের কথা। আমাদের এলাকার একজন এমপির ছেলের বিয়ে ছিল সেদিন। এলাকারই একটা কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করল সে। সবাইকে দাওয়াত দিল সেখানে। আমিও গেলাম ফ্যামিলির সাথে। বিয়ের অনুষ্ঠানে খাওয়া দাওয়া চলছে, এমপি সাহেব আমাদের টেবিলেই বসেছিল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সবার সাথে গল্প করছিল। প্রাণখোলা মানুষ সে। বেশ মজা করে কথা বলত। খাওয়া দাওয়ার মাঝেই এমপির সাঙ্গপাঙ্গদের একজন এসে তাকে বলল-স্যার, আমার এক বন্ধু আপনার সাথে দেখা করতে চায়। বলছে খুব জরুরী। এমপি বলল-ঠিক আছে, এখানেই আসতে বলো। লোকটা চলে গিয়ে মোটা গোঁফওয়ালা একটা লোককে ডেকে আনল। লোকটা এমপির কানে কানে কি যেন বলতে চাইল। এমপি তার দিকে মাথাটা এগিয়ে দিতেই রিভলভার বের করে কানের উপর ঠেকিয়ে গুলি করল গোঁফওয়ালা লোকটা। তারপর আগের লোকটা সহ দু’জন দৌড়ে পালাল সেখান থেকে। এই পর্যন্ত ঘটনা ঘটার পর আমার সামনে দৃশ্যপট হঠাৎ করে বদলে গেল। সব কিছু উধাও হয়ে গেল ভোজবাজির মতো। দেখলাম আমি নিজের পড়ার ঘরে বসে আছি। মা খেতে ডাকছে। ভেবেছিলাম স্বপ্ন দেখেছি বুঝি। কিন্তু কিছুদিন পর সত্যিই সেই এমপির ছেলের বিয়ে ঠিক হলো, অনুষ্ঠান হলো সেই একই কমিউনিটি সেন্টারে। এলাকার সবাইকে দাওয়াতও দিল এমপি সাহেব। আমরা সবাই গেলাম। তারপর সেই টেবিল, আগের মতো এমপির সাথে বসে আমাদের খাওয়া দাওয়া। একসময় এমপির সেই সাঙ্গ এসে এমপিকে তার বন্ধুর সাথে কথা বলতে অনুরোধ করল। এ যেন দেজা ভ্যুঁ। স্মৃতির পুনরাবৃত্তি। এমপির বন্ধুর সাথে সেই গোঁফওয়ালা লোকটাকে আসতে দেখেই আমি উঠে দাড়ালাম, তারপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম, ঐ লোকটা এমপিকে খুন করতে চায়। তার কাছে পিস্তল আছে। মুহূর্তের মধ্যে এমপির বডিগার্ডরা ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার উপর। সে ধরা পড়ল। পরে সবাই যখন জানতে চাইল আমি কিভাবে জেনেছি গুঁফো লোকটার উদ্দেশ্য, আমি মিথ্যে বললাম। বললাম তার কোমরে গোঁজা পিস্তল দূর থেকে নজরে পড়েছে আমার।
ঘটনাগুলো এরপর ঘটতেই থাকে। সব ঘটনা নয়, তবে অনেক ঘটনাই আমার সাথে প্রথমে একবার ঘটে, সম্ভবত স্বপ্নে কিংবা হ্যালুসিনেশনে। তারপর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় বাস্তবে। যেমন ধরো ভর্তি পরীক্ষার ঘটনা। আসল ভর্তি পরীক্ষা দেবার কিছুদিন আগেই আমি হ্যালুসিনেশনে ভর্তি পরীক্ষা দেই, কাজেই আসল পরীক্ষায় কি কি আসবে আমার জানা ছিল। একইভাবে ইন্টারভিউ বোর্ডে কি কি জিজ্ঞেস করবে তাও জানা ছিল আমার। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে কোন ঘটনা যখন প্রথম বার আমার সাথে ঘটে, আমি বুঝতে পারি না যে ঘটনাটা আসলেই বাস্তবে ঘটছে না কল্পনায় ঘটছে। দ্বিতীয়বার ঘটলে নিশ্চিত হই। এই যেমন এখন আমি তোমার সাথে আদৌ কথা বলছি নাকি কল্পনা করছি, সেটা হলফ করে বলতে পারি না আমি। আমার সাইকোলজি নিয়ে পড়ার কারণও এসবই। যাই হোক, তুমি কি বিশ্বাস করছ আমার কথা তিথি?”
তিথি হা করে শুনছিল আবু সাঈদের কথা। সে থামতেই বলল-“নিশ্চয়ই সাঈদ। যদিও এটা বুঝতে পারছি না কেন কি হচ্ছে তোমার সাথে। আচ্ছা, এটা কি প্রিমনিশন? অনেক মানুষ বলে তাদের প্রিমনিশন হয়, মানে যে কোন সত্যিকার ঘটনা ঘটার আগে তারা পূর্বাভাস পায়। তোমার বিষয়টা কি তেমন?”
“হতে পারে। প্রিমনিশন কিন্তু অবৈজ্ঞানিক কিছু নয় তিথি। মানুষের মস্তিষ্ক প্রবাবিলিটির অংক করে চলে। অর্থাৎ কোন কাজের কতটুকু সম্ভাবনা, সেটা প্রবাবিলিটির সূত্র কষে বের করে মস্তিষ্ক। এটাকে বলে সিলেক্টিভ বায়াস। কারো কারো ক্ষেত্রে এই বায়াস অনেক শক্তিশালী হয়। বাস্তব জীবনের বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র ধরে, পিওর প্রবাবিলিটির অংক কষে বের করে ফেলে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ। মানুষ এটাকে বলে প্রিমনিশন। তবে আমার ধারণা, আমার সাথে যা হচ্ছে, সেটা প্রিমনেশনের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। অনেক গভীর কিছু।”
“কিন্তু তুমি ডিএমটি মানে এন এন ডাইমিথাইল ট্র্যিপ্ট্যামিন কেন চাইছিলে?”
“কারণ আমার ধারণা সেই ট্রেন দুর্ঘটনার সময় মস্তিষ্কের সহজাত নিয়মে ডিএমটি নিঃসৃত হয়েছিল আমার মগজে। তুমি বোধহয় জানো না যে ডিএমটি আমাদের মস্তিষ্কেই থাকে। নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্সের সময় মস্তিষ্ক থেকে সেটা নিঃসৃত হয়। তখন অদ্ভুত কিছু হ্যালুসিনেশন হয় মানুষের। একটা অদ্ভুত ঘটনা শুনেছিলাম যে আমেরিকার পাঁচ কিশোর-কিশোরী একবার ডিএমটি সেবন করেছিল, ড্রাগস হিসেবে। তারা এক ধরনের হ্যালুসিনেশন করে। দেখতে পায় যে একটা অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছে প্রত্যেকে, তাদের চারিদিকে কিছু এলিয়েন দাড়িয়ে তাদের শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। মজার ব্যাপার হলো, সবার আলাদা আলাদাভাবে দেয়া এলিয়েনের বর্ণনা পরস্পরের সাথে মিলে যায়। মানে একই হ্যালুসিনেশন একই সময়ে পাঁচজনের হয়েছিল। তাই অনেকের ধারণা, ডিএমটির সাথে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের কোন সম্পর্ক আছে। তবে আমার ধারণা, আমার মস্তিষ্কের এই প্রিমনিশন করার ক্ষমতা আর সেই ট্রেন দুর্ঘটনার সাথেও ডিএমটির সম্পর্ক রয়েছে। হতে পারে আমি কোন মস্ত বড় পরীক্ষার গিনিপিগ। কেউ আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে। অনেক বুদ্ধিমান কোন অস্তিত্ব।”
তিথি ঝিম মেরে বসে হজম করছে আবু সাঈদের কথাগুলো। অবিশ্বাস করলে কোন ঝামেলা থাকে না, কিন্তু বিশ্বাস করলেই সর্বনাশ! আর সে বিশ্বাস করে বসেছে আবু সাঈদের কথাগুলো।
তিন
কয়েক বছর পরের কথা।
ড. এমেট মরিয়ার্টি শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে সাইকোলজির প্রফেসর ছিলেন। তার বেশ কিছু গবেষণা আছে যেখানে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে প্রতিটি মানুষ আসলে পরস্পরের সাথে যুক্ত, তারা নিজেরাও সেটা জানে না। মানুষের ব্রেন কম্পিউটারের চেয়েও শক্তিশালী। কম্পিউটার যেভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত থাকে, মানুষের ব্রেনও সেভাবে পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকতে পারে। সে জন্য দরকার অনেক উঁচু মানের কিছু প্রযুক্তি এবং তার চেয়েও জটিল কিছু এলগরিদম। তিনি একটি সমীকরণের সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন দশ বছর ধরে। যেদিন তিনি সমাধান করতে পারবেন সমীকরণটির, সেদিন থেকে বদলে যেতে পারে মানুষের জীবনযাত্রার ধরণ।
কাজেই আবু সাঈদ নামের একজন বাঙালী ছাত্র যখন তার কাছে মেইল করে জানাল যে সেই সমীকরণটির সমাধান তার কাছে আছে এবং সমীকরণের শেষের কয়েকটা ধাপ তার কাছে পাঠাল, তখন তিনি নিজ উদ্যোগে, নিজ খরচে ছেলেটাকে শিকাগো নিয়ে আসার প্রস্তাব দিলেন।
আবু সাঈদ শিকাগো এলো, তবে একা নয়, তিথিকে নিয়ে এলো সঙ্গে। তারা দু’জন এক সাথে কাজ করেছে শেষ কিছু বছর। সমীকরণের সমাধান করা, ডাইমিথাইল ট্রিপ্ট্যামিন নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা, এই কাজগুলো করতে তার তিথির সহায়তার প্রয়োজন ছিল।
এক শীতের বিকেলে ড. এমেট মরিয়ার্টির বাড়ির বসার ঘরে বসে ডক্টরের জন্য অপেক্ষা করছিল সাঈদ আর তিথি। তিনি এলেন। দীর্ঘদেহী, গম্ভীর চেহারার লোক তিনি। তিথি আর আবু সাঈদকে দেখে আন্তরিক ভাবে হাসলেন। বললেন-“ওয়েলকাম টু শিকাগো। তোমাদের জন্যই গবেষণাটা আটকে ছিল আমাদের। পৃথিবীর নতুন একটি যুগ শুরু হতে যাচ্ছে আজকের পর থেকে।”
আবু সাঈদ উঠে দাড়িয়ে বলল-“হ্যালো ডক্টর মরিয়ার্টি। পরিচয় করিয়ে দেই, ও আমার সহকর্মী এবং...”
আবু সাঈদকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন-“ওর নাম তিথি, তোমার সহকর্মী এবং প্রেমিকা। তোমার নাম আবু সাঈদ। জার্নাল অফ ফিউচার স্টাডিজে মস্তিষ্কের উপর ডিএমটির প্রভাব নিয়ে তোমাদের আর্টিকেলটা আমি পড়েছি। তবে সেটা ছাড়াও আমি তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানি সাঈদ। ১৬ বছর বয়সে তোমার সাথে হওয়া ট্রেন দুর্ঘটনা, বিয়ের অনুষ্ঠানে তোমাদের এলাকার এক এমপিকে হত্যার ঘটনা...এসব আমি জানি।”
প্রচন্ড রকম বিস্মিত হলো আবু সাঈদ। সে এসব কথা ড. মরিয়ার্টিকে ইমেইলে বলেনি, কোনভাবেই এসব ঘটনা জানার কথা নয় তার।
“স্যার, আপনি কি করে এসব জানলেন? মেইলে তো...”
প্রাণখোলা হাসি হাসলেন মরিয়ার্টি। হাসতে হাসতেই বললেন-“তোমার কি ধারণা পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে টাইম লুপে পড়ে আছ? তুমি ছাড়া আরও ১২ জন মানুষ আছে পৃথিবীতে, যাদের সবার সাথে এই ধরনের ঘটনা বার বার ঘটে আসছে, বহুদিন থেকে। আমি তাদের একজন। আজকের এই আলোচনা আমাদের আগেও একবার হয়েছে। কাজেই আজকের আলোচনা হয়তো তোমার জন্য প্রথম বার, তবে আমার কাছে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি।”
আবু সাঈদ মাথা চুলকে বলল-“সেই ১২ জনের বাকীরা কোথায় আছে?”
“আছে সবাই শিকাগোতেই। চার বছর আগে ভারতের মাদ্রাজ থেকে বিশ্বনাথান কৃষ্ণ নামের এক নিউরোলজিস্ট আমার সাথে দেখা করে। ঘটনার পুনরাবৃত্তি তার জীবনেও ঘটে আসছে। সে একটি কৃত্রিম বায়োলজিক্যাল মস্তিষ্কের মডেল তৈরি করেছে মাদ্রাজে বসে গবেষণা করে করে। একইভাবে চীন থেকে লা জিং নামের এক কম্পিউটার বিজ্ঞানী দেখা করেছিল আমার সাথে। সেও ঘটনার পুনরাবৃত্তির শিকার। সে আবিষ্কার করেছে এক ধরনের কম্পিউটার এলগরিদম, যেটা মানুষের মস্তিষ্কের চিন্তা ভাবনাকে বাইনারি কোডে বদলে গ্রাফিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশন করতে সক্ষম। আবার রাশিয়া থেকে ভ্লদিমির উস্তাভ নামের এক ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মানুষের মস্তিষ্কের তরঙ্গকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন দিয়ে বদলে দেবার থিওরিটিক্যাল মডেল তৈরি করে এনেছিল। এভাবে চার বছরে ১১ জন মানুষ আসে আমার কাছে যারা সবাই টাইম লুপের শিকার এবং সবাই কিছু না কিছু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরি করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে। মজার ব্যাপার, এতগুলো আবিষ্কার থাকার পরও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরি করার কাজ থেমে ছিল এই সমীকরণের সমাধান না থাকার কারণে, যেটা তুমি নিয়ে এসেছ। সুতরাং এখন আর আমাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে কোন বাধা নেই।”
তিথির মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে মরিয়ার্টিকে জিজ্ঞেস করল-“কি ধরনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরি করার কথা বলছেন আপনি স্যার?”
“খুব শক্তিশালী একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক। যেটা সারা পৃথিবীর সব মানুষের মস্তিষ্ককে যুক্ত করে দিতে পারবে। আমাদের আর ইন্টারনেটের প্রয়োজন পড়বে না। ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক থেকে যে কেউ যে কারো কাছ থেকে তার সম্মতিক্রমে তথ্য আদান প্রদান করতে পারবে। শব্দ উচ্চারণ না করেও কথা বলতে পারবে মানুষ। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর কোথাও কোন অপরাধী কি অপরাধ করার প্ল্যান করছে, সেটা ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মুহূর্তে জেনে নিতে পারবে পুলিশ এবং এই অপরাধ ঠেকাতে তাদের কোন অস্ত্র শস্ত্রেরও প্রয়োজন হবে না, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ দিয়ে অপরাধীদের চিন্তাধারা বদলে দিলেই হবে।”
মরিয়ার্টির চোখ চকচক করছে আবিষ্কারের নেশায়। তিথি ইতস্তত করে বলল-“আপনি বলতে চাইছেন যে কেউ চাইলেই যে কারো চিন্তায় ঢুকে যেতে পারবে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে?”
“মোটেও না। শুধুমাত্র অথোরাইজড পার্সন কাজটা করতে পারবে, তাও উপযুক্ত কারণ থাকলে। আমরা এমন একটা নিউরাল কম্পিউটার তৈরি করব, যেটা সারা পৃথিবীর সব মানুষের মস্তিষ্কের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করবে। তারপর কোথাও কোন অপরাধ সংঘটিত হবার চেষ্টা হলে সেটা অথোরাইজড পার্সনদের জানাবে, তারা ব্যবস্থা নেবে। অথোরাইজড পার্সন ছাড়া কেউ কারো মগজে ঢুকতে পারবে না, তবে কোন মাধ্যম ছাড়াই যে কেউ যে কারো মস্তিষ্ক থেকে তথ্য আদান প্রদান করতে পারবে, যদি উভয়ের সম্মতি থাকে। কথা বলে বলে যে ভাবে তথ্য দেয়া সম্ভব, সে ভাবে কথা না বলে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভেতর তথ্য আদান প্রদানের প্রযুক্তি বলতে পারো এটাকে।”
“বুঝলাম। কিন্তু এই কম্পিউটার কি করে কাজ করবে? মানে একটা মানুষের মগজে কি চলছে না চলছে সেটা আরেকজন কি করে জানবে? কি করে একাধিক মস্তিষ্ককে একটা নেটওয়ার্কে যুক্ত করা সম্ভব?”
“দু’টো প্রযুক্তি কাজ করবে। প্রথমত মানুষের ব্রেনে বিভিন্ন ধরনের ওয়েভ কাজ করে। বিভিন্ন অনুভূতিতে, বিভিন্ন চিন্তায়, সব সময়েই ব্রেন ওয়েভ এক্টিভ থাকে। আর তুমি যদি বিজ্ঞানের ছাত্রী হও তাহলে নিশ্চয়ই জানো যে, যে কোন ওয়েভ, যে কোন তরঙ্গই তথ্য ধারণ করে থাকে। কাজেই আমাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক ব্রেন ফ্রিকোয়েন্সি থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। সেই সাথে রহস্যজনক কেমিক্যাল এন এন ডাইমিথাইল ট্রিপ্ট্যামিন এই নেটওয়ার্ককে সহযোগিতা করবে। আমরা গবেষণা করে দেখেছি একাধিক মস্তিষ্ককে পরস্পরের সাথে যুক্ত করতে ডিএমটি কাজ করে। তুমি নিশ্চয়ই সেই পাঁচ কিশোর-কিশোরীর কথা শুনেছ? আমেরিকার পাঁচ কিশোর-কিশোরী একবার ডিএমটি সেবন করে হ্যালুসিনেশন করেছিল। তারা দেখতে পায় যে একটা অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছে প্রত্যেকে, তাদের চারিদিকে কিছু এলিয়েন দাড়িয়ে তাদের শরীর পরীক্ষা করছে। সবার চিন্তা মিলে যায়। মানে তাদের মস্তিষ্কে ডিএমটি কাজ করেছিল, তাদের হ্যালুসিনেশনগুলোকে যুক্ত করে দিয়েছিল। ডিএমটি কিভাবে কাজ করে সেটা এখনও বিজ্ঞানীরা পরিষ্কারভাবে জানে না, কিন্তু আমরা এই ১২ জন এটা জানি যে, মেকানিজম যাই হোক, মানুষের মস্তিষ্কে থাকা ডিএমটির সহযোগিতার একাধিক মস্তিষ্ককে একটি অভিন্ন নেটওয়ার্কে যুক্ত করা সম্ভব।”
আবু সাঈদ কি যেন ভাবছিল। সে বলে উঠল-“একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমরা সবাই, এই ১৩ জন, যারা টাইম লুপের শিকার, তারা প্রত্যেকে কেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছি? কেনই বা আমাদের সাথে টাইম লুপের ব্যাপারটা ঘটছে?”
ড. মরিয়ার্টি মিটমিট করে হাসতে লাগলেন। জিজ্ঞেস করলেন-“তোমার কি ধারণা?”
“আমার ধারণা আমরা কোন বড় প্রজেক্টের একটা অংশ। কোন উন্নত প্রাণী আমাদের কোন কাজে ব্যবহার করছে।”
“ঠিক ধরেছ। সেই উন্নত প্রাণী কারা জানো? আমরা। তুমি, আমি আর বাকী ১১ জন। আমরাই ভবিষ্যতে ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি করে নিজেদের অতীতের মস্তিষ্কে ডাটা পাঠাব, ডিএমটির মাধ্যমে। তোমার সমীকরণই প্রমাণ করে সেটা করা সম্ভব। আমরাই অতীতের ‘আমাদের’কে বর্তমান ‘আমাদের’ জন্য তৈরি করব, যাতে করে একটি উন্নত ভবিষ্যৎ আমরা মানব সভ্যতাকে উপহার দিতে পারি।”
“মানে টাইম প্যারাডক্স?”
“হ্যা, টাইম প্যারাডক্স। অতীতের আমরা ভবিষ্যতের আমাদের সাহায্য ছাড়া এখানে আসতে পারতাম না, আবার ভবিষ্যতের আমরাও অতীতের আমাদের সাহায্য ছাড়া সামনে এগোতে পারব না। এটা একটা টাইম প্যারাডক্স। কোনটা শুরু কোনটা শেষ সেটা তুমি আলাদা করতে পারবে না।”
“ভেরি এমিউজিং। যাই হোক, আমরা ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ কখন থেকে শুরু করব?”
“আজ, এই মুহূর্ত থেকে। আমার সাথে ল্যাবে এসো তোমরা।”
আবু সাঈদ আর তিথি ড. এমেট মরিয়ার্টিকে অনুসরণ করতে লাগল।
চার
১০ বছর কেটে গেছে ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরির পর। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের উপর ভরসা করে চলে। পৃথিবীতে অপরাধের মাত্রা নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। ডিএমটি নিয়ে গবেষণা চলছে আজও বিজ্ঞানীদের মধ্যে।
ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের কিছু নেতিবাচক দিকও দেখা গেছে। যেমন কিছু মানুষ এই অনুভূতির সাথে মোটেও মানিয়ে নিতে পারছে না যে অতি বুদ্ধিমান একটা কম্পিউটার সারাক্ষণ তার মাথার ভেতর নজরদাড়ি করছে এবং সেটা ইচ্ছে করলেই তার মস্তিষ্কের যে কোন স্মৃতি, যে কোণ সিদ্ধান্ত মুহূর্তে পাল্টে দিতে পারবে। এই সব মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মনস্তাত্ত্বিক রোগ দেখা গেল। তবে এই ধরনের মানুষ সংখ্যায় মোটেও বেশি নয়।
আবু সাঈদ আর তিথি শিকাগোতেই থাকছে সেই থেকে। তারা বিয়ে করেছে, দু’টো ছেলেমেয়ে আছে তাদের। আবু সাঈদ শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। সেখানে ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের উপর নতুন একটা ডিসিপ্লিন খোলা হয়েছে। ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক চালাতে প্রচুর লোকবল প্রয়োজন হয়। সেই সব মানব সম্পদ তৈরির উদ্দেশ্যেই সরকার এই ডিসিপ্লিন খুলেছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে।
উইলিয়াম জোন নামের এক ছাত্র আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, খুবই বুদ্ধিমান ছাত্র। ১০ বছর আগে যে সমীকরণের সমাধান করেছিল আবু সাঈদ, সেটার একটা বিকল্প সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছিল সে, যেটা আগের সমাধানের চেয়েও তুলনামূলকভাবে সহজ এবং সংক্ষিপ্ত।
উইলিয়াম যেদিন সমাধানটা খুঁজে পেল, প্রায় উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলো সে আবু সাঈদের বাড়িতে। আবু সাঈদ উইলিয়ামের চোখে উদভ্রান্তের দৃষ্টি দেখেই বুঝতে পারল যে সে সমীকরণটির বিকল্প সমাধান খুঁজে পেয়েছে। বলল-“অভিনন্দন উইলিয়াম, জানতাম তুমি পারবে!”
উইলিয়াম সোফায় বসতে বসতে বলল-“কি করে জানতেন প্রফেসর? ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি হবার পর আপনার তো আর হ্যালুসিনেশন হবার কথা নয় যে ঘটনা ঘটার আগেই প্রিমনিশনের মাধ্যমে টের পেয়ে যাবেন।”
“না তা তো নয়ই। আমাদের হ্যালুসিনেশনের ডাটাগুলো আমরা ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরির বছরই অতীতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমাদের হ্যালুসিনেশনের প্রয়োজন ছিল অতীতে, বর্তমানে নয়। তাই এখন হ্যালুসিনেশন হবার প্রশ্নই আসে না।”
“কিন্তু প্রফেসর, আপনার মনে আছে যে আপনি বলেছিলেন আপনার প্রথম হ্যালুসিনেশন হয়েছিল ট্রেন থেকে পরে যাবার সময়, সেই হ্যালুসিনেশন নিশ্চয়ই ন্যাচারাল হ্যালুসিনেশন ছিল, সেটা নিশ্চয়ই ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অতীতে পাঠাননি?”
“না, তা পাঠাইনি। সেটা ন্যাচারালই ছিল। মৃত্যুর কাছাকাছি যে কোন অভিজ্ঞতা হলে সবার মস্তিষ্কেই ডাইমিথাইল ট্রেট্রামিন নিঃসৃত হয়, সেখান থেকে হয় হ্যালুসিনেশন। আমারও তাই হয়েছিল।”
এই কথাটা শুনে উত্তেজনায় উইলিয়াম উঠে দাড়াল। নিজের করা বিকল্প সমাধানের কাগজটা বাড়িয়ে দিল আবু সাঈদের দিকে। বলল-“কিন্তু ভ্রমের সমীকরণ অনুযায়ী, ডিএমটির কারণে যে হ্যালুসিনেশন হয়, সেটা তিনটা ধাপে সম্পন্ন হবে।”
“তিনটা ধাপে মানে?”
“মানে স্যার, স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন, তার ভেতর আরেকটা স্বপ্ন অনেকটা এরকম। হ্যালুসিনেশনের মধ্যে হ্যালুসিনেশন, তার ভেতরে আবার হ্যালুসিনেশন এভাবে। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটা ধাপে হয়েছে। আরও দু’টো ধাপ থাকার কথা। যেমন ট্রেন থেকে পড়ে দেখলেন যে আপনি হাজার হাজার মানুষের অস্তিত্বে ঘুরপাক খাচ্ছেন, পৃথিবীটাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরেছেন। সেটা ছিল প্রথম ধাপের হ্যালুসিনেশন। এর পরেই আপনি বাস্তব জগতে ফিরে গেলেন। কিন্তু সমীকরণ অনুযায়ী তখন দ্বিতীয় ধাপের হ্যালুসিনেশন শুরু হবার কথা, তারপর তৃতীয় ধাপ। অথচ আপনি সরাসরি রিয়েলিটিতে চলে এলেন।”
“হুম, তোমার সমীকরণ তাই বলছে বটে, কিন্তু কে জানে বাস্তব জগত আর হ্যালুসিনেশন জগতের পার্থক্য আসলেই কতটুকু! তুমি কি জানো যে মানুষের মস্তিষ্ক স্ক্যান করলে যে কোন সিদ্ধান্ত তৈরি হবার সাত সেকেন্ড আগে সেই ডিসিশনটা জানা যায়? মানে তুমি যে সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে নিচ্ছ, সেটা তোমার মস্তিষ্কে আগেই ছিল। সে হিসেবে রিয়েলিটি বলতে কিন্তু কিছু নেই, তুমি যা অনুভব করো, তাই তোমার কাছে রিয়েলিটি। আমি যা অনুভব করি, তা আমার কাছে রিয়েলিটি।”
“মানে আপনি অস্বীকার করতে চাইছেন বিষয়টা, তাই না স্যার?”
“কোন বিষয়টা?”
“হ্যালুসিনেশনের বিষয়টা। আপনি যখন ট্রেন থেকে পড়ে দেখলেন যে আপনি হাজার হাজার মানুষের অস্তিত্বে ঘুরপাক খাচ্ছেন সেটা ছিল প্রথম ধাপের হ্যালুসিনেশন। যখন দেখলেন আপনার বাবা ট্রেনের চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে আপনাকে মাটি থেকে তুলছেন, আপনি বাড়ি ফিরে গেলেন, সেটা ছিল দ্বিতীয় মাত্রার হ্যালুসিনেশন। এই দ্বিতীয় মাত্রার হ্যালুসিনেশনের মাঝে অসংখ্য ছোট ছোট হ্যালুসিনেশন হয়েছে আপনার, যেমন সেই এমপির খুনের ঘটনা, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, সেগুলো ছিল তৃতীয় মাত্রার হ্যালুসিনেশন। তাই নয় কি স্যার?”
“তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমি এখনো হ্যালুসিনেশনের ভেতর আছি? বাস্তবে নেই?”
“আমি না, সমীকরণ বলছে। আপনার বাস্তবের অস্তিত্ব হয়তো অন্য কোথাও আছে, অন্য কোন জগতে।”
“কোথায় সেটা?”
“আমি জানি না স্যার।”
উইলিয়াম চলে গেল, কিন্তু আবু সাঈদ এক ধরনের ঘোরের মধ্যে বসে রইল অনেকক্ষণ।
সেদিন বিকেলে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল সে। ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক ল্যাবে গিয়ে অনেক বছর আগের সেই ট্রেন দুর্ঘটনার ভিজুয়াল রিপ্রেজেন্টেশন করতে নির্দেশ দিল কম্পিউটারকে। সে আরেকবার জানতে চায় সেদিন আসলে কি হয়েছিল। সবগুলো হ্যালুসিনেশন শুরু হয়েছিল ঠিক কোথায়!
পাঁচ
একটা সুন্দর গ্রাম। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছ। টলমলে জলওয়ালা পুকুরে গাছের পাতা পড়ে হলুদ-সবুজ রঙের বর্ণালী তৈরি হয়েছে। একটু দূরে গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা একটা ছোট রেললাইন।
আবু সাঈদ রেল লাইন ধরে হাটতে লাগল। কিছুক্ষণ হাটতেই দেখতে পেল সে ট্রেনটাকে। ট্রেনটি ঠায় দাড়িয়ে আছে লাইনের উপর। অনেক মানুষ ভীর করেছে ট্রেনের পেছনের দিকে। জটলা বেঁধেছে কেন যেন। আবু সাঈদ জটলা ভেদ করে সামনে যেতে লাগল।
জটলার মাঝে এক মাঝবয়সী মানুষ ট্রেনের পাশে মাটিতে বসে বুক চাপরে গলা ছেড়ে কাঁদছে। তার কান্না দেখে আবু সাঈদের কষ্ট হলো বেশ। তারপর হঠাৎ করেই সে চমকে গেল ভীষণ ভাবে। মাঝবয়সী লোকটাকে চিনতে পেরেছে সে। লোকটা তার বাবা। তার সামনে ট্রেনে কাটা পড়া এক কিশোরের লাশ। আর দেখার সাহস হলো না আবু সাঈদের। সে জানে ঐ লাশ কার। সে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এল বহুদূর। তারপর বসে পড়ল রেল-লাইনের উপর।
এসবের মানে কি? সে কি সেইদিন রেল লাইনে কাটা পড়েই মারা গিয়েছিল? তারপর মারা যাবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই দীর্ঘ জীবনের হ্যালুসিনেশন করে গেছে?
সে জানে এটা সম্ভব। মানুষের মস্তিষ্ক অল্প সময়ের হ্যালুসিনেশনে, অল্প সময়ের স্বপ্নে অনেক দীর্ঘ সময়ের ঘটনা দেখতে পারে। ডাইমিথাইল ট্রিপ্ট্যামিন চিন্তার গতি বাড়িয়ে দেয় অনেক। কিন্তু সেক্ষেত্রে ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্কও নিশ্চয়ই একটা কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়! তাহলে...
আবু সাঈদ আর ভাবতে পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। আশেপাশে তাকালে সে দেখতে পেত যে রেল লাইনটা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে, যেভাবে পেন্সিলে আঁকা দৃশ্য মুছে দেয় কেউ। মুছে যাচ্ছে দূরের গাছপালা, টলমলে পুকুর, ছোট ছোট গ্রাম সব...।
দেখতে দেখতে একসময় কোথায় যেন সবকিছু মিলিয়ে গেল।
(সমাপ্ত)