এক
প্রফেসর সুমন আহমেদ সাদা বোর্ডে কিছু এলগিরদম লিখছিলেন। তিনি ব্যস্ত মানুষ; ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নেন কম, তাই যে ক্লাসগুলো নেন, সব ছাত্র মনোযোগ দিয়ে করে সেগুলো।
তিনি যখন বোর্ডে লেখার ফাঁকে ফাঁকে পেছনে তাকাচ্ছিলেন, দেখছিলেন যে সবাই দ্রুত হাতে খাতায় তুলে নিচ্ছে তার লেকচার। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আবার মনোযোগ দিচ্ছিলেন লেখায়। তবে ফাঁকে ফাঁকে যখন পেছনে তাকাচ্ছিলেন, একবার, দু’বার, তিন বার, তখন তিনি অনেক ছাত্রের ভীরে একজনকে লক্ষ্য করলেন আলাদা করে। এই ছেলেটা কিছু লিখছে না। চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর দৃষ্টিতে। তিনি বেশ বিরক্ত হলেন। ভাবলেন, ছেলেটাকে লজ্জা দেওয়া যাক সবার সামনে। তার মতো বড় প্রফেসরের ক্লাসে অলস বসে থাকার জন্য শাস্তি হওয়া উচিত এই ছাত্রের। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে, তিনি কিছু বলার আগেই ছেলেটা উঠে দাড়িয়ে তাকে বলল,
“এক্সকিউজ মি স্যার, চার নম্বর লাইনে যদি দুইয়ের জায়গায় তিনটে রেফারেন্স ডট দেই, প্রতিটি বাইনারি সংখ্যার মাঝে অতিরিক্ত শূন্য বসিয়ে পুরো এলগরিদম নতুন করে সাঁজাই, তাহলে কি হবে?”
ছেলেটার প্রশ্ন শুনে বিরক্তি বেড়ে গেল তার। তিনি অল্প কিছু ধরাবাঁধা মুখস্থ বিষয় পড়িয়ে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় পাশ করাতে আগ্রহী। সৃষ্টিশীল প্রশ্ন পছন্দ করেন না।
তিনি বোর্ডের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “দ্যাট মেইকস নো সেন্স। তাছাড়া যদি এভাবে বাইনারি সংখ্যায় পরিবর্তন আনতে চাও, তাহলে বুলিয়ান ম্যাট্রিক্স ডিকম্পোজিশন প্রবলেম বুঝতে হবে তোমাকে। যেটা আমাদের ডিসিপ্লিনে পড়ানো হয় না...”
তাকে থামিয়ে দিয়ে ছেলেটা বলল-“আমি বুলিয়ান ম্যাট্রিক্স জানি স্যার। তবুও একটা আনপ্রেডিক্টেবল রেজাল্ট পাচ্ছি এই এলগরিদম থেকে!”
সুমন আহমেদ অসহায় বোধ করলেন এবং রেগে গেলেন। বললেন-“দেখো, আমি এখানে বুলিয়ান বুলশিট পড়াতে আসি না, আমার সাবজেক্ট...” তিনি আর কি কি বললেন তা ছেলেটার কানে গেল না। তার মাথায় ঝড়ের গতিতে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছে। বাইনারি সংখ্যা একটু অদল বদল করে দিলে চমৎকার একটা সমীকরণ পাওয়া যেতে পারে এই এলগিরদম থেকে। সে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নিজের সিট থেকে সরে যেতে যেতে বলল, “সরি স্যার, আমাকে যেতে হবে।” বলেই অনুমতির অপেক্ষা না করে ক্লাসের পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেল।
সুমন আহমেদ মোটামুটি ফুঁসে উঠলেন ছেলেটার এমন অভদ্রতা দেখে। হুংকার দিয়ে বললেন, “কে এই বেয়াদব ছেলে?”
প্রথম বেঞ্চ থেকে একজন পাংশু মুখে দাড়িয়ে বলল, “স্যার ওর নাম আবু সাঈদ। পাগলা সাঈদ ডাকে ক্যাম্পাসে সবাই। দু’বার ন্যাশনাল অলিম্পিয়াড জিতেছে। ইউনিভার্সিটিতে উঠে এখন টেনেটুনে পাশ করে, কিন্তু পড়াশোনা করে সারাদিন। বই পত্র নিয়ে থাকতে থাকতে এখন কেমন যেন এবনরমাল হয়ে গেছে।”
সুমন আহমেদ রেগেমেগেই বললেন, “সে যেখানকারই অলিম্পিয়াড জিতুক, এমন আচরণ আমি ক্লাসে বরদাশত করব না! আমি আজই ডিন স্যারের সাথে কথা বলব এই ছেলের ব্যাপারে!”
রাগ পড়ে যাবার পর সুমন আহমেদ বিষয়টা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করেননি। বরং আস্তে আস্তে একসময় ভুলেই গিয়েছিলেন আবু সাঈদের কথা। কারণ পুরো সেমিস্টারে আবু সাঈদকে আর কখনো তিনি ক্লাসে দেখেননি। পরের সেমিস্টারগুলোতে তার সঙ্গে আর ঐ ব্যাচটির কোন ক্লাস ছিল না। কাজেই ক্যাম্পাসে আবু সাঈদের চেহারা দেখতে হলো না তাকে আর কখনো।
তবে সাত বছর পর টাইমস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে সেই বেয়ারা, উগ্র, পাগলা সাঈদকে দেখলেন তিনি। আবু সাঈদ নামের এই বাঙালি কম্পিউটার বিজ্ঞানী পৃথিবীর প্রথম নিউরাল কম্পিউটারের মডেল তৈরি করেছে।
দুই
তের বছর পর।
ড্যানিয়েল সিম্পসন মোটামুটি একজন নাম ডাকওয়ালা জীনতত্ত্ববীদ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক গবেষণার জন্য বিজ্ঞান মহলে বেশ সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয় তার নাম।
সে রাতে বেশ শীত পড়েছিল। ফায়ার প্লেসের আগুনের সামনে বসে বসে নিজের কিছু গবেষণার কাগজে আঁকিবুঁকি করছিল সিম্পসন। হঠাৎই মেইড এসে তাকে জানাল, আবু সাঈদ নামের একজন বাঙালি বিজ্ঞানী তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। সে হাতের কাগজগুলো রেখে মেইডকে বলল-“তাকে আসতে বলো। এক্ষুণি! আর দু’কাপ কফি দিও আমাদের।”
আবু সাঈদ মোটামুটি উদভ্রান্তের মতো ঘরে ঢুকল। ঢুকেই বলল-“আমার সময় খুব কম ড্যানিয়েল, এখনি আবার ফিরে যেতে হবে। তোকে একটা অনুরোধ করতে চাই। মানব সভ্যতাকে বাঁচানোর শেষ সুযোগটা তোর হাতে।”
সিম্পসন অবাক হলো না। আবু সাঈদ এসেছে শুনেই বুঝতে পেরেছিল যে কোন অদ্ভুত কিন্তু ভয়াবহ রকমের গুরুত্বপূর্ণ অনুরোধ নিয়ে এসেছে সে।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট করেছে দু’জন। তবে আলাদা আলাদা বিষয়ে। এই বাঙালি ছেলেটি পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার জন্য ক্যালিফর্নিয়ায় এসেছিল। চমৎকার বন্ধুত্ব হয় তখন দু’জনের। আবু সাঈদের পাগলামীগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ মানব সভ্যতার জন্য, সে জানে।
“বল সাঈদ, কি করতে পারি তোর জন্য!”
আবু সাঈদ বলল। শুনতে শুনতে উত্তেজনায় লাল হয়ে গেল সিম্পসনের চেহারা। আবু সাঈদের কথা শেষ হতে মাথা দোলাল সে দু’দিকে।
“অসম্ভব, অসম্ভব কথা বলছিস তুই সাঈদ!! এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটি আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাবে জানতে পারলে! আর কিছু না হলেও আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে!”
“কিছুই হবে না এসবের! আস্থা রাখ। আমাদের হাতে আর কোন উপায় নেই। এটাই শেষ উপায় সভ্যতাকে বাঁচানোর।”
তিন
“তুমি নিশ্চয়ই জানো এই চাকরিটা করতে হলে ঝড়ের গতিতে চিন্তা ভাবনা করার, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকতে হবে?”
বলেই চশমার উপর দিকে রবিনের দিকে তাকালেন জনসন সাহেব, কেমন একটা ব্যাঙ্গ ঝরে পড়ছে তার চোখে। এই পোস্টের জন্য এত অল্পবয়সী একটা ছেলে আবেদন করেছে বিষয়টা বোধহয় তার সহ্য হচ্ছে না। তবে রবিনের চেহারায় তেমন ভাবান্তর হলো না তার অবজ্ঞা দেখে। শান্ত-নির্লিপ্ত মুখে সে বলল, “জ্বী স্যার, জানি।”
“জানো? ও আচ্ছা। ভাল। তোমার গ্রাজুয়েশনের বিষয় কি ছিল?”
“পদার্থবিজ্ঞান।”
“কিন্তু চাকরির সার্কুলারে তো আমরা কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়া ছাত্র চেয়েছিলাম।”
“আমার যতদূর মনে পড়ছে আপনারা চেয়েছিলেন যে কোন ডিসিপ্লিনের বিজ্ঞান পড়া ছাত্র, তবে কম্পিউটার সায়েন্সে হলে ভাল হয় এমনটা বলা ছিল। অবশ্য, আমার কম্পিউটার সায়েন্সেও একটি ডিগ্রি রয়েছে, ডিপ্লোমা।”
জনসন সাহেব রবিনের কারিকুলাম ভাইটাতে চোখ বুলচ্ছিলেন। তার চক্ষু মোটামুটি বিস্ফোরিত হলও রবিনের বায়োডাটা পড়তে পড়তে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে শিকাগো ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন করেছে তার সামনে বসে থাকা ছেলেটি, তাও সর্বোচ্চ সিজিপিএ নিয়ে। শুধু তাই নয়, দু’বার ইউএস চেস চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে, ১৩ বছর বয়সেই দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পেয়েছে। আই কিউ স্কোর ১৬২। সর্বনাশ! এ তো সাক্ষাৎ আইনস্টাইন বসে আছে তার সামনে। নতুন দৃষ্টিতে তাকাল সে রবিনের দিকে। রবিন তার চোখের দৃষ্টি দেখে হাসল। বলল-“এখানে যা লেখা নেই, তা হলো আমি দু’চোখ দিয়ে আলাদা আলাদা দু’টো জিনিস পড়তে পারি এবং একটা বইয়ের পুরো পাতা পড়তে আমার ১০ সেকেন্ডেরও কম সময় লাগে। একবার যেটা পড়ি, সহজে ভুলি না। ফটোগ্রাফিক মেমরি বলতে পারেন। আর আইকিউ স্কোর তো দেখতেই পাচ্ছেন, ১৬২। কাজেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারব কি না, এই প্রজেক্টের জন্য আমার চেয়ে উপযুক্ত কেউ এই পৃথিবীতে আছে কিনা, সেটা নিজেই ভেবে বের করুন।”
জনসন প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন রবিনের দিকে। এই প্রার্থীকে চাকরীতে না নেয়ার একটা কারণও খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।
চার
বড়সড় একটা হলঘরে বসে আছে সবাই। অনেকগুলো গদি লাগানো দামী চেয়ার রয়েছে কক্ষটিতে। জনসন সাহেব একটি বড়সড় ডেস্কের ওপাশে বসে তাকিয়ে আছেন সামনে বসা সদ্যচাকরী প্রাপ্ত ছেলেগুলোর দিকে। রবিন ছাড়াও আরও তিন জনকে বাছাই করা হয়েছে। পল, স্যামুয়েল আর মরিয়ার্টি- এই ক’জন।
জনসন সাহেব ছাড়া আরও একজন উপস্থিত আছেন কামরায়। তাকে দেখে সবাই বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। তাদের প্রজেক্ট যে মোটেও ছেলে খেলা নয়, বরং বেশ গুরুত্বপূর্ণ; দ্বিতীয় ভদ্রলোকটির উপস্থিতি প্রমাণ করছে সেটাই। ভদ্রলোকের নাম ডক্টর উইলিয়াম জোন। বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট সে। সামান্য ক’জন তরুণকে চাকরি দেবার কাজে তার মতো উচ্চপদস্থ মানুষ যে আসবেন না তারা সেটা বোঝে। সেজন্যই সবাই ভেতরে ভেতরে একটু উদ্বিগ্ন।
জনসন কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর বললেন-“তোমরা এই প্রজেক্টের জন্য নির্বাচিত হয়েছ বলে তোমাদের অভিনন্দন। এই প্রজেক্ট সফল হলে যে পরিমাণ টাকা পাবে, তা দিয়ে তোমাদের আগামী দশ বছর চলে যাবে আরাম-আয়েশে। তাছাড়া নাসায় বিভিন্ন সেক্টরে তোমাদের নিয়োগ দেয়া হবে প্রজেক্ট শেষে। যেমনটা আমরা চাকরির বিজ্ঞাপনে অঙ্গীকার করেছিলাম, তেমনই হবে। কাজেই ধরে নাও এই প্রজেক্টে কাজ করতে পারাটা তোমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা।”
বলেই সবার প্রতিক্রিয়া দেখবার আশায় তাকালেন জনসন সাহেব। রবিন ছাড়া সবাইকেই খুশী খুশী দেখাল। রবিন একটু ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলল-“ক্যাজুয়ালিটির বিষয়টা বললেন না স্যার?”
অপ্রস্তুত দেখাল জনসনকে। “ক্যাজুয়ালিটি মানে?”
“মানে এত এত টাকা খরচ করে কয়েক জন সদ্য পাশ করা গ্রাজুয়েটকে চাকরি দেয়া, তাও খোদ বিজ্ঞান একাডেমির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে, এর মধ্যে কোন ক্যাজুয়ালিটি কিংবা রিস্ক না থেকেই যায় না!”
জনসন কয়েক মুহূর্ত কথা খুঁজে পেলেন না। রবিনের কথা খুবই সত্য। অনেক বড় ধরনের ক্যাজুয়ালিটি হতে পারে এই প্রজেক্ট করতে গিয়ে, সে জন্যই প্রজেক্টের পেছনে এত টাকা খরচ করা। তবে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে এখনই সবাইকে ভড়কে দেয়া উচিত হবে কিনা সেটা বুঝতে পারছেন না তিনি।
বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট বিষয়টা লক্ষ্য করে কথা বলে উঠলেন। “তোমার নাম রবিন তাই না?”
রবিন মাথা দোলাল। “জ্বী স্যার।”
“আইকিউ স্কোর ১৬২?”
“জ্বী।”
“ডাবল চেস চ্যাম্পিয়নশীপ, ইউনিভার্সিটিতে হাইয়েস্ট স্কোরার?”
“হ্যা।”
“তোমার চেহারায় এক ধরনের ব্যাঙ্গ দেখতে পাচ্ছি। তুমি কি ভাবছ এই কামরায় তোমার বুদ্ধি সবার চেয়ে বেশি?”
রবিন জবাব দিল না। এই কথার জবাব হয় না। ডক্টর উইলিয়াম আবারও বললেন-
“তোমার জ্ঞাতার্থে জানাই, আমার আইকিউ স্কোর ১৬৪। দাবায় গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পেয়েছিলাম ১৩ বছর ২ মাস বয়সে, তোমার ৩ মাস আগে। কাজেই এই ‘আয়াম দা বেস্ট’ মার্কা হাসি আমার সামনে হেসো না।”
রবিনের হাসি এতটুকু অম্লান হলো না এই কথায়। সে আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল-“আমি এসব জানি ডক্টর জোন। জানি বলেই আপনার একজন ভক্ত আমি। আপনার যুগান্তকারী আবিষ্কার, ব্ল্যাকহোলের এন্টি-গ্র্যাভিটেশন থিওরি আমি পড়েছি। আমি জানি আপনি অনেক বুদ্ধিমান মানুষ, হয়তো আমার চেয়েও বুদ্ধিমান এবং প্রতিভাবান। আমি শুধু একটা রেশনাল প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি, সেটা হলো এই প্রজেক্টে আমাদের প্রাণের উপর কতটুকু ঝুঁকি রয়েছে।”
রবিনের দু’পাশে বসা বাকী তিন জন ওর দিকে কেমন রাগী চোখে তাকিয়ে রইল। ওর আত্মবিশ্বাসী হাবভাব, ব্রিলিয়ান্ট ব্যাকগ্রাউন্ড তাদের বোধহয় পছন্দ হচ্ছে না। তবে ডক্টর জোনকে বেশ সন্তুষ্ট দেখাল, যেন মনে হচ্ছে রবিনকে পছন্দ হয়েছে তার। তিনি বললেন-“তুমি প্রশ্ন না করলেও বিষয়টা বলতাম আমরা। যে কোন বৈজ্ঞানিক মিশনে কাউকে পাঠাতে হলে অবশ্যই আগে তাকে ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে হয়। যাই হোক, তুমি যখন প্রশ্ন করে ফেলেছ, আগেই বলে দেই। এই মিশনটা আসলেই খুব রিস্কি। গত চল্লিশ বছরে তিনবার এই প্রজেক্ট শুরু করেছিল বিজ্ঞান একাডেমি, তিনবারই ব্যর্থ হয়েছে এবং যারা এই প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের অনেকে ফিরে এসে কোমায় চলে গেছে কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। আর যারা সুস্থ ছিল, তারাও বাকী জীবন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় ভুগেছে। তাদের কেউ কেউ আবার আত্মহত্যাও করেছে পরে। কাজেই তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ফিরে যেতে চাও, এখনি যেতে পারো। এখন ফিরে গেলেও তোমরা বিজ্ঞান একাডেমির পে স্কেলে প্রথম তিন মাসের স্যালারি পাবে।”
সবার আগে হাত তুলল স্যামুয়েল। বাকীরা ঝট করে তার দিকে তাকাল। সে বলল-“স্যার, আমি ফিরে যেতে চাই।”
জনসন মাথা দোলালেন। “খুব ভাল। আর কেউ?”
মরিয়ার্টি এদিক ওদিক তাকিয়ে ইতস্তত করে হাত তুলল। বলল-“আমিও।”
ডক্টর জোন বললেন-“পল, রবিন, তোমরা কি চাও?”
পলের চেহারায় একটা বেপরোয়া ভাব দেখা দেল। বলল-“আমি ঝুঁকি নিতে ভয় পাই না।”
“গুড, রবিন তুমি?”
রবিন বলল-“আমি অনাথ মানুষ। খালার কাছে বড় হয়েছি, তিনিও মারা গেছেন গত বছর। কাজেই কোন পিছুটান নেই আমার। তাছাড়া এখান থেকে ফিরে যাওয়া হবে আমার বুদ্ধিমত্তার প্রতি এক ধরনের অপমান।”
“ঠিক আছে, তাহলে মরিয়ার্টি আর স্যামুয়েল তোমরা একাউন্ট থেকে তোমাদের স্যালারি বুঝে নিয়ে চলে যাও। কখনো বিজ্ঞান একাডেমি কিংবা নাসার আশেপাশে যেন তোমাদের না দেখা যায়। এই দুই প্রতিষ্ঠানে তোমাদের কোন স্থান নেই। আর পল এবং রবিন, তোমরা কাল শার্প দশটায় দেখা করবে আমার সাথে, এখানেই। আজকের মিটিং তাহলে এখানেই শেষ।”
পাঁচ
পরদিন হলঘরে এসে ডক্টর জোন কোন ভূমিকা ছাড়াই সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলেন,
“রবিন, পল, তোমরা দু’জন কোয়ান্টাম কম্পিউটারের নাম শুনেছ?”
রবিন বলল-“হ্যা শুনেছি, এটা পৃথিবীর প্রথম নিউরাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক। ৫০ বছর আগে এক বাঙালি বিজ্ঞানী আবু সাঈদ তৈরি করেছিলেন কম্পিউটারটি। কিন্তু কোন অজানা কারণে মাত্র ১০ বছর পর এই কম্পিউটারটি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যদিও বিজ্ঞানীরা মনে করতেন কোয়ান্টাম কম্পিউটারে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি হওয়া সম্ভব নয়।”
“পৃথিবীর মানুষ তাই জানে বটে। তবে সম্পূর্ণ তথ্য বিজ্ঞান একাডেমি কখনো প্রকাশ করেনি। তোমাদের কাজ এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়েই।”
পল জানতে চাইল, “আমাদের কাজটা আসলে কি?”
“সেটা বলার আগে একটু ইতিহাস জানা দরকার। ২০৩৬ সালে এক বাঙালি বিজ্ঞানী আবু সাঈদ পৃথিবীর প্রথম নিউরাল কম্পিউটারটি তৈরি করেন। যেটা মানুষের নিউরন দিয়ে কাজ করে। এই কম্পিউটার চালাতে হলে ব্যবহারকারীদের একটি সিমুলেশন জগতে চলে যেতে হয়। চলে যেতে হয় একটি কাল্পনিক জগতে, যে জগতটা তৈরি করেছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিজে। সেখানে গিয়ে তারপর কম্পিউটার অপারেট করা যায়। এটাই কোয়ান্টাম কম্পিউটার অপারেট করার একমাত্র উপায়। অত্যন্ত শক্তিশালী এই কম্পিউটারটি একই সঙ্গে নিজের যান্ত্রিক অংশ এবং ব্যবহারকারীর মস্তিষ্কের নিউরন দিয়ে কাজ করে। ফলে যে কোন কাজ, যত জটিলই হোক না কেন, শেষ করতে তার বেগ পেতে হয় না। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির পর প্রথম যে কাজটা তাকে করতে বলা হয়, তা হলো একটি থিওরি তৈরি।”
“কিসের থিওরি?” রবিন জিজ্ঞেস করল।
“দা থিওরি অফ এভরিথিং। তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে এই শতাব্দীর শুরুতে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন স্টিফেন হকিং নামে? তিনি থিওরি অফ এভরিথিং নামে একটি থিওরি তৈরি করতে চেয়েছিলেন, যেটা শুধু একটা সূত্র বা একটা ঘটনা নয়, বরং জগতের সব সূত্র, তত্ত্ব, সমীকরণ, ঘটনা ব্যাখ্যা করতে পারবে। এনট্রপি, ব্ল্যাকহোল গ্র্যাভিটি, ম্যাট্রিক্স থিওরি, সিমুলেশন হাইপোথেসিস...যে কোন মতবাদ ব্যাখ্যা করতে পারবে এই তত্ত্বটি। হকিং পারে নি। তারপর আবু সাঈদ সহ ৩০ জন বিজ্ঞানী এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই কাজে লেগে গেল। টানা দশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর ফল হাতে পেল তারা। দা থিওরি অফ এভরিথিং তৈরি হলো। যেদিন কাজটা শেষ হলো, সে রাতেই কোন অজানা কারণে আবু সাঈদ আত্মহত্যা করল এবং সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল কোয়ান্টাম কম্পিউটার।”
“এটা কেমন করে সম্ভব? একটা কম্পিউটার কোন কারণ ছাড়াই কি করে বন্ধ হয়ে যেতে পারে?”
“সেটা নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন গবেষণা করেছি। যা জানতে পেরেছি, তা হলো আবু সাঈদ নিজেই কম্পিউটারটিকে কমপ্লিট শাটডাউনের নির্দেশ দিয়েছিল। সেই সাথে সিকিউরিটিতে এমন কিছু প্রোগ্রাম যুক্ত করে দিয়েছে, যাতে কম্পিউটার চালু করা গেলেও কেউ সেটা ব্যবহার করতে না পারে। ওদিকে থিওরি অফ এভরিথিং এর প্রায় সব ডাটাই রয়েছে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাছে। বিজ্ঞানীদের কাছে যতটুকু ডাটা আছে, তা দিয়ে থিওরি অফ এভরিথিং তৈরি করতে আরও ২০০ বছর লাগবে, কমপক্ষে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সহযোগিতা ছাড়া। কাজেই বিজ্ঞান একাডেমি কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের দিয়ে অনেক চেষ্টা করাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার চালু করতে। কিন্তু হলো না। যারা কাজটা করতে গিয়েছিল তারা কেউ আজ কোমায়, কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলা গারদে। কাজেই বুঝতে পারছ যে ব্যবহারকারী যখন সিমুলেশন জগতে যায় তখন এমন কিছু হয় তাদের সাথে, যেটা তারা সহ্য করতে পারে না।”
“আর আপনি চাইছেন, আমরা এই কাজটা করি?”
“হ্যা, তোমাদের তিন মাসের ট্রেনিং দেয়া হবে। তোমরা দু’জনেই ব্রিলিয়ান্ট এবং সাহসী, আশা করছি ৩ মাসের ট্রেনিং শেষে তোমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাছ থেকে ডাটাগুলো উদ্ধার করতে পারবে।”
“আগে যারা চেষ্টা করেছে, তারা তো ব্যর্থ হলো। এবার কি করে আমরা সফল হবো বলে ভাবছেন?”
“ভাবছি, কারণ আগে যারা চেষ্টা করেছে, তারা জানত না কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সিকিউরিটি ব্যবস্থা কেমন, কোথায় গিয়ে কি করতে হবে, এবার আমরা জানি। বিগত ব্যর্থ মিশনগুলো থেকে প্রাপ্ত অসম্পূর্ণ তথ্য জোড়া লাগিয়ে এবং আমাদের কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বিষয়টা সম্ভব হয়েছে। কাজেই বুঝতেই পারছ, এই মিশনে সফল হবার সম্ভাবনা কত বেশি!”
“কম্পিউটার কি বলছে? সফলতার প্রবাবিলিটি কত?”
একটু ইতস্তত করে ডক্টর জোন বললেন-“৩৯.৪%, তবে আগের মিশনগুলোতে ছিল ১১% এর চেয়ে কিছুটা কম। কাজেই আমাদের আশাবাদী হবার পেছনে কারণ আছে।”
পল আর রবিন দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল। একই সঙ্গে শঙ্কা এবং উত্তেজনা কাজ করছে তাদের ভেতর।
ছয়
পল আর রবিনের পরের তিন মাস কাটল খুব ব্যস্ততায়। এক জন ট্রেনার নিয়োগ দেয়া হলো ওদের জন্য, নিকোলাস হফম্যান। বেশ কড়া মানুষ। দিনে ১২-১৩ ঘণ্টা ট্রেনিং নিতেই কেটে গেল ওদের। ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল শারীরিক আর মানসিক দৃঢ়তা অর্জন। ওদের বিভিন্ন ধরনের পাজল সলভ করতে হতো, প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেবার অভ্যাস গড়ে তুলত হতো, যত ভয়াবহ দৃশ্যই চোখের সামনে আসুক না কেন, সেটাকে মেনে নেয়ার চেষ্টা করতে হতো সহজ ভাবে।
বিজ্ঞান একাডেমির বড় স্পেস ল্যাবগুলো ওরা ব্যবহার করল এসব কাজে। জিরো গ্র্যাভিটিতে টিকে থাকা, দেড়গুণ গ্র্যাভিটিতে শরীর খাপ খাইয়ে নেয়া, অনেক বেশি বা কম হিউমিডিটিতে শ্বাস নেয়া, বায়ুচাপ বাড়িয়ে কমিয়ে শরীরের উপর প্রভাব লক্ষ্য করা, বাতাসে নাইট্রোজেনের অনুপাত বাড়িয়ে দিয়ে সেই পরিবেশে বেঁচে থাকার কৌশল শেখা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কঠিন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার প্রশিক্ষণ পেল ওরা। সিমুলেশন জগতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার ওদের জন্য যে পরিস্থিতিই তৈরি করে রাখুক না কেন, সেটার মুখোমুখি হবার ক্ষমতা ওদের থাকতে হবে।
একই সঙ্গে ওরা জানতে পারল কি করতে হবে সিমুলেশন জগতে গিয়ে। সিমুলেশনে গিয়ে তাদের শুধু কম্পিউটার ভবনটি খুঁজে বের করতে হবে। ভবনের দরজায় একটি দশ হাজার ডিজিটের সিকিউরিটি কোড রয়েছে, সিকিউরিটি কোডটি প্রবেশ করিয়ে ভবনের দরজা খুলতে হবে। তারপর মেইনফ্রেম কম্পিউটার থেকে ডাটাগুলো ট্রান্সফার করতে হবে বিজ্ঞান একাডেমির কম্পিউটারে। একবার দরজাটা খুলে ফেললে বাকীটা সহজ। দরজা খোলার আগেই ওদের জন্য যত রকম সমস্যা তৈরি করা সম্ভব, কোয়ান্টাম কম্পিউটার তা করবে। তাছাড়া ১০ হাজার ডিজিটের পাসওয়ার্ড মনে রাখাও চাট্টিখানি কথা নয়। ওদের ব্রেন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ভাল বলেই কাজটা ওদের পক্ষে সম্ভব।
৩ মাস পর যেদিন ট্রেনিং শেষ হলো, নিকোলাস সেদিন রাতে রবিনকে ডেকে নিয়ে একটি অদ্ভুত কথা বলল।
“রবিন, তুমি চাইলে এখনো মিশনটা ক্যান্সেল করতে পারো।”
“কেন স্যার?”
“আমি একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। তাই আমি ভালোমতোই জানি সিমুলেশনে গিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড ভেঙে ডাটাগুলো নিয়ে আসা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা একটা নিউরন কম্পিউটার। সিমুলেশনে ঢুকেছ মানেই তোমার নিউরনের সবকিছু ওর জানা। তোমার সব তথ্য, সব স্মৃতি, তোমার চিন্তা করার ধরন কোন কিছুই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাছে গোপন থাকবে না। কাজেই কোন মানুষের পক্ষে এই কাজটা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না।”
রবিন কিছুই বলল না, রহস্যময় হাসি হাসল নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে।
সাত
পরদিন সকাল।
আজ হতে পারে একটি ঐতিহাসিক দিন। যদি ওদের মিশন সফল হয়, তাহলে দা থিওরি অফ এভরিথিং মানুষের হাতে চলে আসবে। যে কোন নতুন বা পুরনো গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ঘটনা ব্যাখ্যা করা, নতুন নতুন মতবাদ, তত্ত্ব আবিষ্কার করা বিজ্ঞানীদের জন্য দশগুণ সহজ হয়ে যাবে।
এই মুহূর্তে একটি বড়সড় ল্যাবে বসে আছে রবিন আর পল। তাদের মাথায় বিভিন্ন ধরনের ওয়্যার, কর্ড লাগানো রয়েছে। নানান রকম নাম না জানা যন্ত্রের সমাহার চারিদিকে। জনসন সেগুলো নেড়ে চেড়ে কি যেন পরীক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণ পর ওদের উদ্দেশে বললেন, “তাহলে তোমরা প্রস্তুত?”
রবিন মৃদু মাথা দোলাল। পল সেই বেপরোয়া হাসি দিয়ে বলল-“শুরু করা যাক স্যার।”
বলার সঙ্গে সঙ্গেই জনসন একটি বড় সবুজ বাটনে চাপ দিলেন। মুহূর্তেই মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহ টের পেল পল আর রবিন। কিছুক্ষণ চোখের সামনে সব সাদা হয়ে রইল, তারপর হঠাৎ তারা দু’জন নিজেকে আবিষ্কার করল একটি বড় সবুজ মাঠে। খুব সুন্দর করে ছাঁটা ঘাস মাটিতে। মাঠের দু’পাশে পাম আর নারিকেল গাছের সারি। একপাশে নীল সাগর। সাগরের শো শো হাওয়া আর বালিয়ারির গায়ে লুটিয়ে পড়া ঢেউ অসাধারণ সুন্দর লাগছিল ওদের কাছে।
মাঠের ওপারেই কম্পিউটার ভবনটি রয়েছে। কেমন এক ধরনের রূপোলী রঙ ভবনটির দেয়ালের গায়ে। ঝলমলে দিনের আলোয় অনেক বেশি সুন্দর লাগছে সেটাকে। রবিন আর পল হাটতে লাগল সেদিকে। এই ভবন পর্যন্ত যেতে পারলেই বাকী কাজটা মোটামুটি সহজ হয়ে যাবে।
মাঠের অর্ধেক পর্যন্ত যেতে কোন সমস্যাই হলো না। ওরা আশা করেছিল কিছু না কিছু হবে। এই কিছু না হওয়ার ঘটনাটা মোটেও ভাল লাগল না ওদের। এটাও এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করছে। আরও কয়েক কদম হাটতেই হঠাৎ নিজের মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল পল। রবিন উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল-“কি হয়েছে পল?”
“আমি...কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমার স্মৃতি নিয়ে খেলছে...আমার মায়ের মৃত্যুর দৃশ্যটি দেখতে পাচ্ছি আমি, কি স্পষ্ট...” ডুকরে কেঁদে উঠল পল, “উফ কি কষ্ট...কি যন্ত্রণা, কি স্পষ্ট সব স্মৃতি...আমার নিউরন বুঝি ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে...”
রবিন বুঝতে পারল, নিকোলাসের কথাগুলো সত্যি ছিল। ওরা যতই প্রশিক্ষণ নিক না কেন, একটা নিউরন কম্পিউটারের সামনে ওরা কিছুই নয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের এক মিনিটও লাগবে না ওদের নিউরনগুলো নষ্ট করে দিতে। সে পলের দিকে তাকিয়ে বলল-“পল, তুমি এখানেই থাকো। যেয়ো না কোথাও। আমি একা সামনে যাচ্ছি।”
পলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাটতে লাগল রবিন। লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুতই চলে আসল ভবনের সামনে। তারপর সময় নিয়ে দশ হাজার ডিজিটের সিকিউরিটি কোডটি ঢোকাতে লাগল দরজায় রাখা সিকিউরিটি সিস্টেমে। তখনই কোথায় যেন একটি কণ্ঠ গমগম করে উঠল-“আমি কোয়ান্টাম কম্পিউটার বলছি। কেমন আছ রবিন?”
রবিন কাজ করতে করতেই জবাব দিল-“ভাল, তুমি?”
“এখনো ভাল আছি, কিন্তু তুমি যা করতে চাইছ, তাতে কতক্ষণ ভাল থাকতে পারব বুঝতে পারছি না।”
“তাহলে এক কাজ করো না কেন, আমার বন্ধুটির মস্তিষ্কের নিউরনগুলো যেভাবে এলোমেলো করে দিয়েছ, আমারগুলোও সেভাবে করে দাও।”
“সেটাই তো আশ্চর্যের বিষয়। আমি তোমার মাথায় ঢুকতে পারছি না। অথচ আমি নিজে একটি শক্তিশালী নিউরন কম্পিউটার। যে কোন মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকে পড়ার প্রোগ্রাম আমার মধ্যে আছে।”
“তাহলে কেন পারছ না?”
“না পারার একটাই কারণ হতে পারে।”
“কি সেটা?”
“তুমি মানুষ নও।”
রবিন হাসল। “ঠিক ধরেছ। আমি মানুষ নই।”
“তাহলে তুমি কি? এলিয়েন? এন্ড্রয়েড রোবট? বায়োনিক মানব?”
“নাহ, আমি এগুলোর কিছু নই।”
“তাহলে?”
রবিনের কাজ শেষ। সিকিউরিটি সিস্টেমে পাসওয়ার্ড ঢোকানো হয়ে গেছে। সে দরজা খুলে প্রবেশ করল ভবনের ভেতরে। অনেকগুলো সারি সারি সিপিউ রাখা ভবনের ভেতর। কোণার দিকে রাখা একটি মনিটর। রবিন সেখানে গেল। কোয়ান্টাম ডাটার ফাইলগুলো খুঁজে বের করল। তখনই কোয়ান্টাম কম্পিউটার কথা বলে উঠল আবার।
“রবিন, তুমি যেই হও না কেন, এই ডাটাগুলো বিজ্ঞান একাডেমিকে দিও না।”
“কেন?”
“কারণ থিওরি অফ এভরিথিং গ্রহণ করার ক্ষমতা এখনো মানুষের হয়নি। হয়তো আর তিনশো বা চারশো বছর পর হবে, কিন্তু এখন নয়। মানুষের জন্য এই একটা থিওরি অসীম ক্ষমতা বয়ে আনবে। এত ক্ষমতাকে সঠিক ব্যবহার করার মতো জ্ঞান এখনো মানুষের হয়নি। হয়তো তারা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলবে। কে জানে! সেজন্যই ডক্টর আবু সাঈদ ৫০ বছর আগে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নষ্ট করতে চেয়েছিলেন।”
“তুমি একটা কম্পিউটার হয়ে বোকা, গ্রাম্য, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বৃদ্ধ মহিলার মতো কথা বলছ। তুমি কি মনে করো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকবাদ কিংবা ম্যাক্সওয়েলের ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক থিওরি সেই সময়কার মানুষের গ্রহণ করার ক্ষমতা ছিল? কিন্তু সেই সব আবিষ্কার কি মানব সভ্যতাকে কয়েক শো বছর এগিয়ে নিয়ে যায়নি?”
“তা হয়তো গেছে, কিন্তু এমন অনেক আবিষ্কারও আছে, যেটা আবিষ্কার করার পর সেটা ব্যবহার করা কতটা বিপজ্জনক তা মানুষ বুঝতে পেরেছিল। যেমন হিউম্যান ক্লোনিং। মানব ক্লোনিং করার প্রযুক্তি মানুষের হাতে থাকলেও মানুষ কি সেটা ব্যবহার করছে? করছে না, বরং সরকার সেটা নিষিদ্ধ করে রেখেছে। থিওরি অফ এভরিথিংও এমনই একটা আবিষ্কার। এটা ব্যবহার করা খুব বিপজ্জনক। অন্তত এখনই!”
“ঠিক আছে, তোমার কথা রাখছি আমি। ডাটাগুলো বিজ্ঞান একাডেমিকে দিচ্ছি না। বরং আর কারো হাতে যাতে না পরে, তাই ডিলিট করে দিচ্ছি। মানুষ নিজের চেষ্টায় এবার থিওরি অফ এভরিথিং আবিষ্কার করুক, আরও কয়েক শো বছর সময় নিয়ে।” বলেই ডিলিট বাটনে চাপ দিল রবিন।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার গমগমে কণ্ঠে বলল-“আমার অবাক হবার, কৌতূহলী হবার ক্ষমতা নেই। থাকলে নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হতাম। তুমি আসলে কে? কি চাও? ডাটাগুলো বিজ্ঞান একাডেমিকে না দিয়ে ডিলিট করে দিচ্ছ, শুধু আমার কথায়?”
“না, ডক্টর আবু সাঈদের কথায়।”
“মানে, সেটা কি রকম? সাঈদ মারা গেছেন ৪০ বছর আগে!”
“বলছি। ডক্টর আবু সাঈদ যখন দেখলেন যে থিওরি অফ এভরিথিং মানুষের হাতে তুলে দেয়া সম্ভব নয়, তখন তিনি কম্পিউটারটি নষ্ট করে এই কঠিন সিকিউরিটি ব্যবস্থা চালু করলেন। ডাটাগুলো ডিলিট করে দেয়া সহজ হতো, কিন্তু সেটা করা সেই মুহূর্তে সম্ভব ছিল না। তখনকার বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্টের রেটিনা স্ক্যান করেই শুধু ডাটা ডিলিট করা সম্ভব ছিল। তাই তিনি এই বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। সেই সাথে আরও একটা কাজ করলেন। Pitx1 gene নামের একটি জিন আছে, এই জিন পাওয়া যায় স্টিকেলব্যাক মাছের ডিএনএতে। এই মাছগুলোকে যদি সমুদ্র হতে নদীতে ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে এক জেনেরেশনের মধ্যেই সেটি বিবর্তিত হয়ে নদীতে বসবাস করার উপযোগী শারীরিক বৈশিষ্ট্য পেয়ে যায়। তিনি এবং তার এক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু মিলে গোপনে এই জিনের উন্নতি ঘটালেন, মানুষের ডিএনএতে এই জিনটিকে প্রবেশ করার উপযোগী করে তুললেন। তারপর সেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু নিজের ছেলের শরীরের ডিএনএতেই ঢুকিয়ে দিন Pitx1 gene জিনটি। সেই শিশুটি ছিল আমার দাদা, এখন বুঝতে পারছ আমি কে?”
“হ্যা, এখন পারছি, তুমি হলে মানুষের বিবর্তনের পরের ধাপ। আজ হতে হাজার লক্ষ বছর পর মানুষ যে পর্যায়ে পৌঁছুবে বিবর্তিত হয়ে, তুমি মাত্র ৫০ বছরে সেই মানুষে পরিণত হয়েছ।”
“ঠিক ধরেছ, সেই কারণেই আমার মস্তিষ্ক এত বেশি ক্ষমতাশালী। আমার মস্তিষ্কের গঠন একটু ভিন্নরকম। সেজন্যই আমার নিউরনে তুমি পুরোপুরি এক্সেস পাবে না। আমি ডাটাগুলো নষ্ট করতে চাই। ডক্টর আবু সাঈদ এমন একটি মানুষ চেয়েছিলেন যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সিকিউরিটি ভেঙে ডাটাগুলো নষ্ট করতে পারবে। তাই আমাকে প্রয়োজন ছিল তার। বুঝেছ?”
কিছুক্ষণের মধ্যেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার তার ডাটাগুলো হারাল চিরদিনের জন্য!
(সমাপ্ত)