অনন্যা মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল- “ঐ দেখ শালা রনি আসছে।”
রনিকে না দেখে আমি ধূমপানরত অনন্যাকে দেখতে লাগলাম। অনন্যার কথা বার্তা একদম ছেলেদের মতো। নির্দ্বিধায় সে যে কোন স্ল্যাং ব্যবহার করতে পারে, রাস্তার মানুষকে পরোয়া না করে প্রকাশ্যে সিগারেট খেতে পারে, ছেলেদের সাথে চলে যেতে পারে যে কোন জায়গায়। নিজেই নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে ইউনিভার্সিটিতে আসা যাওয়া করে রোজ। তবে তাই বলে টমবয়দের মতো পুরুষালী জামা কাপড় পরে না, বরং রূপচর্চার ব্যাপারে বেশ সচেতনই বলা যায় তাকে। এসব কারণে অনন্যাকে দেখে আমি অবাক হই। আচার আচরণে বড়লোকের উগ্র মেয়ে বলে মনে হয় তাকে। অথচ পরীক্ষায় অবিশ্বাস্য রকম ভালো রেজাল্ট করে প্রতিবছর।
আমাদের সাথে শাওনও ছিল। শাওন বলল-“রনির দিকে তাকালে কেমন গা শিরশির করে। ব্যাটার চোখগুলো এত বেশি ঠান্ডা কেন বুঝি না! একদম সাপের চোখের মতো ঠান্ডা চোখ।”
কথাটা সত্য। রনির চোখগুলো অনেক বেশ অনুভূতিহীন, অনেক বেশি শীতল। রনির আচার আচরণও স্বাভাবিক নয়। তার কোন বন্ধু নেই ক্যাম্পাসে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথেই কোন কথা বলে না। স্যারদের সাথেও না। মাঝে মাঝে যখন বলে, তখনও তার কন্ঠ শুনে বেশ অস্বস্তি লাগে। গলার স্বর কেমন যেন ফ্যসফ্যাসে তার। খুব অদ্ভুত শোনায়। মনে হয় কোথাও যেন টায়ার সসসস...শব্দে পাংচার হয়েছে। রনি কারো কাছ থেকে নোটও নেয় না। ওর ফোন নম্বরও আমাদের কারো কাছে নেই। অবশ্য ওর হাতে কখনো ফোন দেখিনি আমরা। ব্যবহার করে কিনা কে জানে।
রনি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবার সময় অনন্যা ওকে বলল-“এই রনি, বিড়ি খাবি?”
রনি আমাদের দিকে তাকাল না। যেন দেখেইনি, শোনেনি কিছু। হাটতে লাগল যেমন হাটছিল। শাওন বলল-“শালা ফ্রিক একটা!”
রনি চলে যেতে আমি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম-“ছেলেটার বোধহয় সমস্যা আছে কোথাও। প্রথম প্রথম মনে করতাম মানসিক প্রতিবন্ধী। এতদিনে বুঝে গেছি তা নয়।। হয়তো ফ্যামিলি প্রবলেম।”
শাওন একমত হলো। “হতে পারে। তাই বলে এমন ফ্রিক হয়ে থাকার কি দরকার বুঝি না!”
অনন্যা বলে উঠল-“ও থাকে কোথায় বলতো?”
আমি ঠোঁট উল্টালাম। “কি জানি। ১৪ নম্বর বাসে উঠতে দেখেছি। শহরের ও মাথায় কোথাও থাকে বোধহয়।”
“ফলো করি চল!”
“কেন? কি দরকার?”
“একটা ফ্রিক আমাদের সাথে দু’তিন বছর ধরে পড়াশোনা করছে একই ক্লাসে, সে কোথায় থাকে না থাকে জানা উচিত।”
“আমার কোন ইচ্ছে নেই জানার। তোরা গেলে যা।”
শাওন বলল-“হাতে কোন কাজ নেই। যাওয়াই যায়। পেছন পেছন গিয়ে দেখে আসি কোথায় থাকে ব্যাটা।”
জনমত বেশি যাবার পক্ষে। কাজেই অনন্যার গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। শাওন বসল ড্রাইভিং সিটে।
ক্যাম্পাসের সামনে বাসের জন্য দাড়িয়ে আছে রনি। বাস আসতেই উঠে পড়ল। আমরা যেতে লাগলাম বাসের পেছনে পেছনে।
লোকাল বাসকে ফলো করার ঝামেলা আছে। বাস একটু পর পর থেমে যায়। পিল পিল করে মানুষ ওঠে। কে নামছে, কে উঠছে আলাদা করে বোঝা যায় না। কাজেই আমাদের বেশ সতর্ক হতে হলো।
বাস লাস্ট স্টপেজে এসে যাবার পরও যখন রনিকে নামতে দেখলাম না, তখন সন্দেহ হলো আমাদের। জিজ্ঞেস করলাম- “রনি কি আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নেমে পড়েছে কোথাও?”
অনন্যা মাথা নাড়ল-“উহু, আমি ভালো মতো দেখেছি। নামেনি কোথাও। বাসেই আছে এখনো।”
অনন্যার কথাই সত্য হলো। একটু পর নেমে এলো রনি বাস থেকে। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে আরেকটা বাসের দিকে গেল। শাওন বেশ অবাক হলো-“রনি শহরের বাইরে থাকে নাকি?”
সম্ভবত তাই। রনিকে একটা দূরপাল্লার বাসে উঠতে দেখলাম। রনি ওঠার পরপরই বাস ছেড়ে দিল। আমিও বেশ আগ্রহী হলাম এবার। শাওনকে বললাম-“ইন্টারেস্টিং। ফলো কর। থামিস না। এসেছি যখন আজ দেখেই যাব ওর বাসা কোথায়।”
দূর পাল্লার বাস শহর ছেরে দূরে চলে এলো, ছুটতে লাগল দুর্বার গতিতে। পেছন পেছন যেতে লাগলাম আমরা।
ঘণ্টাখানেক চলার পর হঠাৎ একটা নির্জন জায়গায় এসে বাস থেমে গেল। থেমে গেলাম আমরাও। রনিকে নামতে দেখলাম।
জায়গাটা অনেক নির্জন। ধারে কাছে দোকানপাট-লোকবসতি দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার একপাশে ধানক্ষেত, আরেক দিকে জঙ্গলমতো জায়গা। এ জায়গায় রনি নামল দেখে বিস্ময়ের সীমা রইল না।
“ব্যাটা তো আমাদের দেখে ফেলল!”
শাওনের কথা শুনে রনির চোখের দিকে তাকালাম। ঠান্ডা চোখে আমাদের গাড়িটা দেখছে সে। না দেখার কোন কারণও নেই। নির্জন রাস্তায় একটা মাত্র গাড়ি দাড়িয়ে আছে। এতদিন ধরে দেখছে যখন, গাড়িটা যে অনন্যার সেটা বুঝতে না পারার কোন কারণ নেই। তবে বুঝতে পারলেও কোন অস্থিরতা দেখতে পেলাম না তার মধ্যে। সে ধীরপায়ে রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে জঙ্গলের দিকে হাটা দিল।
আমরা বাইরে বেরিয়ে এলাম তাড়াতাড়ি। আমি ডাক দিলাম-“রনি, এই রনি, শুনে যা।”
বরাবরের মতো আমাদের অগ্রাহ্য করে হাটতে লাগল সে। আমরা পেছন পেছন গেলাম। রনিকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখে বললাম-“আর যাওয়া কি ঠিক হবে?”
অনন্যা বলল-“কেন হবে না! রনি যেতে পারলে আমরাও পারব।”
“রনির কি মতলব তাই তো বুঝতে পারছি না। গিয়ে আবার কি না কি বিপদে...”
“শত হলেও রনি আমাদের ক্লাসমেট। তার কাছ থেকে আর যাই হোক, বিপদ আশা করছি না আমি।” বলেই হনহন করে অবলীলায় জঙ্গলে ঢুকে গেল অনন্যা। অগত্যা আমি আর শাওনও পিছু নিলাম।
জঙ্গলের যত ভেতরের দিকে যাচ্ছি, রনির হাটার গতি ততো বাড়ছে। রীতিমতো গা ছমছম করতে লাগল আমার। জঙ্গলটা যে খুব ঘন তা নয়। তবে অবাক হবার মতো বিষয়, জঙ্গলের ভেতরে কিংবা আশেপাশে তেমন কোন মানুষ দেখতে পাচ্ছি না।
একটু হাটার পর অনন্যা বলল-“আমার গা চুলকাচ্ছে খুব। তোদেরও কি এমন হচ্ছে?”
ওর কথায় টের পেলাম, আসলেই গা কেমন যেন চুলকাচ্ছে। খুব গরমে মোটা সোয়েটার পরে থাকার মতো অনুভূতি হচ্ছে। শাওনকে দেখলাম বেশ জোরে জোরে গায়ে হাত বুলাচ্ছে। বুঝতে পারলাম ওরও একই অনুভূতি হচ্ছে। তবে সামনে রনিকে বেশ স্বাভাবিকভাবেই হেটে যেতে দেখলাম। আমি একটু ভীত কন্ঠে বললাম-“ফিরে যাবি নাকি ভেবে দেখ?”
কেউ উত্তর দেবার আগেই রনি থেমে গেল। থেমে গেলাম আমরাও। রনি আমাদের দিকে তাকাল না। পেছন ফিরেই দাড়িয়ে রইল। তারপর কাঁধ থেকে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলল। টি শার্টটা মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে খুলে ফেলে ছুড়ে দিল দূরে।
অনন্যা ফিসফিস করে বলল-“কি করছে সে?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম-“জানি না!”
শাওন কিছুওই বলল না। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ সে।
রনি উদম গায়ে দাড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর অবশিষ্ট জামা কাপড়গুলো খুলে ফেলতে লাগল এক এক করে। আঁতকে উঠলাম আমরা। আমাদের দিকে একবারও না তাকিয়ে সম্পূর্ণ দিগম্বর হয়ে গেল সে। তারপর হাটুতে মুখ গুঁজে বসে পড়ল।
আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। রনি কি করছে সে সম্পর্কে কোন ধারণা নেই কারও।
একটু সামনে কাদা-পানিওয়ালা জলার মতো একটা জায়গা। রনি সেটাতে নেমে পড়ল। দু’ হাত দিয়ে কাদা মাখতে লাগল শরীরে। হাতে, পায়ে, নাকে, মুখে...দেখতে দেখতে কাদার মূর্তির মতো হয়ে গেল রনির শরীর। তারপরই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটল। রনির শরীরের কাঁদা খসে পড়তে লাগল এক এক করে। হাত-পা-মুখ, শত শত কাদার পিন্ড হয়ে মাটিতে খসে পড়ল রনি। ওভাবেই তার শরীরের টুকরোগুলো পড়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে নড়তে লাগল টুকরোগুলো, কাঁপতে লাগল। দেখতে দেখতে কালো কালো বড় বড় মাকড়সার মতো হয়ে গেল কাঁদার পিন্ডগুলো। কিলবিল কিলবিল করে হাটতে লাগল। উর্ধবশ্বাসে দৌড় দিলাম আমরা।
বেশিদূর যেতে পারলাম না। একটু দৌড়ানোর পরই হঠাৎ পড়ে গেল শাওন। আমি হাত ধরে শাওনকে ওঠাতে যাব, অমনি আমাকে ধাক্কা দিলে সরিয়ে দিল সে। বলতে লাগল-“আমার সারা গা চুলকাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে সারা গা...” মাটিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে শার্টটা ছিড়ে ফেলল সে গা থেকে। তারপর দৌড়ে চলে গেল; রনি যে ডোবাটাতে নেমেছিল, সেদিকে।
অনন্যা কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে গলায় আমার দিকে তাকিয়ে বলল-“তোর চোখ লাল কেন?”
আমিও অন্যন্যার চোখে দিকে তাকিয়ে ভড়কে গেলাম। তার চোখ থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। “তোর চোখও তো...”
শেষ করতে পারলাম না কথাটা। সবকিছু কেমন ঝাপসা হতে লাগল। প্যানারমা ক্যামেরার মতো চোখের দৃষ্টি কেমন আঁকাবাঁকা, বিক্ষিপ্ত হতে লাগল আমার...
*** *** ***
পরদিন ক্লাসে গিয়ে আমরা রনির পেছনের বেঞ্চে বসলাম। কারো সাথে কথা বললাম না। যখন বলার চেষ্টা করলাম, কেমন যেন ফ্যাসফ্যাসে শোনাল নিজেদের গলা। শাওন আর অনন্যার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওদের চোখগুলো একদম শান্ত, শীতল, সাপের মতো ভাবলেশহীন, নিস্পলক। আমি জানি, আমার চোখগুলোও ওদের মতো হয়ে গেছে।
এই সিরিজের অন্য গল্পগুলো-
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ ব্যাঙমানবী
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ শয়তানবিদ্যা
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ অবসেশন
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ আয়না-ভীতি
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ কুকুরের ডাক