ড. আবু সাঈদ চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে দোকানীকে জিজ্ঞেস করলেন- "চায়ের দাম কত?"
দোকানী অবাক হবার ভান করে চোখ কপালে তুলে বলল‚ "এইটা আপনি কি কইলেন স্যার? আপনার মতো বিখ্যাত মাইনষের কাছ থেইকা চায়ের দাম নিমু? আপনি ভাবতে পারলেন?"
আবু সাঈদ বিব্রত বোধ করলেন। তিনি যে বিখ্যাত সেটা ফুটপাতে বসা চায়ের দোকানদারের জানার কথা না। কারণ বিখ্যাত মানুষ দু' ধরনের হয়। এক- যারা সাধারণ মানুষের কাছে বিখ্যাত। দুই- যারা বিখ্যাত মানুষদের কাছে বিখ্যাত। আবু সাঈদ সম্ভবত দ্বিতীয় ধরনের মানুষ। একটা মেডিকেল কলেজের এনাটমি ডিপার্টমেন্টের হেড তিনি। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি আছে তার‚ দেশী-বিদেশী বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের সাথে বিভিন্ন গবেষণা করার সুযোগ হয়েছে ‚ বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং জ্ঞানী-গুনী মানুষ সবাই তাকে চেনে। সে হিসেবে হয়তো তিনি বিখ্যাত। কিন্তু তাই বলে রাস্তায় নামলে তাকে ঘিরে ভীড় জমে যাবে‚ এমনটা আশা করেন না তিনি।
অপ্রস্তুত গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ "আপনি আমাকে চেনেন?"
"হ স্যার‚ আপনি তো আবু সাঈদ সাব‚ ঢাকা মেডিকেলে পড়ান!"
আবু সাঈদ এবার কিছুটা অনুমান করতে পারলেন। হয়তো কোনদিন তার কোন ছাত্র চা খেতে খেতে দোকানীকে বলেছে- "এই যে দেখতে পাচ্ছ মোটাসোটা ভদ্রলোক‚ উনি ঢাকা মেডিকেলের টিচার। অসম্ভব জ্ঞানী আর বিখ্যাত মানুষ..."
জোরাজুরি করা আবু সাঈদের ধাতে নেই। তিনি দাম না দিয়ে চুপচাপ চায়ের কাপ রেখে উঠে পড়লেন। আজকের মতো মর্নিং ওয়াক শেষ‚ ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।
ঘরের উদ্দেশে হাটতে লাগলেন তিনি। বনশ্রীর নিরিবিলি একটা জায়গায় তার বাড়ি। বিশাল বাড়িতে থাকেন একাই‚ বিয়ে থা করেননি।
আনমনে হাটতে হাটতে হঠাৎ চমকে উঠলেন। পাশ ফিরে দেখলেন দু'টো কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে নিজেদের মধ্যে লড়ছে। কুকুর দু'টোর মঝখানে একটা হাড্ডি। হাড্ডির দখল আদায় করতেই তারা লড়ে যাচ্ছে। আবু সাঈদ কিছুটা কৌতূহলী হলেন। কারণ হাড্ডিটার আকার দেখে মনে হচ্ছে সেটা গরু-ছাগলের নয়‚ মানুষের। আশেপাশে কোন কবরস্থান নেই‚ এখানে মানুষের হাড্ডি কোথা থেকে আসবে! অবশ্য এমন হতে পারে যে কুকুর দু'টো কোন দূরের কবর থেকে নিয়ে এসেছে হাড়টা।
কুকুর দু'টোর লড়াই শেষ। কালো রঙের কুকুরটি বিজয়ী হয়েছে। বাদামী রঙের কুকুরটি একপাশে সরে এসে গড়গড় আওয়াজ করছে নিচু স্বরে। কালো কুকুরটি হাড্ডিটা মুখে তুলতেই অদ্ভূত একটা ঘটনা ঘটল। যেন বিষ ছুয়েছে‚ এমন ভাব করে লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল কালো কুকুর। তারপর কুইই করে লেজ গুটিয়ে পালাল। তার পিছু নিল বাদামী কুকুর। বেশ অবাক হলেন আবু সাঈদ। কুকুর দু'টো দূরে চলে যেতে হাড্ডিটা উঠিয়ে হাতে নিলেন। হালকা বাঁকানো‚ লম্বাটে হাড্ডি। একটা মাথা হাতুড়ির মতো। দেখেই চিনে ফেললেন‚ এটা ফিমার‚ মানুষের উরুর অস্থি।
হঠাৎ একটা অদ্ভূত সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। ঠিক করলেন হাড্ডিটা ঢাকা মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগে দিয়ে পরীক্ষা করাবেন‚ জানার চেষ্টা করবেন কতদিন আগে এই হাড্ডির মালিক মারা গিয়েছে। কুকুর দু'টোর অদ্ভূত আচরণের জন্য নয়‚ পরীক্ষা করাবেন কারণ তার কাছে মনে হচ্ছে হাড্ডিটার মধ্যে অশুভ কিছু আছে। তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নন‚ তবে নিজের ইনটিউশনকে খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকেন প্রায়ই।
*** *** ***
ফরেনসিক এক্সপার্ট ড. হুমায়ূন কবির খুব মিশুক মানুষ নন। অল্পতেই বিরক্ত হওয়া তার বিশেষ স্বভাব। কাজেই আবু সাঈদ যখন তাকে একটা বেওয়ারিশ হাড্ডির ফরেনসিক এনালাইসিস করতে বললেন‚ তখন মোটেও প্রীত হলেন না তিনি। অফিসিয়াল কাজ করেই কূল পাওয়া যায় না‚ তার উপর উটকো অনুরোধ। তারপরও কাজটা করতে রাজি হলেন শুধুমাত্র আবু সাঈদের নামডাকের কারণেই। তার মতো গুরুত্বপূর্ণ‚ খ্যাতিমান মানুষের অনুরোধ চট করে ফেলে দেয়া যায় না। তবে হুমায়ূন কবির তেমন গরজ নিয়েও করলেন না কাজটা। আজ করব‚ কাল করব বলে রেখে দিলেন। আবু সাঈদও তাগাদা দিলেন না।
একমাস পর যখন কাজটায় হাত দিলেন‚ ভয়াবহ রকমের অবাক হলেন হুমায়ূন কবির। বুঝতে পারলেন আরো আগেই কাজটা করা উচিত ছিল। আবু সাঈদকে খবর দিতে গিয়ে দেখলেন‚ তিনি দেশে নেই। সুইৎজারল্যান্ড গিয়েছেন কি একটা সেমিনারে এটেন্ড করতে। ফিরবেন ৬ দিন পর। তিনি সাথে সাথে আবু সাঈদকে ইমেইল করলেন। কোন ফর্মাল লেখা নয়‚ সোজাসাপ্টা ভাষায় এক লাইনের ইমেইল-
"Sir‚ I analysed the bone. It's damn weird!"
আবু সাঈদ মেইল পেয়ে ৬ দিনের জায়গায় ৩ দিনের মাথায় দেশে ফিরলেন। সেদিন শুক্রবার সকাল‚ এয়ারপোর্ট থেকে আবু সাঈদ সরাসরি হুমায়ূন কবিরের বাসায় হাজির হলেন।
হুমায়ূন কবিরের বাসাটা বেশ বড় আর ছিমছাম। বাড়ির পেছনে খোলামেলা বাগান রয়েছে। বারান্দায় বসলে ঝিরিঝিরি হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যায়। স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন তিনি।
বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে ধোয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হুমায়ূন কবির বললেন-
"স্যার‚ এই হাড়টার আগামাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।"
"বুঝিয়ে বলুন।" নিজের চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন ড. আবু সাঈদ।
"বলছি।" লম্বা দম নিলেন হুমায়ূন কবির। "হাড়টার সব কিছু ঠিক ঠাক‚ কিন্তু ভূতুড়ে বিষয় হলো হাড়টার বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।"
"সম্ভব হয়নি? ব্যাখ্যা করুন প্লীজ।"
"হাড়ের বয়স নির্ধারণ করার জন্য আমি কার্বন ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। কিন্তু কার্বন ডেটিং করতে গিয়ে বুঝলাম যে ভয়াবহ রকমের একটা অসামঞ্জস্য আছে হাড়টাতে। অসামঞ্জস্যটা কি সেটা বুঝতে হলে আপনাকে কার্বন ডেটিং প্রসেসটা বুঝতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই ধারণা রাখেন কার্বন ডেটিং সম্পর্কে?"
"রাখি‚ তারপরও আপনি আপনার মতো ব্যাখ্যা করুন।"
"কার্বন ডেটিং করা হয়ে থাকে কার্বন-১৪ আইসোটোপটির সাহায্যে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে প্রতিনিয়ত অসংখ্য মহাজাগতিক রশ্মি এসে আঘাত করে। এই আঘাতের ফলে বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন ভেঙ্গে ছোট ভর বিশিষ্ট কার্বন-১৪ আইসোটোপ তৈরি হয়। সালোকসংশ্লেনের সময় এই কার্বন-১৪ আইসোটোপ গ্রহণ করে থাকে উদ্ভিদ‚ আবার উদ্ভিদ থেকে খাদ্য এবং অক্সিজেন গ্রহণ করায় মানুষের শরীরেও এই কার্বন-১৪ আইসোটোপ প্রবেশ করে। আবার কার্বন-১২ পরমাণু মানুষের শরীরে থাকে আগে থেকেই। কার্বন ডেটিং করা হয় কার্বন-১২ এবং কার্বন-১৪ আইসোটোপ এর অনুপাত থেকে। কারণ জীবিত অবস্থায় মানুষের কার্বন-১২ এবং ১৪ এর অনুপাত সমান থাকলেও মৃত্যুর পর কার্বন-১৪ ভেঙে কার্বন-১২ তে রূপান্তরিত হয়। কার্বন-১৪ তেজস্ক্রিয় পরমাণু হওয়ার প্রতিনিয়ত ক্ষয় হতে থাকে। এই ক্ষয়ের পরিমাণ থেকে বয়স বের করে ফেলা যায়। কার্বন-১৪ আইসোটোপের অনুপাত যার যত কম‚ তার বয়স ততো বেশি।"
"ধন্যবাদ। কিন্তু হাড়টাতে সমস্যা কি?"
"হাড়টাতে সমস্যা হলো‚ প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কার্বন-১৪ আইসোটোপ এর অনুপাত সময়ের সাথে সাথে কমে আসার কথা। কিন্তু এই হাড়টাতে তা বেড়ে চলেছে!"
চমকে উঠে চায়ের কাপ প্রায় ফেলে দেয়ার উপক্রম করলেন আবু সাঈদ। "কি? আপনি বলতে চাইছেন একটা তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ক্ষয় হওয়ার পরিবর্তে বেড়ে চলেছে?"
"জ্বী!"
"দিস ইজ এবসার্ড! অন্তত এই পৃথিবীতে সেটা সম্ভব নয়।"
"আমারও তাই ধারণা। এ যেন একটা ঘড়ি হঠাৎ করে উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে।"
আবু সাঈদ কপাল কুঁচকে তাকালেন হুমায়ূন কবিরের দিকে। হুংকার দিয়ে বললেন-"কি বললেন আপনি?"
"কি বললাম?" হুমায়ূন কবির থতমত খেয়ে গেল!
"আপনার শেষ কথাটা আবার বলুন!"
"এ যেন একটা ঘড়ি হঠাৎ করে উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে।"
"চলি।" চায়ের কাপ রেখে ঝরের গতিতে উঠে পড়লেন আবু সাঈদ। হুমায়ূন কবির তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
পরের দু'টো দিন ড. আবু সাঈদ খুব ব্যাস্ত সময় কাটালেন। বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে জার্নাল ঘেটে‚ পুরনো সংবাদপত্র ঘেটে‚ ইন্টারনেট ঘেটে পার করলেন। দু'দিন পর রহস্যময় হাড় সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেলেন তিনি। তিনি জানতে পারলেন যে গত ৩৫ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে এমন আরো ৭ টা হাড় পাওয়া গেছে যেগুলোর কার্বন টেস্টিং করা সম্ভব হয়নি‚ কারণ সে হাড়্গুলোতে প্রাকৃতিক নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কার্বন-১৪ আইসোটোপ এর পরিমাণ বেড়ে চলেছে। অনেকে এ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েও কিছু না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে শেষমেষ।
*** *** ***
ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ড. শহীদুল্লাহ সহজে উত্তেজিত হন না‚ রেগে যান না‚ গলা চড়ান না। কিন্তু আবু সাঈদের রেজিগনেশন লেটার পেয়ে তিনি প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলেন।
"এসব আপনি কি বলছেন ড. সাঈদ? হুট করে চাকরী ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন? কি হয়েছে বলুন তো? কোন সমস্যা?"
সত্যি কথা বলে পাগল আখ্যা পাবার কোন ইচ্ছে নেই আবু সাঈদের। তিনি ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন-
"আমি একটা কাজে যাচ্ছি। সারা পৃথিবী চষে বেড়াতে হবে আমাকে। কবে ফিরব‚ আদৌ ফিরব কি না সেটা বলতে পারছি না নিশ্চিত করে।"
"কি কাজ ডক্টর?"
"সেটা এখনো বলার সময় আসেনি।"
ড. শহীদুল্লাহ একই সাথে বিস্মিত এবং বিরক্ত হলেন‚ আবু সাঈদের কথায় এক ধরনের নাটকীয়তা আছে‚ নাটুকেপনা তার পছন্দ নয়। বেশি পড়াশোনা করতে করতে নাকি মানুষ পাগল হয়ে যায়‚ আবু সাঈদের ক্ষেত্রেও তেমন কিছু ঘটেছে কি না ভেবে উদ্বিগ্ন হলেন। তার উপর একা একা থাকেন লোকটা‚ বিয়ে থা করেন নি। বেচারা!
"আমার মনে হয় আপনার একটা বিয়ে করা উচিত ডক্টর‚ বয়স তো আর কম হলো না।"
খুব খারাপ দু'টো ইংরেজি শব্দ চলে আসল আবু সাঈদের মুখে‚ কিন্তু তিনি শুধু বললেন-
"চলি।"
*** *** ***
দু' বছর পরের কথা। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অডিটোরিয়ামে লেকচার শেষ করে এইমাত্র বেরোলেন ড. উইলিয়াম জোন। দীর্ঘদেহী মানুষ তিনি‚ হাটলে অনেকের মাথা ছাড়িয়ে তাকে দেখা যায়।
নিজের অফিসে ঢুকতেই তার পিএ ছুটে এসে বলল-"স্যার‚ আপনার সঙ্গে এক ভারতীয় ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।"
ড. জোন নোবেল পুরস্কার পাওয়া বিজ্ঞানী‚ দুনিয়াজুড়ে নামডাক তার। তার সঙ্গে দেখা করতে চান এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। তিনি বেশ ধমকের সঙ্গে বললেন-
"তুমি কি দিন দিন গাধা হচ্ছো পিটার? যে কেউ এসে বলল দেখা করতে চাই অমনি তুমি হুট করে নিয়ে এলে? আমার সময়ের দাম নেই? জানো আজ ড. মারিয়ার্টির সাথে প্রজেক্ট ফিউচার ব্রিজ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে আমার?"
"সরি স্যার‚ আমি বুঝতে পারিনি। এখনই ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দিচ্ছি।"
পিটার দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যেতে লাগল। তবে দরজা পর্যন্ত যেতেই তাকে ডাক দিলেন ড. জোন।
"শোনো পিটার!"
"স্যার?"
"দেখা করতে চাইছেন‚ সে ভদ্রলোকের নাম কি?"
"তার নাম ড. আবু সাঈদ‚ তিনি একজন এনাটমিস্ট।"
নামটা শুনেই এক মোটাসোটা ভদ্রলোকের চেহারা মনে পড়ল তার‚ বছর পাঁচ আগে বেলজিয়ামে একটা সেমিনারে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল জোনের। স্বল্পভাষী ভদ্রলোক‚ বাঙালি।
তৃতীয় বিশ্ব এখনো ক্ষুধা এবং দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে‚ ভালো ভালো ব্রেন খুব বেশি একট দেখা যায় না ওখানে। তবে যে ক'টা ব্রেন দেখা যায় সেগুলোকে সবাই চেনে। ড. আবু সাঈদও খুব পরিচিত একটা মুখ বিজ্ঞান মহলে‚ অনেকগুলো সাড়া জাগানো মৌলিক গবেষণা আছে তার। এই ভদ্রলোক যখন জোনের সঙ্গে দেখা করতে চান‚ তখন নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই হবে।
"নিয়ে আসো তাকে। আর দু' কাপ কফি দিয়ে যেও এখানে।"
দু'মিনিট পর রুমে ঢুকলেন আবু সাঈদ। জোনের মনে হলো‚ শেষবার দেখা হবার পর আরো বুড়িয়ে গেছেন ভদ্রলোক। আরো দুর্বল লাগছে তাকে। তবে চোখগুলো দ্যুতিময় আছে আগের মতোই‚ বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট।
চেয়ারে বসেই আবু সাঈদ বললেন-
"ড. জোন‚ আমি আপনার সময় নষ্ট করতে আসিনি। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি।"
"বলুন ড. সাঈদ। নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতেও নেই। একটা মিটিং আছে কিছুক্ষণ পর। সংক্ষেপে বলুন।"
"আমি গত দু' বছর ধরে সারা পৃথিবী চষে ৭ টি হাড় পেয়েছি‚ ৭ টি ভিন্ন ভিন্ন দেশে। ৭ টি হাড় মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশের। আমি ডিএনএ টেস্ট করে দেখেছি‚ ৭ টা হাড়ই একই মানুষের।"
"৭ টা হাড়ই একই মানুষের কিন্তু সেগুলো পাওয়া গেছে পৃথিবীর ৭ টা ভিন্ন দেশে?"
"জ্বি!"
"স্ট্রেঞ্জ! কিন্তু এর সাথে আমার সম্পর্ক কি?"
"বলছি‚ এই সাতটা হাড়েই একটা অদ্ভূত জিনিস আছে। সেটা হলো এদের কার্বন টেস্ট করা সম্ভব নয়।"
"কেন নয়?"
আবু সাঈদ কার্বন টেস্টিং সংক্রান্ত ভূতুড়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বুঝালেন ড. জোনকে। শুনে জোনের চোখ কপালে উঠল।
"মাই গড! দিজ ইজ রিডিকিউলাস!"
"ড. জোন‚ আমাকে পাগল ভাববেন না। আমার ধারণা এই হাড়্গুলো ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কোন মানুষের হাড়! ভবিষ্যতের কেউ টাইম এন্ড স্পেস ডাইমেনশন ভেঙে অতীতে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রচন্ড বিস্ফোরণে তার হাড়গোড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় আছড়ে পড়েছে!"
ড. জোন হেসে উঠলেন। বললেন-
"বলতেই হয়‚ আপনার ধারণাটাও রিডিকিউলাস!"
"তাহলে আমার রিডিকিউলাস ধারণার পুরোটা শুনুন। ভবিষ্যৎ এর মানুষ বোকা নয়‚ তারা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কোন কারণ ছাড়াই শুধুমাত্র আবিস্কারের নেশায় অতীতে আসবে‚ এমনটা নাও হতে পারে। হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ তারা দিতে চেয়েছে আমাদের! খুব গুরুত্বপূর্ণ!!"
"প্রমাণহীন ধারণার স্থান বিজ্ঞানে নেই‚ আপনি সেটা জানেন ড. সাঈদ!"
"জানি। এই মুহুর্তে আমার হাতে প্রমাণ নেই। আমার ধারণা সত্য না মিথ্যে সেটাও আমার জানা নেই। কিন্তু আমি হয়তো আপনাকে প্রজেক্ট ফিউচার ব্রিজের ব্যাপারে সাহায্য করতে।"
"তাই? কিভাবে?"
"প্রজেক্ট ফিউচার ব্রিজে আপনারা ভবিষ্যতের সাথে যোগাযোগ করতে চাইছেন গত তিন বছর ধরে‚ এখনো কোন অগ্রগতি হয়েছে?"
ড. জোন হতাশভাবে মাথা নাড়লেন। "নাহ‚ হয়নি!! তবে কেন হচ্ছে না সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের সমীকরণে কোন ভুল নেই। তত্ত্বগত ভাবে আমাদের থিওরি নির্ভুল। কিন্তু প্রয়োগক্ষেত্রে কাজ করছে না।
"সম্ভবত আমি জানি কেন কাজ করছে না!"
"কেন?"
"আমার ধারণা যদি সত্যি হয়‚ অর্থাৎ হাড়্গুলো যদি ভবিষ্যতের হয়‚ তাহলে দেখা যাচ্ছে ভবিষ্যৎ থেকে আসার কারণে কার্বন-১৪ এর অনুপাত প্রকৃতির নিয়মের বিপরীতে বেড়ে চলেছে। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানের সেতুবন্ধনের মধ্যে এক ধরনের বিপরীতধর্মিতা রয়েছে।"
"আপনার পয়েন্ট কি?"
"আমার পয়েন্ট হলো‚ আপনারা ভবিষ্যতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন বলেই পারছেন না। সময়সেতুর বিপরীতধর্মিতা আপনাদের বাধা দিচ্ছে। বরঞ্চ আপনারা যদি অতীতের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন‚ তাহলেই ভবিষ্যৎ আপনাদের সামনে চলে আসবে এবং আমার ধারণা‚ এই মুহূর্তে ভবিষ্যতের সাথে যোগাযোগ করাটা খুব জরুরী। ভবিষ্যতের মানুষ আমাদের কিছু বলতে চায়‚ খুব জরুরী কিছু।"
ড. জোনের ভ্রু কুঁচকে গেল। তিনি আবু সাঈদের কথাগুলো নেড়েচড়ে দেখছেন।
*** *** ***
২২৫২ সাল। বিজ্ঞান একাডেমি জরুরী মিটিং ডেকেছে। একা কথা বলছে একাডেমির প্রেসিডেন্ট ব্রত্য-
"আজকের মিটিং মানব সভ্যতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই জানি যে‚ ২০৬৯ সালে পৃথিবী ধবংস হয়ে যায়। রিকটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয় টানা তিন দিন ধরে। সারা পৃথিবীতে জলোচ্ছাস এবং নিম্ন বায়ুচাপ সৃষ্টি হয়। ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় সব স্থাপত্য। কিন্তু তারপরও মানব সভ্যতা বেঁচে যায়। বিজ্ঞানের সব আবিস্কার‚ শিল্প সাহিত্য‚ প্রায় সবকিছুই বেঁচে যায়। প্রলয়কে জয় করে মানুষ। কিন্তু কি করে? ইতিহাস থেকে আমরা জানি‚ এই সাল‚ অর্থাৎ ২২৫২ সাল থেকে কেউ একজন টাইম এন্ড স্পেস ভেঙে অতীতের পৃথিবীতে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। যদিও সে মারা যায়‚ কিন্তু তার মৃতদেহের হাড়গোড় হতেই একজন বাঙালি এনাটমিস্ট ঘটনা আঁচ করে ফেলে এবং অন্যান্যদের সাহায্য নিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করে
২২৮৯ সালের মানুষের সাথে‚ অর্থাৎ আজ হতে ৩৭ বছর পরের সময়ে।"
এতটুকু শুনে ইরিনা নামের খুব অল্পবয়েসী ছটফটে এক তরুণী বলে ওঠে-
"এসব তো আমরা জানি মি.প্রেসিডেন্ট। তারা ২২৮৯ সালে যোগাযোগ করে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করে রক্ষা করে মানবসভ্যতাকে।"
"ইরিনা‚ জানোই যখন তখন বলো! কে সেই ব্যাক্তি যে টাইম এবং স্পেস ডাইমেনশন ভেঙে আমাদের সময় হতে অতীতের পৃথিবীতে যাওয়ার জন্য প্রাণ দিয়েছিল?"
"সেটা তো জানি না। সে ব্যক্তি সম্পর্কে কোন তথ্য নেই কোথাও। সে কে‚ অনেক খোঁজ করেও সেটা জানা যায় নি।"
"ঠিক। সভ্যতা রক্ষার গুরু দায়িত্ব আমাদের হাতে। আমাদের মধ্য হতেই কাউকে অতীতে যেতে হবে‚ কাউকে প্রাণ দিতে হবে স্বেচ্ছায়। কে হবে সে ব্যক্তি?"
ব্রতের ধারণা ছিল হাত তুলবে খুব কম মানুষই ‚ হয়তো কেউ তুলবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে কামরায় উপস্থিত প্রতিটি ব্যক্তিই হাত তুলল। প্রত্যেকের চেহারাতেই সভ্যতা রক্ষায় প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার তীব্র ইচ্ছা দেখতে পেল সে।
"ভদ্র মহোদয়গণ‚ আমি খুব খুশী হলাম জেনে যে আপনাদের প্রত্যেকের মধ্যে মানবধর্ম পালনের তীব্র প্রবণতা রয়েছে। তবে‚ যেহেতু আমার উপর বিজ্ঞান একাডেমির দায়িত্ব রয়েছে‚ তাই আমিই যেতে চাই অতীতে।"
ইরিনা চিৎকার করে উঠল-"কিন্তু আপনার স্ত্রী-সন্তান আছে মি. প্রেসিডেন্ট..."
ব্রত্য হাত তুলে বলল-"এ ব্যাপারে আর কোন কথা হবে না। আমি বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট এবং এটা আমার আদেশ!"
*** *** ***
৩৭ বছর পরের কথা‚ ২২৮৯ সাল।
আজকের দিনে অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হওয়ার কথা। সারা পৃথিবীর মানুষ উন্মুখ হয়ে আছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য।
বৃদ্ধা ইরিনা বর্তমানে বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট। ৫০ জন বিজ্ঞানী এবং অনেকগুলো সুপার কম্পিউটার সামনে নিয়ে বসে আছে সে। সারা পৃথিবীতে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সবাই উদগ্রীব।
হঠাৎ সবুজ আলো দেখা গেল সুপার কম্পিউটারের পর্দায়। একজন বিজ্ঞানী চিৎকার করে উঠল-
"মি. প্রেসিডেন্ট‚ ট্রান্সমিশন পাওয়া গেছে। অতীতের কেউ যোগাযোগ করতে চাইছে ভবিষ্যতের সাথে।"
ইরিনা শান্ত কন্ঠে বলল-
"কত সাল থেকে?"
"দেখছি‚ দাড়ান...২০১৯ সাল থেকে। "
"টাইম ডাইমেনশন নিয়ন্ত্রণ করো‚ আগে বা পরের সময়ে যেন না যায় তারা।"
"জ্বী! করছি!!"
কিছুক্ষণের মধ্যেই চতুর্মাত্রিক যোগাযোগ মডিউলটি জ্ব্যান্ত হয়ে উঠল। একজন আবারো চিৎকার দিয়ে উঠল-
"যোগাযোগ হয়েছে‚ যোগাযোগ হয়েছে!"
হলোগ্রাফিক পর্দায় তিনটে মুখ দেখা গেল। তিনজনই বয়স্ক! ইরিনাই কথা বলল-
"২২৮৯ সালের পৃথিবীতে আপনাদের স্বাগতম‚ আমি ইরিনা। বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট। আমরা ৩৭ বছর ধরে আপনাদের অপেক্ষায় আছি।"
"ধন্যবাদ। আমি ড. উইলিয়াম জোন। আমার সঙ্গে রয়েছে ড. আবু সাঈদ এবং প্রফেসর এমেট মারিয়ার্টি। আমাদের কমিউনিকেশন মডিউলটি খুব দুর্বল। যে কোন সময় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে। তাই খুব দ্রুত এবং সংক্ষেপে আপনাদের কথা শেষ করুন। আমাদের ধারণা আপনারা আমাদের কোন গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দিতে চান। তাই নয় কি?"
"জ্বী‚ ঠিক ধরেছেন। তাহলে সময় নষ্ট না করি। শুনুন‚ ২০৬৯ সালে পৃথিবীতে মহাপ্রলয় ঘটবে। রিকটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হবে টানা তিন দিন ধরে। সারা পৃথিবীতে জলোচ্ছাস এবং নিম্ন বায়ুচাপ সৃষ্টি হবে। ধবংস হবে সবকিছু!"
"মাই গড। এ থেকে বাঁচার উপায় কি?"
"পালিয়ে থাকা। পুরো ১৮ দিন পৃথিবীর সব মানুষকে নিয়ে আপনাদের পালিয়ে থাকতে হবে। ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।"
"কোথায় পালাব? আর কেমন প্রস্তুতি?"
"সারা পৃথিবী ধবংস হলেও কিছু কিছু শহরে তান্ডব অনেক কম হবে‚ ১৭ টা শহর প্রায় অক্ষত থাকবে। এসব জায়গা ছাড়াও আপনারা মহাকাশে অস্থায়ী আবাসন তৈরি করবেন।"
ইরিনা ১৭ টা শহরের নাম বলল। জোন জিজ্ঞেস করল-
"আর প্রস্তুতি?"
"পৃথিবীর সব আবিস্কার‚ শিল্প সাহিত্য বিভিন্ন হার্ডডিস্কে সেভ করবেন‚ সংগ্রহে রাখবেন সেগুলো‚ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে। আর একটা কথা..."
হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল হলোগ্রাফিক স্ক্রীণ।
বেশ হতাশ হলো ইরিনা। বলল-"আরো কিছু নির্দেশনা দেয়া দরকার ছিল।"
একজন বিজ্ঞানী বলল-"হতাশ হবেন না মি. প্রেসিডেন্ট। আশা করি তারা প্রয়োজনীয় নির্দেশ পেয়ে গেছে‚ আঁচ করে নিয়েছে বাকীটুকু।"
"তাই যেন হয়!"
*** *** ***
তাই হয়েছিল‚ মানুষ বেঁচে গিয়েছিল সে যাত্রায়। বেঁচে গিয়েছিল সভ্যতা। তবে প্রলয় বার বার আসবে‚ মানবজাতি কতবার নিজেদের রক্ষা করতে পারবে ‚ কে জানে!
(সমাপ্ত)