এ কে খন্ডকার সাহেবের বইয়ের লেখা নিয়ে তোলপাড় চলছে দেশে। সংসদে পর্যন্ত এ নিয়ে বিশাল চেঁচামেচি। আওয়ামী নেতারা Toilet উদ্বোধন করতে গিয়েও গলা ফাঁটিয়ে বলছেন, ‘এ কে খন্ডকার রাজাকার, পাকিস্তানী এজেন্ট’। আওয়ামী গৃহপালিত ফেসবুকারদের মাথা নষ্ট অবস্থা। তারা একের পর এক তথ্য উপাত্ত সাজিয়ে প্রমাণ করে ফেলছে, আসলে এ কে খন্ডকার পাকিস্তানী দালাল। স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি। আগামী কিছুদিনের মধ্যে খন্ডকার সাহেবের বীর উত্তম খেতাব কেড়ে নিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত রাজাকারের সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিলে অবাক হবোনা।
আসলে এ কে খন্ডকার সাহেব এমন কি বলেছেন, যাতে এমন হায় হায় পড়ে গেল? আমরা জানি, তিনি চাকুরী পরবর্তী জীবনে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পরবর্তীতে তিনি সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। কাজেই আদতে তিনি আওয়ামী ঘরানারই একজন লোক। তার যে বইটি নিয়ে এত কথা, তাতে কোথাও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কে অপমান করে কোন কথা আছে বলে আমার চোখে পড়েনি। তিনি বলেছেন বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান বলেছেন। এতে তথাকথিত বুর্বুক আওয়ামী নেতাদের গায়ে আগুন ধরে গেল কেন বুঝলাম না। ৭ই মার্চ ১৯৭১ এ তো বাংলাদেশ বলে কোন দেশ ছিলনা, ছিল পাকিস্তান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তো পাকিস্তানের পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল, বাংলাদেশের নয়, আওয়ামী লীগের সরকার গঠন করার কথা ছিল পুরো পাকিস্তানে, বাংলাদেশে নয়। একটা দেশের নিরংকুশ সংখ্যাগরষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের প্রধান কি পুরো দেশ বাদ দিয়ে অর্ধেক নিয়ে চিন্তা করবেন, নাকি স্লোগান দেবেন?? তখন পর্যন্ত এসেম্বলী বসার ব্যাপারটা ঝুলে আছে, ইয়াহিয়া খান দিচ্ছি দিচ্ছি বলে দিচ্ছেনা, পাকিস্তানের একজন ভবিতব্য প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন অবস্থায় যদি ‘জয় পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে 'জয় পুর্ব-পাকিস্তান' বা 'জয় বাংলাদেশ' বের হত, তা হলে তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে তার ফাঁসি হয়ে যেত! ইয়াহিয়া কে এমন মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেয়ার কি যুক্তি? তিনি ‘জয় বাংলা’ বলেছিলেন, কিন্তু সেটা দিয়ে তাঁর ভাষণ শেষ করাই হতো বোকামি, সেটা বুঝতে পারার মত যথেষ্ট প্রজ্ঞা তাঁর এবং সেই ভাষণের রূপকার তাজউদ্দিন সাহেবের ছিল। দেশের স্বনামধন্য লেখক, বিদেশী সাংবাদিক, অনেকেই ৭ই মার্চের ভাষণের শেষ অংশে শেখ মুজিব 'জয় পাকিস্তান' বলেছেন বলে উল্লেখ করেন, এতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হল, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর এখনের আওয়ামী লীগে মধ্যে মিল ততটুকুই, যতটুকু ‘আগরতলা’ আর ‘চকির তলা’ র মধ্যে, যতটুকু ‘হেনরী কিসিঞ্জার’ আর ‘হারুণ কিসিঞ্জার’ এর মধ্যে। ১৯৭১ সালের আওয়ামী লীগ বাংলার মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছে, আর ২০১৪ সালের আওয়ামী লীগ দেখাচ্ছে দুঃস্বপ্ন। এ কে খন্ডকার, যে লোকটা সর্বোচ্চ খেতাবপ্রাপ্ত জীবিত মুক্তিযোদ্ধা (বীর উত্তম), ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন আত্মসমর্পন করলো, তখন যিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন (বিশেষ কারণে ওসমানি সেই প্রোগ্রামে ছিলেননা), তাকে মুহূর্তে রাজাকার বানিয়ে দিতে এই আওয়ামী লীগের নেতাদের চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপেনা।
এবার আসুন দ্বিতীয় বিষয়ে। বইতে লেখা আছে, আওয়ামী নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলনা। এখানে খারাপ কথা বা মিথ্যা কথা কোনটা? তখন পর্যন্ত আলোচনা চলছিল কিভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়। ২৫ মার্চ পর্যন্ত সেই আলোচনা চলেছে, কোন সমাধানে আসা যায়নাই। ইয়াহিয়ার গনহত্যার প্ল্যান তো আর বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই জেনে রাখেন নাই, যে আলোচনার পাশাপাশি যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিয়ে রাখবেন। এখনকার আওয়ামী নেতারা যেভাবে গলা ফাঁটাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ ৭ মার্চ থেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, তাতে করে তারা কি বোঝাতে চাইছে বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই জানতেন ২৫ মার্চ গণহত্যা হবে, আর ২৬ মার্চ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে হবে?? জেনে বুঝে তিনি চুপ করে ছিলেন, যাতে মিলিটারিরা ঢাকা শহরের হাজার হাজার মানুষকে এক রাতের মধ্যে খুন করে ফেলতে পারে! এইসব নেতারা নিজেরাই তো বঙ্গবন্ধুকে ছোট করে ফেললো, এ কে খন্ডকার কোথায় করলেন?? ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষনা দিয়েছেন ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ এর মানে কি এই পরের দিন থেকে বাংলাদেশী মানুষ রাতে না ঘুমিয়ে স্টেনগান হাতে বসে থাকে??!! একটা কথাকে আর কতটা বিকৃতভাবে বিশ্লেষণ করা হবে! বঙ্গবন্ধু আশংকা করছিলেন যে আলোচনা সফল নাও হতে পারে, যুদ্ধ একটা করতে হতে পারে, কিন্তু আলোচনা যে শেষ না করেই ইয়াহিয়া গনহত্যার প্ল্যান হাতে নিয়েছে, সেটা তিনি কিভাবে জানবেন? সেটা আওয়ামী লীগই বা কিভাবে জানবে? তাহলে যদি বলা হয় যে, ২৬ মার্চেই যুদ্ধে নামতে হবে, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রস্তুত ছিলনা, তাহলে এখনকার গো-মূর্খদের গায়ে আগুন ধরে যায় কেন? এটা হওয়াই তো স্বাভাবিক, খন্ডকার সাহেব খুব স্বাভাবিক, সাধারণ ঘটনার মতই এই কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ওই যে এক স্বভাব, সব কিছুতে নিজেকে জাহির করা চাই। “আরে ব্যাটা, আওয়ামী লীগ প্রস্তুত ছিলনা মানে?? অবশ্যই প্রস্তুত ছিল। তুই হইলি রাজাকার”। আমার মনে হয়, খন্ডকার সাহেব যদি তার বইতে লিখতেন, ’২৫ মার্চ এমন গণহত্যা হবে সেটা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগের নেতারা বিন্দুমাত্র কিছু জানতেননা’, তাহলে বর্তমান আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা গলা ফাঁটিয়ে বলতেন, ‘জানতো না মানে! অবশ্যই জানতো। বঙ্গবন্ধু জানবে না, এমন কোন ব্যাপার আছে নাকি। ২৫ মার্চ গণহত্যা হবে, ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ হবে, এসব জানতো বলেই তো তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। না জানলে এই কথা তিনি আগে কিভাবে বললেন? খন্ডকার ব্যাটা একটা রাজাকার।’ কেঁচো খুড়তে সাপ বেড়িয়ে যাচ্ছে নাকি?? থাক সে কথা। আসলে এখনকার আওয়ামী নেতাদের এবং তাদের গৃহপালিত কিছু ফেসবুকারদের অবস্থা দেখলে সেই প্রবাদটা মনে পড়ে যায়, ‘ঠাকুরঘরে কে রে, আমি তো কলা খাই না’।
বিঃদ্রঃ একজন মহান ব্যাক্তি সচলায়তনে অনেকগুলা পেপার কাটিং দিয়েছেন, দৈনিক বাংলার ১৯৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫ এর ৭ই মার্চের কাটিং, যেগুলোতে ১৯৭১ এর ৭ই মার্চের তাতপর্য সম্পর্কে লেখা রয়েছে। ইত্তেফাকেরও কিছু কাটিং আছে। সবার শেষে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এতসব পেপারের কাটিং এ জয় পাকিস্তান কথাটা কোথায়’। তো মহাশয়, পেপার কাটিং এ পুরা ভাষণ তো নাই, আছে তার বিশেষ বিশেষ অংশের উদ্ধৃতি, সেখানে জয় পাকিস্তান না থাকাই স্বাভাবিক। তবে ১৯৭২ সালের ৭ই মার্চ দৈনিক বাংলার যে লেখা, সেখানে লেখা আছে, ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল ২২ মিনিটের। এখন তাবত বিশিষ্ট আওয়ামী বুদ্ধিজীবিদের কাছে প্রশ্ন, কে কোথায় আছেন, আমাকে পুরা ২২ মিনিট ভাষণের একটা ভিডিও যোগাড় করে দেন। পারবেন?? উত্তরটা আমি দিয়ে দেই, পারবেন না। সরকারিভাবে যে ভিডিও প্রচার করা হয়, সেটা ১৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের, তাও, ভাষণ শুরু হইসে ১ মিনিট পর। ইন্টারনেটের সব কয়টা লিংক খুঁজেও ২২ মিনিটের ভিডিও পাইনাই, সর্বোচ্চ ১৬ মিনিট ২২ সেকেন্ডের একটা পেয়েছিলাম, সেটা ৫ মিনিট চলার পর কোন এক আজানা কারণে বন্ধ হয়ে যায়। সো, ভাইসাবেরা, ২২ মিনিটের জিনিস ১৪ মিনিট ৫০ সেকেন্ডে দেখায়া আপনারা কইতে চান, ‘আমরাই সত্যি, বাকি সব মিথ্যা’! বালাই কইসুইন।