শুধুমাত্র দু’জন আমেরিকান হোটেলটিতে ঠাঁই নিয়েছিল। নিজেদের কক্ষে আসা-যাওয়ার সময় সিঁড়িতে যত লোকজনের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটছিল তাদের কাউকেই তারা এর আগে দেখেনি। কক্ষটি ছিল দ্বিতীয় তলায়Ñসমুদ্রমুখী। অন্য এক মুখ ছিল সাধারণ বাগান ও যুদ্ধভাস্কর্যের দিকে। বাগানজুড়ে ছিল লম্বা লম্বা পামগাছ আর সবুজ রঙের বেঞ্চ।
আবহাওয়া ভালো থাকলে ওখানে সবসময় একজন শিল্পীকে আঁকার জিনিসপত্র নিয়ে দেখা যায়। শিল্পীরা পছন্দ করত সমুদ্রমুখী এই রঙচঙে হোটেল আর যেভাবে পামগাছগুলো বড় হয়ে উঠছিল তার দৃশ্য। ইটালিয়ানরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যুদ্ধভাস্কর্যটি দেখতে আসত। এটা ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি, ফলে বৃষ্টির দিনে চকচক করত।
তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। পামগাছ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ছিল বৃষ্টি। কাঁকর বিছানো পথের গর্তগুলো ভরে উঠেছিল জলে। বৃষ্টির দিনে সমুদ্রের স্রোত বেশ খানিকটা ডাঙায় উঠে আসে, আবার ফিরে যায় আপনমনে। স্মৃতিস্তম্ভের কাছের স্কয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলো চলে গিয়েছিল। স্কয়ারের ওপাশে ক্যাফের দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে একজন ওয়েটার খালি স্কয়ারের দিকে তাকিয়ে।
আমেরিকান মহিলা তখন জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাইরে, ঠিক তাদের জানালার নিচে, বৃষ্টি চুঁইয়ে পড়া এক টেবিলের নিচে জড়সড় হয়ে বসে ছিল একটি বেড়াল। বেড়ালটি নিজেকে গুটিয়ে কোনোরকমে বৃষ্টি থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিল।
‘আমি নিচে যাচ্ছি, বেড়ালটিকে আনতে।’ আমেরিকান মহিলা বলল।
‘আমি যাবো।’ বিছানাই থেকে তার স্বামী প্রস্তাব করল।
‘না। আমিই আনছি। বেচারা টেবিলের তলে আশ্রয় নিয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।’
স্বামী বিছানায় আরামে পা ছড়িয়ে তার বইপড়া চালিয়ে যেতে লাগল।
‘ভিজে যেও না যেন।’ সে বলল।
মহিলা নিচতলায় নেমে গেল। তাকে দেখে হোটেলমালিক মাথাটা নিচু করে ভদ্রতা প্রকাশ করল। অফিসের বেশ খানিকটা দূরের এক কোণায় ছিল তার বসার টেবিল। সে ছিল বেশ লম্বাÑবয়স্ক লোক।
‘বৃষ্টি হচ্ছে।’ মহিলা বলল। হোটেলমালিককে তার বেশ মনে ধরেছিল।
‘হ্যাঁ। যথেষ্ঠ বাজে আবহাওয়া আজ।’
হালকা আলোকময় কক্ষে সে তার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে রইল। মহিলা তাকে পছন্দ করেছিল। পছন্দ করেছিল তার গুরুত্বসহকারে প্রতিটা অভিযোগ শোনার স্বভাবকে। সে তার আত্মসম্মানবোধকে পছন্দ করেছিল। পছন্দ করেছিল সে তাকে যেভাবে সাহায্য করতে আসত তার ধরনকে। সে পছন্দ করেছিল হোটেলকিপার হয়ে তার উপস্থাপন ভঙ্গিমাকে। সে পছন্দ করেছিল তার বয়স্ক, পরিপক্ক মুখম-ল ও বড় বড় পুরুষালি হাত দুটোকে।
মহিলা দরজা খুলে বাইরে তাকাল। বৃষ্টি আরো বেড়ে চলেছে। রাবারটুপি পরিহিত একজন লোক খালি স্কয়ার পেরিয়ে ক্যাফের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিড়ালটি হয়ত বাম দিকে আছে। সে দরজার মুখে পা রাখা মাত্র পেছন থেকে কে যেন মাথায় ছাতা খুলে দাঁড়াল। সে ছিল তাদের কক্ষের দেখভালের দায়িত্বে থাকা বালিকাটি।
‘আপনার বৃষ্টিতে যাওয়া উচিত হবে না।’ মৃদু হেসে ইটালি ভাষায় বলল সে। অবশ্যই হোটেলকিপার তাকে পাঠিয়েছে।
বালিকাটি মাথার ওপর ছাতা ধরা অবস্থায় আমেরিকার মহিলা কাঁকর বিছানো পথ ধরে ঐ জানালার নিচে গেল। টেবিলটি সেখানেই ছিলÑ বৃষ্টিতে ধুয়ে আরো সবুজ-সতেজ লাগছিল। তবে বিড়ালটিকে আর সেখানে দেখা গেল না। সহসা সে খুব বিষণœ হয়ে পড়ল। সেবায় নিয়োজিত মেয়েটি তার দিকে তাকালো।
‘আপনি কি কিছু হারিয়েছেন, ম্যাডাম?’
‘এখানে একটি বেড়াল ছিল।’ ঐ আমেরিকান তরুণী বলল।
‘বিড়াল?’ বালিকাটি হেসে ফেলল। ‘বৃষ্টির মাঝে বিড়াল?’
‘হ্যাঁ।’ সে বলল। ‘ঐ টেবিলের নিচে। আমি খুব করে ওটা চেয়েছিলাম। আমি একটা কিটি (বেড়ালছানার আদুরে নাম) চেয়েছিলাম।’ সে যখন ইংরেজিতে এসব কথা বলছিল, তখন ঐ বালিকার মুখ শক্ত হয়ে এঁটে এলো।
‘আসুন ম্যাডাম।’ সে বলল। ‘আমাদের অবশ্যই ভেতরে ফিরে যাওয়া উচিত। আপনি ভিজে যাবেন।’
‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়।’ আমেরিকান নারী বলল।
কাঁকরবিছানো পথ ধরে তারা ফিরে এলো। সে ভেতরে চলে গেলো; সেবায় নিয়োজিত বালিকাটি দরজার বাইরে দাঁড়ালো ছাতাটা বন্ধ করার জন্য। আমেরিকান মেয়েটি অফিসের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দেখে হোটেল-কিপার ডেস্ক থেকে আবারো মাথা ঝাঁকালো। আমেরিকান মেয়েটির ভেতরে কি জন্যে যেন খুব সামান্য এবং টনটনে অনুভূতি হলো। হোটেলকিপারের এমন আচরণে তার নিজেকে খুব ছোট আবার একইসাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল। ক্ষণিক সময়ের জন্য তার নিজের কাছে নিজেকে খুব বিশেষ কিছু মনে হল। সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। কক্ষের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। জর্জ বিছানায় পড়ে ছিলÑ পড়ছিল।
‘বিড়ালটি পেলে?’ সে বইটি নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘না। চলে গেছে।’
‘এত তাড়াতাড়ি গেল কোথায়!’ পড়া থেকে চোখকে আরাম দিয়ে সে বলল।
‘আমি ওটা খুব করে চেয়েছিলাম।’ সে বলল। ‘জানি না কেন অমন করে চেয়েছিলাম। আমি ঐ বেচারা কিটিকে চাই। বৃষ্টির ভেতর ওভাবে ভেজাটা তার জন্যে মজার কিছু ছিল না নিশ্চয়!’
জর্জ আবারও পড়ছিল।
সে উঠে গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে গিয়ে বসলো। হাত আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো। সে নিজের চেহারা পড়ছিলÑ একবার ডান দিক থেকে, একবার বামদিক থেকে। এরপর সে তার কাঁধ ও কাঁধের ওপাশ পরখ করে দেখছিল।
‘তোমার কি মনে হয়? এটা খুব ভাল হবে না, যদি আমি আমার চুলগুলো বেড়ে উঠতে দিই?’ সে জিজ্ঞেস করলো এবং নিজেকে আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলো।
জর্জ মুখ তুলে দেখলো এবং তার কাঁধের দিকে তাকাল। তাকে ছেলেদের মতো দেখাচ্ছিল।
‘যেমন আছে তেমনই আমার পছন্দ।’
‘আমি এভাবে খুব হাঁপিয়ে উঠেছি।’ সে বলল। ‘এভাবে নিজেকে ছেলেদের মতো দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’
জর্জ বিছানায় উল্টো দিকে ঘুরলো।
‘তোমাকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে।’ সে বলল।
সে তার হাতের আয়না ড্রেসিংটেবিলে রেখে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরের দিকে তাকালো। বাইরে তখন দ্রুত আঁধার নেমে আসছিল।
‘আমি আমার চুল বড় করে তুলতে চাই। পেছনে বড় ঝুঁটি বাঁধবো যাতে আমি সেটা অনুভব করতে পারি।’ সে বলে চলেছিল। ‘আমি একটা কিটি চাই। সে আমার কোলে বসে থাকবে; আমি যখন তাকে থাবা দেবো সে তখন আরামে বাচ্চাদের মতো মি-মি করবে।’
‘তাই?’ জর্জ বিছানা থেকে বলল।
‘আমি টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জিত করে খেতে চাই। আমি চাই শরৎ আসুক। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে চাই। আমি একটি বেড়ালছানা চাই। আর কিছু নতুন পোশাক চাই।’
‘কি লাগালে-থামবে তুমি? আমাকে একটু পড়তে দাও।’ জর্জ চেঁচিয়ে ওঠে। সে আবারও পড়তে শুরু করলো।
তার স্ত্রী জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। এখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। পামবনে তখনও বৃষ্টি পড়ছিল।
‘যা-ই বলো, আমি একটি বিড়াল চাই।’ সে বলল। ‘আমি একটি বেড়াল চাই। আমি একটি বেড়াল চাই, এক্ষুণিই। যদি আমি আমার চুল বড় করতে না পারি, আর কোনো মজা না করতে পারি, তাহলে আমি অন্তত একটা বেড়াল তো পেতে পারি।’
জর্জ আর শুনছিল না। সে তার বইয়ের মধ্যেই বুঁদ হয়ে পড়ে ছিল। তার স্ত্রী জানালায় দাঁড়িয়ে খালি স্কয়ার আলোকিত হয়ে ওঠার দৃশ্যটি দেখছিল।
কেউ একজন দরজায় টোকা দিল।
‘আসছি।’ জর্জ তার বই থেকে মুখ তুলে বলল।
দরজার গোড়ায় ঐ বালিকা দাঁড়িয়ে ছিল। সে তার হাতে বড়সড় এক বেড়াল ধরে ছিল।
‘কিছু মনে করবেন না।’ সে বলল। ‘মালিক এটা ম্যাডামের জন্য পাঠিয়েছেন।’
গল্পপাঠ : বৃষ্টিদিনে বেড়াল
মেদহীন ঝরঝরে গদ্যে-অল্পকথায়-জীবনের সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলো বলে ফেলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর বেশিরভাগ গল্পে মজার-আকর্ষণীয় গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। পড়া শেষ হয়ে প্রশ্ন জাগে- এ কী পড়লাম! এটা কোনো গল্প হলোÑ কখনো কখনো এমনও মনে হয়। কিন্তু প্রতিটা শব্দ হাতুড়ি দিয়ে পেটালে বের হয়ে যায় জীবনের ভীষণ নির্মম কিছু সত্য। এজন্য তাঁর লেখনীর ধরনকে ব্যাখ্যা করা হয় ‘আইসবার্গ থিওরি’ হিসেবে। হেমিংওয়ের যে গল্পটির বিষয়ে এই কথাগুলো সবচেয়ে বেশি খাটে সেটি হলো- ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’, বা যার বাংলা করেছিÑ ‘বৃষ্টিদিনে বেড়াল’। তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘হিলস লাইক হোয়াইট এলিফেন্ট’, ‘দ্য ¯েœাজ অব কিলিমানজারো’, ‘অ্যা ওয়েল লাইটেড প্লে¬ইস’ এসব গল্পের ক্ষেত্রেও কথাগুলো খাটে। বর্তমান গল্পপাঠেÑ তাঁর ফ্লাসফিকশন ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’ গল্পে বিদ্যমান নানান উপকরণের ব্যাখা-বিশ্লেষণ করবো।
নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা বা ফেমিনিস্ট লিটারারি ক্রিটিসিজম
গল্পটির প্রধানতম বিষয় হলো, নারী-পুরুষের ভেতরকার সম্পর্কÑস্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের টানাপড়েন ও ফাঁকফোঁকর। হেমিংওয়ের সমগ্র সাহিত্যেই প্রধানতম বিষয় হলো এটি। গল্পে প্রধান পুরুষ চরিত্র জর্জ আর নারী চরিত্র জর্জের স্ত্রী। তারা দুজনেই জাতিতে আমেরিকান। গল্পের মূল চরিত্র বা প্রটাগনিস্ট জর্জের স্ত্রী, তারপরও তার নাম আমরা জানতে পারি না। কেননা পুরুষকেন্দ্রিক সভ্যতায় স্বামীর পরিচয়েই পরিচিত হয়ে ওঠে একজন নারী। কাজেই, গল্পের নারী চরিত্রের নির্দিষ্ট কোনো পরিচয় থাকে না। গল্পকথক একবার তাকে জর্জের স্ত্রী, একবার আমেরিকান নারী, একবার আমেরিকান তরুণী- এইভাবে সম্বোধন করেছেন। হতে পারে সমাজে নারীদের আসল অবস্থান বোঝানোর জন্য হেমিংওয়ে এগুলো সচেতনভাবে করেছেন অথবা গল্পকথক হেমিংওয়ে পুরুষ হওয়ায় তাঁর অবচেতনেই এসব ঘটে গেছে। তবে দ্বিতীয়টির সম্ভাবনা খুব কম।
গল্পে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে দেখা যায়Ñ তারা দু’জনে ইটালির এই সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসলেও, বেড়ানোর ব্যাপারে তাদের, বিশেষ করে স্বামীর মাঝে, বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে বই পড়াতেই ব্যস্ত। তাকে দেখে মনে হয়Ñ আমেরিকা থেকে ইটালি এসেছে শুধু বই পড়তে! স্ত্রীর প্রতি ন্যূনতম মনোযোগও তার নেই। স্ত্রীকে সে ভীষণ বৃষ্টিতে বাইরে যেতে দেয়। স্ত্রী তার নানান শখের কথা শোনালে সে যারপরনাই বিরক্ত হয়। পুরো গল্পজুড়ে সে বিছানায় বই নিয়ে পড়ে থাকে। একটিবারের জন্যও তার মনে হয় না যে, চমৎকার বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় জানালায় দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে স্ত্রীর সঙ্গে খানিকটা প্রেমালাপ করে। স্ত্রী নানানভাবে তাকে বুঝিয়ে দেয়, সে এখন প্রকৃত নারী হতে চায়- সে মা হতে চায়। সে একটা বেড়ালছানা চায়। সে তার পেছনের চুলগুলো বড় করে নারীসুলভ চেহারা আনতে চায়। সে কোনোকিছুর দায়িত্ব নিতে চাই। সে যৌনসম্পর্কেরও ইঙ্গিত দেয়Ñ কিন্তু জর্জ সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপ করে না। স্ত্রীর কথা থেকে জানা যায়, জর্জ তাকে পুতুল কিংবা খেলনার মতো নির্মল আনন্দের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে।
জর্জের স্ত্রীর হোটেলকিপারকে পছন্দ হয়; কেননা সে তার প্রতিটা চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দেয়। সে তাকে একজন নারীর দৃষ্টিতে দেখে। তাকে বাইরে বৃষ্টিতে একা ছাড়ে না। তাকে বেড়াল এনে দেয়। তার বড় বড় পুরুষালি হাত তাকে আকৃষ্ট করে। আমেরিকান নারী তাকে চাই- শরীরে ও মনে। তবে সেটা সে প্রকাশ করে শুধুমাত্র স্বামীর কাছেÑআকারে ইঙ্গিতে।
মনস্তাত্ত্বিক পাঠ বা সাইকো-অ্যানালিটিক্যাল স্ট্যাডি
গল্পে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বোঝাতে হেমিংওয়ের মূল প্রজেকশনটা ছিল চরিত্রগুলোর মনোজগতে। স্ত্রী তার অনুভূতি বোঝাতে বার বার বেড়ালের প্রসঙ্গে ফিরে যায়। সে আলোকসজ্জিত টেবিলে খেতে চায়, চুল বড় করে বয়-লুক ঘোঁচাতে চায়। এসব সম্ভব না হলে সে বেড়াল চায়। বেড়ালকে সে সন্তানের মতো আদর করতে চায়। জর্জের সংসারে তার ওপর কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সে মা হয়ে কিংবা বেড়াল দিয়ে কোনোকিছুর দায়িত্ব বহন করতে চায়। এখানে স্ত্রী কতগুলো ইমেজ বা সংকেত ব্যবহার করে তার মনোজগতের চেহারা উন্মোচন করেছে। সে চায়, কেউ তার যতœ নিক; এবং সেও কারও যতœ নেবে। কিন্তু সরাসরি সে কিছুই বলে না। কতগুলো আপাত অর্থহীন কথা বলে সে তার মনের বাসনা প্রকাশ করে মাত্র। সংকেতগুলোর অর্থ উন্মোচন করা সম্ভব না হলে জানা যায় না তার মনোজগতের বাসনাকে। কাজেই, গল্পটি বোঝার জন্য গল্পের মুড ও মনস্তাত্ত্বিক ক্লুগুলো ধরতে পারা অপরিহার্য।
লেখক-জীবনীভিত্তিক পাঠ বা বায়োগ্রাফিক্যাল স্ট্যাডি
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বেশিরভাগ সাহিত্যকর্মই তাঁর নিজের জীবনঘনিষ্ট। তাঁর রচিত ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’, ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’, ‘আইল্যান্ডস ইন দ্য স্ট্রীম- এসব সাহিত্যকর্মও তাঁর আত্মজৈবনিক উপাদানে ভরপুর। ‘ক্যাট ইন দ্য রেইন’ প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে, হেমিংওয়ের ‘ইন আওয়ার টাইম’ ছোটগল্প সংকলনে। এই গল্পটিও তাঁর যাপিতজীবনের অংশবিশেষ। গল্পটি যখন তিনি লেখেন তখন তাঁর প্রথম বিয়ে ভাঙনের মুখে ছিল। সেই সময় তিনি তাঁর স্ত্রীর প্রতি প্রচ- বিরক্ত হয়ে পড়েনÑ তিনি তাঁর মাকে স্বার্থপর নারী হিসেবে আখ্যা দেন। এলিনেশন বা বিচ্ছিন্নতাবোদ তখন তাঁর ব্যক্তিজীবনকে গ্রাস করে ফেলে। কাজেই এই গল্পের জর্জ যদি লেখকের ‘ফিকশনাল সেলফ’ হয় তাহলে জর্জ কিছুটা হলেও পাঠকদের সহানুভূতি কাড়তে সক্ষম হয়। হেমিংওয়ের জীবনীলেখক ডিলিবার্তো জানান, ১৯২৩ সালে রাপালোতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে হেমিংওয়ে গল্পটি লেখেন। হেমিংওয়ের প্রথম স্ত্রী হ্যাডলি তখন দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তিনি একদিন বৃষ্টিদিনে টেবিলের তলায় বেড়াল দেখে হেমিংওয়েকে বলেছিলেনÑ আমি একটি বেড়াল চাই। আমি এখনই একটি বেড়াল চাই। আমি চুল বড় করতে না পারলে অন্তত একটি বেড়াল তো পেতে পারি! উল্লেখ্য, হ্যাডলির চুল ববকাট ছিল। ১৯২৫ সালে হ্যাডলি জানতে পারেন, হেমিংওয়ে অন্য কোথাও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, পরে তাঁকে ডিভোর্স দেন।
ঐতহাসিক পাঠ বা হিস্টোরিক্যাল স্ট্যাডি
হেমিংওয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে মানুষের মনে একধরনের শূন্যতার রোগ দেখা দেয়। মানুষ সবকিছুর মধ্যে অর্থহীনতা খুঁজে পায়Ñ কী বেঁচে থাকাতে, কী মৃত্যুতে। জন্ম হয় একটা ‘লস্ট জেনারেশনের, যারা বুল ফাইটের মতো নির্মম খেলা থেকে জীবনের রস আস্বাদন করতে থাকে; যারা জীবনের একটা বিরাট অংশ কাটায় মৎস্যশিকারের মতো নন-ক্রিয়েটিভ কাজে। হেমিংওয়ে নিজেও সেই জেনারেশনের একজন হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য তাঁর ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ উপন্যাস কিংবা ‘অ্যা ওয়েল লাইটেড প্লে¬ইস’ গল্পের কথা। উপন্যাসটিতে যুদ্ধফেরত যোদ্ধারা বুঁদ হয়ে থাকে ষাঁড়ের লড়াইয়ে। আর গল্পটিতে একজন বৃদ্ধ প্রতিদিন বারে গিয়ে পান করতে থাকেন অনবরত। এক্ষেত্রে সিমাস হিনির সেই লাইনটির কথা মনে পড়ে গেলÑ‘হি ড্রাংক লাইক এ ফিশ!’ জীবনের প্রতি একধরনের বিতৃষ্ণাবোধ ও যুদ্ধবিরোধী মানসিকতা এই গল্পেও দেখা যায়। দু’জন আমেরিকান ইটালির এক হোটেলে এসে ঠাঁই নিয়েছে। হোটেলটির পাশে যুদ্ধে নিহতদের স্মৃতিতে তৈরি আছে স্মৃতিসৌধ। যুদ্ধ থেকে চাইলেও পালাতে পারে না এই দুই আমেরিকার নাগরিক। তারা অবসর যাপনে আসলেও দৃশ্যদেখার মন তাদের মরে গেছে আগেই। দু’জন অল্পবয়সী নারীপুরুষ পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসার পরিবর্তে নিজেদের জগৎ নিয়ে পড়ে থাকে। কেউ কারো ভাষা বোঝে নাÑ আক্ষরিক অর্থে এবং মেটাফরিক্যালিও।
অস্তিত্ববাদ সমালোচনা বা এক্সিজটেনশিয়াল ক্রিটিসিজম
গল্পে নারীর নিজস্ব কোনো আইডেন্টিটি বা পরিচয় নেই। তাকে শুরুতেই পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘আমেরিকান ওয়াইফ’ হিসেবে। এরপর তাকে বহুবার সম্বোধন করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও তার নাম নেওয়া হয়নি। তার পরিচয়, সে জর্জের স্ত্রী এবং সে আমেরিকান। গল্পের শুরুতে চরিত্র নিজেও ততটা অস্তিত্বসচেতন থাকে না। তবে আস্তে আস্তে বোঝা যায়Ñ আমেরিকান নারী একটা নিজস্ব পরিচয় চায়। সে ‘বিকামিং’ বা ‘হয়ে ওঠা’ প্রসেসের ভেতর পা রাখে। স্বামী বেড়ালটি এনে দিতে চাইলে, সে তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে না করে দিয়ে বৃষ্টিদিনে বেরিয়ে পড়ে। হোটেলকিপারও তাকে বাধা দেয়। সে শোনে না। এই বেরিয়ে পড়াটাই হয়ে ওঠে নারীর প্রথম অস্তিত্ব অন্বেষণ। আমার নোরার বেরিয়ে পড়ার প্রসঙ্গটিও এখানে টানতে পারি। সে আসলে বেড়ালকে নয়, নিজেকেই খুঁজতে যায়Ñএকাকী বৃষ্টির মাঝে। পেয়েও যায়। পেয়ে যে যায় তার প্রমাণ সে ঘরে এসে তার বয়-লুক ছেড়ে দিতে চায়। সে চুল বড় করতে চায়। সে বেড়াল বা সন্তান চায়, কারণ সে একান্ত নিজের করে কিছু পেতে চাই। সে কোনো কিছুর মালিকানা চায়, বা দায়িত্ব নিতে চায়। স্বামীর খেলনা হয়ে সে আর থাকতে চায় না। এবার সে নিজের জন্য, নিজের আনন্দের জন্য, একটা জগৎ চায়। এই চাওয়ার মধ্যদিয়েই গল্পে একজন নারীর অস্তিত্বের অন্বেষণ ঘটে।
পূরাণভিত্তিক পাঠ বা মিথোলজিক্যাল স্ট্যাডি
গল্পটির কিছু ইমেজ বা ফাংশন মিথোলজিক্যাল এলিগরি হিসেবে কাজ করেছে। দু’জন আমেরিকান নর-নারী আশ্রয় নিয়েছে ইটালিতে, যেখানে তাদের কেউ চেনে না, ভাষাও বোঝে না। তারাও সেখানকার কাউকে চেনে না। যেখানে আশ্রয় নিয়েছে তার পাশেই আছে একটি গার্ডেন বা বাগান। কাজেই এ দু’জন নর-নারীকে ধর্ম বা পুরাণের প্রথম মানব-মানবী অ্যাডাম এবং ইভের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সেটি হলে গল্পটি হবেÑ প্যারাবুল অব হিউম্যান ফলিং। অ্যাডাম এবং ইভের মতো দুজন নরনারী আপনজগতচ্যুত হয়ে অন্য এক পৃথিবীতে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ঘটনাচক্রে তারা খুব কাছাকাছি থাকলেও তাদের মাঝখানে দূরত্ব হাজার মাইলের মতোÑ অ্যাডাম এবং ইভের মতোই। অ্যাডাম যেমন ঈশ্বরের ধ্যানে মগ্ন থাকে, জর্জও তেমন সারাক্ষণ বইয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। জর্জের উপযুক্ত সঙ্গ না পেয়ে স্ত্রী বেড়ালের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়, যেমন করে, হয়ত একই কারণে, ইভ বন্ধুত্ব করতে চায় সার্পেন্ট বা সাপের সঙ্গে। অ্যাডাম এবং ইভের ভেতর যে সাইকিক বা মানসিক দূরত্ব ছিল তা এখান থেকে অনুমান করা যায়। এটি হলে নারী-পুরুষের মাঝে যে সাইকিক দূরত্ব সেটা আসলে ঐতিহাসিক সূত্রে এসেছে।
অনুবাদ ও আলোচনায় মোজাফফর হোসেন।
বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ বই থেকে।