প্রশ্ন-১৩ঃ আমাদের রাসূল সা. মাটির তৈরী না নূরের তৈরী? কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে জানতে চাই?
উত্তরঃ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. নূর থেকে সৃষ্টি নাকি মাটি থেকে সৃষ্টি এটি মুসলিম সমাজের বর্তমান সময়ের কোন আলোচ্য বিষয় হওয়ার কথা ছিল না। বিষয়টি বহু আগে কুরআনে কারীমে স্পষ্টভাবে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, আমাদের সমাজে সুন্নীয়াতের অনুসারী বলে দাবীদার কিছু বিদআতী, কিছু আলেম নামধারী বে-আলেম নূর-মাটি বিতর্ক উস্কে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। তারা কুআনের কারীমের কিছু আয়াতের ভুল ব্যখ্যা ও কিছু জাল ও বানোয়াট হাদীসের ভিত্তিতে এসব করছে। আবার অনেকে না বুঝেও এই বিদআতীদের সাথে জড়িত হয়ে যাচ্ছে। আবার কেউবা করছে কেবল তাদের ব্যবসা, হাদীয়া-তোহফা, দাওয়াত-মাহফিল টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। কোন কোন এলাকায় এই বিদআতীদের দৌরাত্ব্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এরা আল্লাহর ঘর মসজিদকে পর্যন্ত সুন্নীয়াতের নামে বিদআতী কর্মকান্ডের আখড়া বানিয়ে ফেলেছে। তাইতো এ বিষয়ে কিছু লিখা প্রয়োজন বোধ করলাম। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবাইকে তাঁর হেদায়াতের আলোতে আলোকিত হওয়ার তাওফীক দান করুন।
প্রথমতঃ আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্মের উপাদানের উপর ভিত্তিশীল নয়। বরং এই শ্রেষ্টত্ব এবং সম্মান তাক্বওয়ার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। কাজেই নবী নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নূর থেকে সৃষ্টি না হয়ে মাটি থেকে সৃষ্টি হওয়া তাঁর জন্য মোটেও মানহানিকর বিষয় নয় যেমনটি অসংখ্য বিদআতী ধারণা করে বসেছে। বরং নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবার মত মানুষ হওয়া সত্বেও সৃষ্টির সেরা ব্যক্তিত্ব, সর্বাধিক মুত্তাক্বী-পরহেযগার, নবীকুল শিরোমণী, আল্লাহর হাবীব-অন্তরঙ্গ বন্ধু, আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে হাশরের মাঠে মহান শাফাআতের অধিকারী, হাওযে কাউছারের অধিকারী, সর্ব প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী, মাক্বামে মাহমূদের অধিকারী, রহমাতুল লিল আলামীন। এসব বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাঝে কোনই দ্বিমত নেই। এটিই সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈনে ইযাম, আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের আকীদা বা বিশ্বাস।
সৃষ্টির উপাদানের ভিত্তিতে ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয় করার বিষয়টি ইবলীস শয়তানের ধারণা। এই ধারণার ভিত্তিতেই সে আগুনের তৈরী বলে মাটির তৈরী আদমকে সিজদাহ করতে অস্বীকার করে ছিল। মহান আল্লাহ সূরা আরাফে ঘটনাটি এইভাবে উদ্ধৃত করেছেনঃ ‘আর আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এর পর আকার-অবয়ব তৈরী করেছি। অতঃপর আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছি, আদমকে সেজদা কর, তখন সবাই সেজদা করেছে, কিন্তু ইবলীস সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিল না। আল্লাহ বললেনঃ আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোমাকে কিসে সেজদা করতে বারণ করল? সে বললঃ আমি আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা। বললেনঃ তুই এখান থেকে নেমে যা। এখানে অহঙ্কার করার অধিকার তোর নাই। অতএব তুই বের হয়ে যা। নিশ্চয় তুই হীনতমদের অন্তর্ভূক্ত। (সূরা আল্ আরাফঃ১১-১৩)
দ্বিতীয়তঃ আমাদের রাসূল সা. কে নূরের তৈরী জ্ঞান করার বিষয়টি পবিত্র কুরআনে কারীমের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা। এটি জাল এবং বাতিল হাদীছ নির্ভরশীল একটি ভ্রান্ত মতবাদ। রাসূল সা. সকল মানুষের মত মাটির তৈরী মানুষ ছিলেন এ বিষয়ে অতীতে ছালাফে ছালেহীনের মাঝে কোনই বিতর্ক ছিল না। এখনও যারা প্রকৃত আলেম তারাও এই মর্মে একমত। তারা এটাও বিশ্বাস করেন যে, মানুষ মাটির তৈরী, ফেরেস্তা নূরের এবং জ্বিন জাতি আগুনের তৈরী যেমনটি স্বয়ং রাসূল সা. বলেছেন (মুসলিম, যুহদ ও রাক্বায়িক্ব অধ্যায়,হা/৫৩৪) । কারণ এই মর্মে কুরআন ও হাদীছের বাণী একেবারে স্পষ্ট। কুরআনের শত শত তাফসীরে একইভাবে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। কেবল তাফসীরে রূহুল বায়ান নামক একটি অনির্ভরযোগ্য তাফসীরে জাল হাদীসের ভিত্তিতে একটি ভিন্নমত আলোচনা করা হয়েছে যার সাথে মুফাসসিরগণ দ্বিমত পোষন করেছেন। আর কুরআনের আয়াতসমূহ এই প্রসঙ্গে এতটাই স্পষ্ট যে, এর জন্য তাফসীরের প্রয়োজন হয় না। এর পরও বিদআতে যাদের আপাদমস্তক নিমজ্জিত তারা এ বিষয়ে বিতর্ক জন্ম দিয়ে প্রশান্তি অনুভব করে। তারা বলতে চায়, রাসূল সা. মাটির তৈরী নন, বরং তিনি নূরের তৈরী, তার ছায়া ছিল না..ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই আমরা বিষয়টির ফয়সালা সরাসরি কুরআন ও সহীহ হাদীস থেকে নিব।
ক) সকল নবী-রাসূল সা. "বাশার" বা মটির তৈরী মানুষ ছিলেনঃ
আল্লাহ তা'আলা রাসূল সা. কে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ "আর তোমার পূর্বে আমি মানুষকেই (রাসূল হিসেবে) প্রেরণ করেছিলাম, জনপদবাসীর মধ্য হতে যাদেরকে আমি ওহী করেছিলাম..." (১২-সূরা ইউসুফঃ ১০৯)
আল্লাহ তা'আলা আরও বলেনঃ “আর তোমার পূর্বে আমি যে রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি নিশ্চয় তারা অবশ্যই খাবার খেত ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করত।" (২৫-সূরা ফুরকানঃ ২০)।
আল্লাহ তা'আলা আরও বলেনঃ “আর তোমার পূর্বে আমি মানুষকেই (রাসূল হিসেবে) প্রেরণ করেছিলাম, যাদের প্রতি আমি ওহী করেছিলাম, সূতরাং তোমরা যদি না জান তাহলে যিকিরধারীদেরকে (কিতাবধারীদেরকে) জিজ্ঞাসা কর।" (২১-সূরা আম্বিয়াঃ ০৭)।
আল্লাহ আরো বলেনঃ "তাদের রাসূলরা (অর্থাৎ নূহ, আদ ও ছামুদ জাতির রাসূলরা) তাদেরকে বলেছিল, 'আমরা তোমাদের মত মানুষ ছাড়া আর কিছু নই, কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করেন তার উপর অনুগ্রহ করেন।" (১৪-সূরা ইবরাহীমঃ১১)
খ) আমাদের রাসূল সা. ও "বাশার" বা মটির তৈরী মানুষ ছিলেন।
বিষয়টি কুরআনে কারীমের বহু আয়াত থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত। সূরা কাহফে আল্লাহ তা'আলা রাসূল সা. কে উদ্দেশ্য করে ইরশাদ করেনঃ "বল, 'আমি কেবল তোমাদের মত একজন মানুষ, আমার প্রতি ওহী করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ্ কেবল এক ইলাহ্। সূতরাং যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ আশা করে, সে যেন সৎকাজ করে ও তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।" (১৮-সূরা আল্ কাহাফঃ ১১০)
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেনঃ "বল, 'আমি কেবল তোমাদের মত একজন মানুষ। আমার প্রতি ওহী করা হয় যে, তোমাদের ইলাহ কেবল এক ইলাহ..." (৪১-সূরা হা-মীম-আস-সাজদাঃ ৬)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ "বল, পবিত্র আমার প্রতিপালক! আমি কি একজন মানুষ ও একজন মানুষ ছাড়া অন্য কিছূ?" বলুন আমি আমার প্রতিপালকের পবিত্রতা বর্ণনা করছি। একজন মানব, একজন রাসূল বৈ আমি কে? (১৭-সূরা বনী ইসরাইল: ৯৩)
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেনঃ "অবশ্যই আল্লাহ মু'মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদের নিজেদের মধ্য হতে (অর্থাৎ মানুষের মধ্য হতে) তাদের নিকট একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন..."(৩-সূরা আলে ইমরানঃ ১৬৪)
তিনি আরো বলেনঃ "অবশ্যই তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে (অর্থাৎ মানুষের মধ্য হতে) তোমাদের নিকট এসেছে একজন রাসূল। তোমরা যা কিছুতে কষ্ট পাও তা তার কাছে কঠিন (দুঃসহ), (তিনি) তোমাদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন, এবং মু'মিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু।" (৯-সূরা তাওবা: ১২৮)
তিনি আরো বলেনঃ "মানুষের জন্য কি এটা আশ্চর্যের বিষয় যে, আমি তাদেরই একজনের কাছে (অর্থাৎ মানুষের কাছে) ওহী (নাযিল) করেছি এই মর্মে যে, তুমি মানুষকে সতর্ক কর এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে উঁচু মর্যাদা? কাফিররা বলে, নিশ্চয় এই ব্যক্তি অবশ্যই এক সুষ্পষ্ট জাদুকর।" (১০-সূরা ইউনুস: ২)
আল্লাহ আরো বলেনঃ "যেমন আমি তোমাদের মধ্যে তোমাদের মধ্য থেকেই (অর্থাৎ মানুষের মধ্য থেকেই) একজন রাসূল প্রেরণ করেছি, যে তোমাদের নিকট আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে ও তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, এবং তোমাদেরকে এমন কিছু শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না।" (২-সূরা বাকারা ১৫১)
হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল আ. কাবা ঘরের ভিত্তি উত্তোলন করে দু'আ করেছিলেন তাদের বংশ থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করার জন্যঃ "হে আমাদের প্রতিপালক! এবং তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে একজন রাসূল পাঠান যিনি তাদের নিকট আপনার আয়াতসমূহ পাঠ করবেন, তাদরেকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন।" (২-সূরা বাক্বারা-১২৯)
আল্লাহ আরো বলেনঃ "তাদেরই একজনকে তাদের মধ্যে রসুল হিসেবে প্রেরণ করেছিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহর বন্দেগী কর" (মু’মিনুন-৩২)
গ) রাসূল সা. মাটির তৈরী মানুষ হওয়ার বিষয়টি কাফেররাও জানত এবং তারা অশ্চর্য হয়েছিলঃ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা ইরশাদ করেনঃ " এরা আশ্চর্য হয় যে, তাদের মধ্যে থেকেই (মানুষের মধ্য থেকেই) তাদের নিকট (মানুষের নিকট) একজন সতর্ককারী এসেছে । সুতরাং অবিশ্বাসীরা বলে, "এটা তো বড় আশ্চর্য ব্যাপার !”-সূরা কাফঃ ০২
অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ “এরা আশ্চর্য হচ্ছে এই ভেবে যে, তাদের মধ্য থেকেই তাদের জন্য একজন সর্তককারী এসেছে এবং অবিশ্বাসীরা বলে যে, এ তো একজন যাদুকর , মিথ্যা বলছে” -সূরা ছোয়াদঃ ০৪
তিনি আরও ইরশাদ করেনঃ " এবং যখন তাদের নিকট পথনির্দেশনা আসে তখন লোকদেরকে ঈমান আনা থেকে কেবল তা-ই বিরত রাখে যে, তারা বলে, "আল্লাহ কি মানুষকেই রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন?" (১৭-বনী ইস্রাঈলঃ ৯৪)
তিনি আরও ইরশাদ করেনঃ “তাদের অন্তর [তা নিয়ে] তুচ্ছ বিষয়ের মত খেলা করে । পাপীরা তাদের গোপন পরামর্শ লুকিয়ে রেখে [বলে]" সে কি তোমাদের মত একজন মানুষ নয় ? তোমরা কি দেখে শুনে যাদুর কবলে পড়বে ?”-সূরা আম্বিয়াঃ ০৩
তিনি আরও ইরশাদ করেনঃ “এবং তারা বলে, "এ কি রকম রসুল, যে [মানুষের মত] আহার করে এবং রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করে ? তার নিকট কোন ফেরেশতা কেন অবতীর্ণ করা হলো না, যে তাঁর সাথে থাকতো সতর্ককারীরূপে ? অথবা তাকে ধন ভান্ডার দেয়া হয় নাই কেন অথবা উপভোগের জন্য তার কোন বাগান নাই কেন ?" দুষ্ট লোকেরা বলে, "তোমরা তো এক যাদুগ্রস্থ লোকেরই অনুসরণ করছো"-সূরা ফুরকানঃ ০৭-০৮
তিনি আরও ইরশাদ করেনঃ “কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসীদের প্রধাণগণ বলেছিলো, "আমরা তো তোমাকে আমাদের মত মানুষ ব্যতীত আর কিছু দেখছি না । আমাদের মধ্যে যারা নিম্নস্তরের, অপরিপক্ক বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন, তারা ব্যতীত আর কাউকে তোমাকে অনুসরণ করতে দেখছি না । আমরা আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব দেখছি না, বরং আমরা তোমাদের মিথ্যাবাদী মনে করি”- সূরা হুদঃ ২৭
তিনি আরও ইরশাদ করেনঃ কাফেররা বললঃ এতো আমাদের মতই মানুষ বৈ নয়, তোমরা যা খাও, সেও তাই খায় এবং তোমরা যা পান কর, সেও তাই পান করে । যদি তোমরা তোমাদের মত একজন মানুষের আনুগত্য কর, তবে তোমরা নিশ্চিতরূপেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে (মু’মিনুন-৩৩, ৩৪)
তিনি আরও ইরশাদ করেনঃ "তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ । তোমরা আমাদেরকে ঐ উপাস্য থেকে বিরত রাখতে চাও, যার ইবাদত আমাদের পিতৃপুরুষগণ করত (ইবরাহীম-১০)"
ঘ) আল্লাহ তা'আলা কেন নূরের তৈরী ফেরেশতাকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেননি
আল্লাহ তা'আলা আরও ইরশাদ করেনঃ "বল, ফেরেশতারা যদি পৃথিবীতে নিশ্চিন্তে চলাচল করত তবে অবশ্যই আমি আকাশ থেকে তাদের নিকট একজন ফেরেশতাকেই রাসূল হিসেবে অবতীর্ণ করতাম।" (১৭-সূরা বনী ইসরাইলঃ ৯৫)
আল্লাহ তা'আলা যদি নূরের তৈরী ফেরেশতাকেও রাসূল হিসেব পাঠাতেন তবুও কিছু লোক বিভ্রান্তির মধ্যে থেকে যেত। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ "এবং যদি আমি তাকে ফেরেশতা বানাতাম তাহলে অবশ্যই তাকে মানুষ হিসেবে বানাতাম এবং তাদেরকে অবশ্যই সেরূপ বিভ্রমে ফেলতাম যেরূপ বিভ্রমে (এখন) তারা রয়েছে।" (৬-আল আন'আমঃ ৯)
রাসূল সা. যে নূরের তৈরী ফেরেশতা নন তা কুরআনে সরাসরি উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা রাসূল সা. কে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
"... এবং আমি গায়েব বা অদৃশ্যও জানি না এবং আমি তোমাদেরকে বলি না যে, নিশ্চয় আমি ফেরেশতা, আমি কেবল তা-ই অনুসরণ করি যা আমার প্রতি ওহী করা হয়" (৬-সূরা আল আন'আমঃ ৫০)
ঙ) রাসূলুল্লাহ সা. সৃষ্টিগত দিক থেকে অন্য মানুষের মতই মানুষ মর্মে হাদীছ থেকে প্রমাণঃ
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেনঃ আমি তো একজন মানুষ, আমিও তোমাদের মত ভুলে যাই, কাজেই আমি ভুলে গেলে আমাকে তোমরা স্মরণ করিয়ে দিবে (বুখারী, ছালাত অধ্যায়, হা/৩৮৬, মুসলিম মসজিদ ও ছালাতের স্থান অধ্যায়, হা/৮৮৯)
তিনি আরো বলেনঃ আমি তো একজন মানুষ, আমার নিকট বাদী আসে, সম্ভবত তোমাদের একজন অপর জন অপেক্ষা বেশি বাকপটু হবে, তাই আমি ধারণা করে নিতে পারি যে সে সত্য বলেছে কাজেই সে মতে আমি তার পক্ষে ফায়ছালা দিয়ে দিতে পারি । তাই আমি যদি তার জন্য কোন মুসলিমের হক ফায়সালা হিসাবে দিয়ে থাকি, তাহলে সেটা একটা জাহান্নামের টুকরা মাত্র । অতএব সে তা গ্রহণ করুক বা বর্জন করুক (বুখারী, মাযালিম অধ্যায়, হা/২২৭৮)
মা আয়েশাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাড়িতে থাকাকালীন কী কাজ করতেন ? তদুত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ তিনি তো অন্যান্য মানুষের মত একজন মানুষ ছিলেন । তিনি তার কাপড় সেলাই করতেন, নিজ বকরীর দুধ দোহন করতেন, নিজের সেবা নিজেই করতেন (আহমাদ,হা/২৪৯৯৮, আল আদাবুল মুফরাদ প্রভৃতি, হাদীছ ছহীহ, দ্রঃ ছহীহুল আদাব আল্ মুফরাদ, হা/৪২০, মুখতাতাছার শামায়েলে তিরমিযী, হা/২৯৩, ছহীহাহ, হা/৬৭১)
চ) রাসূল সা.কে নূরের তৈরী প্রমাণে বিদআতীদের দলীসমূহের পর্যালোচনাঃ
বিদআতীরা রাসূল সা. কে নূরের তৈরী প্রমাণ করতে যেয়ে দলীল স্বরূপ কুরআন থেকে কতিপয় আয়াত পেশ করে থাকে।
যেমন,
মহান আল্লাহ এরশাদ করেনঃ "হে আহলে কিতাব! আমার রাসূল তোমাদের নিকট এসেছে, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে সে তার অনেক কিছু তোমাদের নিকট প্রকাশ করে এবং অনেক কিছু উপেক্ষা করে। অবশ্যই তোমাদের নিকট এসেছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আলো ও সুস্পষ্ট কিতাব। যার দ্বারা আল্লাহ শান্তির পথ প্রদর্শন করেন তাদেরকে যারা তাঁর সন্তুষ্টির অনুগামী হয় এবং তাঁর ইচ্ছায় তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন এবং তাদেরকে সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করেন।" (৫-সূরা মায়িদাঃ ১৫-১৬)
অত্র আয়াতে রাসূল সা. কে নূর বা জ্যোতি বলা হয়েছে। তিনি নুরের তৈরী এ কথা কোনভাবেই বলা হয়নি। জ্যোতি যেমন অন্ধকার দূরকারী তেমনি আমাদের প্রিয় নবী সা. জাহিলিয়াতের অন্ধকার দূর করে পৃথিবেকে ওহীর আলোয় অালোকিত করেছেন। যেমন আমরা কোন জ্ঞানী পন্ডিত ব্যাক্তি সম্পর্কে বলে থাকি " অমুক ব্যক্তি আমাদের সমাজের একটি বাতি" এর মানে এই নয় যে, তিনি বাতির তৈরী। পৃথিবীর তাবৎ মুফাসসিরগণ এই আয়াতের তাফসীরে এমনটিই বলেছেন। তাফসীরে রূহুল বায়ান নামক জাল হাদীসে ভরপুর একটি বিতর্কিত তাফসীর ছাড়া শত শত তাফসীরে এমনটিই বলা হয়েছে। এছাড়াও মহান আল্লাহ রাসূল সা. কে অন্যত্রে উজ্জ্বল প্রদীপ বলেও আখ্যা দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছেঃ ‘হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়করূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে। (সূরা আল্ আহযাব: ৪৫-৪৬)
আর তাঁকে কেন জ্যোতি হিসেব আখ্যায়িত করা হল তা সূরা মায়িদার ১৬ নং আয়াতের শেষাংশেই উল্লেখ করা হয়েছেঃ "তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন এবং তাদেরকে সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করেন"।
বিদআতীদের ব্যখ্যা যে স্পষ্টত: ভুল তা কুরআনে কারীমের অনেক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। কুরআনে কারীমের বহু আয়াতে কুরআন সহ অন্যান্য আসমানী কিতাবকে নূর বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ আল কুরআনকে স্পষ্ট ভাষায় ‘নূর-জ্যোতি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে: ‘অতএব তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যে আলো (কুরআন) আমি অবতীর্ণ করেছি তাতে ঈমান আনয়ন কর। তোমরা যা কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত। (সূরাহ আত্ তাগাবুন:৮)
অন্য সূরায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ "সুতরাং যারা তাঁর (মুহাম্মাদ এর) উপর ঈমান এনেছে, তাঁকে সম্মান করেছে, সাহায্য করেছে এবং তার উপর যে নূর (অর্থাৎ কুরআন) অবতীর্ণ করা হয়েছে তার অনুসরণ করেছে তারাই হল প্রকৃত সফলকাম। (সূরা আল্ আরাফ: ১৫৭)
তাছড়াও কুরআন সহ অন্যান্য আসমানী কিতাবকে নূর বলা হয়েছে যেসব আয়াতসমূহে তা হলঃ সূরা তাওবা, আয়াত নং ৩২, সূরা আন'আম, আয়াত নং ৯১, সূরা সাফ, আয়াতঃ ৮, সূরা আশ শূরা, আয়াতঃ ৫২, সূরা আন নিসা, আয়াতঃ ১৭৪, সূরা আম্বিয়া, আয়াতঃ ৪৮।
তার মানে কি এই যে কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব "নুরের তৈরী"? কুরআনকে নূর বলার পরও যদি নূরের সৃষ্টি না বলা হয়, তবে রাসূলকে নূরের সৃষ্টি কোন্ যুক্তিতে বলা হবে? কারণ মহান আল্লাহ নবীকে যেমন ‘নূর’ বলেছেন, ঠিক তেমনিভাবে পবিত্র আল কুরআনকেও ‘নূর’ বলেছেন। সহজ বিষয় বুঝতে কষ্ট হয়?
বিদআতীরা বলে থাকেঃ আব্দুল্লাহ ও আমেনার মিলনের মাধ্যমে তিনি আসেন নি, বরং আব্দুল্লাহর কপালে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম নূর আকারে ছিলেন, তিনি আমেনাকে চুম্বন করলে সেই নূর তার উদরে চলে যায়। রাসূল সা. এর কোন ছায়া ছিল না ইত্যাদি।
এভাবে নূর পার্টিরা আজগুবি কথা বলে থাকে। ঐমর্মে তারা মিথ্যা ও বানাওয়াট কিসসা-কাহিনী প্রচার করে বেড়ায় যার কোন ভিত্তি নেই।
বিদআতীরা কি আরো বলবে ‘উনি আসলেই সৃষ্টিগত দিক থেকে উজ্জ্বল চেরাগ ছিলেন’! তার থেকে আগুণ নিয়ে মানুষ নিজেদের রান্না-বান্নার কাজ করতেন, তাদের চুলায় আগুণ ধরাতেন, বাড়ির চেরাগ জ্বালাতেন…?
ছ) বিদআতীদের পক্ষ থেকে পেশকৃত হাদীসসমূহের পর্যালোচনাঃ
উল্লেখ্য, বিদআতীদের দলীলগুলি কুরআনের আয়াতের মন গড়া ব্যাখ্যা, আর হাদীছের নামে কিছু বানাওয়াট জাল হাদীছ ছাড়া কিছুই নয়। যে সব ছহীহ হাদীছ তারা তাদের মতের পক্ষে পেশ করে থাকে তারা তার প্রকৃত ব্যাখ্যা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটু লক্ষ্য করলে দিবালোকের ন্যায় প্রমাণ হবে যে, তাদের পেশকৃত ছহীহ হাদীছগুলো তাদের মতের বিরুদ্ধে যায়। বরং দাবীর সাথে দলীলের কোন মিল নেই।
১. বিদআতীরা বলে থাকেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ "আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন"।
এটি একটি মিথ্যা ও বানোয়াট হাদীছ যা রাসুলুল্লাহ সা. এর নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। হাদীসের ছয় কিতাব (কুতুবে সিত্তাহ), নয় কিতাব (কুতুবে তিস'আ) সহ কোন স্বীকৃত হাদসি গ্রন্থে হাদীসটি পাওয়া যায় না। العجلوني নামক একজন লেখক সাহাবীহ জাবের রা. এর সূত্রে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে বলে তার কিতাবে উল্লেখ করেছেন কিন্তু হাদীস বিশারদগণ এ বিষয়ে একমত যে এটি একটি মিথ্যা ও বাতিল হাদীস।
আর যদি তর্কের খাতিরে এটিকে হাদীস হিসেবে ধরেও নেই তাহলে এর জবাব হল আরেকটি হাদিছ । ঐ হাদীছে বলা হয়েছেঃ
"আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার রূহ সৃষ্টি করেন"। তাহলে ঐ হাদিছ এবং এই হাদিছের মর্ম একই । অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলের রুহ মোবারক নূরের তৈরী, সমস্ত শরীর নয় । আসলে কোন মানুষের রূহই মাটির তৈরী নয়; বরং সমস্ত মানুষের আত্নাই নূরের তৈরী ।
২. বিদআতীরা বলে থাকেনঃ রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ "আদম সৃষ্টির ১৪০০০ বছর পূর্বেই আমি আমার প্রতিপালকের নিকট নূর আবস্থায় ছিলাম ( كنت نوراً بين يدي ربي قبل خلق آدم بأربعة عشر ألف عام )। হাদীস বিশারদগণ কোন কোন সহীহ হাদীসগ্রন্থ তো দূরের কথা কোন হাদীসের গ্রন্থেই হাদীসটিকে খূঁজে পাননি। এটিও একটি বানোয়াট হাদীস।
জ) যুক্তিগ্রাহ্য দলীলঃ
বিদআতীদের নিকট প্রশ্ন হল, রাসূল সা. কি আদম সন্তানদের অন্তর্ভূক্ত? যদি হয়ে থাকেন তাহলে মাটির তৈরী আদমের সন্তান নূরের তৈরী হয় কিভাবে?
তাদের নিকট আরেকটি প্রশ্নঃ আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহান আল্লাহর নিম্ন বর্ণিত বাণীর বাইরে না ভিতরেঃ ‘এ মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃজন করেছি, এতেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে দিব এবং পুনরায় এ থেকেই আমি তোমাদেরকে উত্থিত করব। (সূরা ত্বো-হা: ৫৫)
তাদেরকে আরেকটি প্রশ্নঃ নূরের তৈরী ব্যক্তির সন্তান-সন্তনি কিসের তৈরী? যেমন আমাদের নবী যদি নূরের তৈরী হন, তবে তার সন্তান-সন্ততি যেমন-ফাতেমা, যায়নাব, রুকাআইয়া, উম্মুকুলছুম এবং ক্বাসেম ও ইবরাহীম (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) তাঁরা তাহলে কিসের তৈরী? তাদের যারা সন্তান যেমন ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনাহা)-এর সন্তান হাসান ও হুসাইন-তারা কিসের তৈরী? নূরের তৈরী ব্যক্তির সন্তান মাটির তৈরী কোন্ যুক্তিতে হবে? যিনি নূরের তৈরী হবেন (তার সন্তান-সন্ততি হলে)তার সন্তান-সন্ততিও নূরের তৈরী হবে এটাইতো স্বাভাবিক, তাহলে তারা নূরের তৈরী হলেন না কেন?
শেষ কথাঃ যারা নূর-মাটি নিয়ে অযথা বিতর্ক করছে এবং মুসলিম সামাজে বিভ্রান্ত, হানাহানি ভুল আক্কীদা ছড়িয়ে তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করছে তাদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা এবং সহীহ পথে ফিরে এসে তাদের আখিরাতের জীবনকে রক্ষা করা। মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ও দলাদলি সৃষ্টি করা একটি কুফরী কাজ। কেউ যদি তা ইচ্ছাকৃতভাবে এ্ই অপরাধের সাথে জড়িত হয় তাহলে তার পরিণাম কি হবে তা ভাবা উচিত। ভাল নিয়তে মন্দকাজ করলে তার পরিণামও ভাল হবে না। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেনঃ "বল, আমি কি তোমাদেরক কাজের দিক থেকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্তদের সংবাদ দিব? দুনিয়ার জীবনে যাদের প্রচেষ্টা নিস্ফল হয়েছে, অথচ তারা মনে করে যে, তারাই সুন্দরভাবে কাজ করছে।" (১৮-সূরা কাহ্ফঃ ১০৩-১০৪)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:৩৯